যুদ্ধবিরতির মধ্যেই আগামী সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান বৈঠকের সম্ভাবনার কথা বললেন ট্রাম্প

ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সংঘাতের পর টানা দ্বিতীয় দিনের মতো যুদ্ধবিরতি অব্যাহত থাকায় আংশিক স্বস্তি ফিরে এসেছে। এরই মধ্যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী সপ্তাহে আমেরিকা ও ইরানের কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে—যা দীর্ঘমেয়াদে শান্তি প্রতিষ্ঠার আশার আলো জাগিয়েছে।
নেদারল্যান্ডসে ন্যাটো সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ট্রাম্প জানান, প্রায় দুই সপ্তাহের সংঘাতের পর মঙ্গলবার শুরু হওয়া যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
তবে তিনি ইঙ্গিত দেন, তেহরানের সঙ্গে (পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে) আলোচনায় তিনি খুব বেশি আগ্রহী নন, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক হামলায় ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা কার্যত ধ্বংস হয়ে গেছে বলে দাবি করেন তিনি। অন্যদিকে, ইরানের এক কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আর আস্থা রাখা যায় কি-না সে প্রশ্নও তুলেছেন।
ট্রাম্প বলেন, "আমরা হয়তো কোনো চুক্তি করব, জানি না। আমার দৃষ্টিতে, তারা লড়াই করেছে, এখন যুদ্ধ শেষ।"
ইরানের পক্ষ থেকে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো আলোচনার ঘোষণা না এলেও—যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ জানিয়েছেন, সরাসরি ও পরোক্ষ উভয় ধরনের যোগাযোগ ইতোমধ্যে হয়েছে। এর আগে মাসের শুরুতে, ইসরায়েলি হামলায় ইরানি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর— ওমানে অনুষ্ঠিতব্য ষষ্ঠ দফার যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক কর্মসূচির আলোচনা বাতিল করা হয়।
ট্রাম্প যুদ্ধবিরতি "খুব ভালোভাবে চলছে" বলে উল্লেখ করে ফের বলেন, ইরান পারমাণবিক বোমা বানাবে না এবং তারা (ইউরেনিয়াম) সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম চালাতে পারবে না।
এদিকে, ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি অব্যাহত রাখার বিষয়ে অনড় অবস্থানে রয়েছে। পরিস্থিতি আরও জটিল করে, ইরানের পার্লামেন্ট দ্রুত একটি আইন পাসের উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সঙ্গে সহযোগিতা কার্যত স্থগিত থাকবে। পার্লামেন্ট স্পিকার মোহাম্মদ বাকের কালিবাফ বলেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার নিন্দা না জানানোয় আইএইএর সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত থাকবে, তবে শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচি জোরদার করা হবে।
আইএইএ মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রসি নিশ্চিত করেছেন, তিনি ইরানের সঙ্গে নতুন করে আলোচনা শুরু করতে চেয়েছেন, বিশেষত যখন ইরান দাবি করেছে যে, মার্কিন হামলার আগেই তারা তাদের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে।
গ্রসি বলেন, "আমাদের (আলোচনায়) ফিরতে হবে। আমাদের মধ্যে সম্পৃক্ততা প্রয়োজন।"
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ-ও ইরানকে আলোচনায় ফেরার আহ্বান জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, ফ্রান্স ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী; ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে এ চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করার পর এই চুক্তি কার্যত ভেঙে পড়ে। চলমান সংকটের মধ্যেও মাখোঁ ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের সঙ্গে কয়েক দফা কথা বলেছেন।
গ্রসি জোর দিয়ে বলেন, পরমাণু অস্ত্র প্রসারের বিরুদ্ধে চুক্তির আওতায় ইরানের আইএইএর সঙ্গে সহযোগিতা বাধ্যতামূলক। তিনি বলেন, "যুদ্ধবিরতির এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। বিলম্বের সুযোগ নেই।"
ইরান শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির কথা বললেও, ইসরায়েল দাবি করে, আইএইএ'র পর্যবেক্ষণ ছাড়া ইরান দ্রুতই পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর মতো অবস্থানে চলে যেতে পারে। যদিও ইসরায়েল নিজের পারমাণবিক অস্ত্রের অস্তিত্ব কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে না।
যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রভাব নিয়ে বিতর্ক
ইসরায়েলি পরমাণু শক্তি কমিশনের দাবি, মার্কিন ও ইসরায়েলি বিমান হামলায় ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টা "অনেক বছর পিছিয়ে গেছে"। তবে তারা কোনো নির্দিষ্ট তথ্য প্রকাশ করেনি।
ট্রাম্প বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনা "সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস" হয়েছে। যদিও মার্কিন গোয়েন্দা তথ্যের বরাত দিয়ে কেউ কেউ বলছেন, এর প্রভাব সাময়িক হতে পারে—এমন প্রশ্নে ট্রাম্প বলেন, ইরানকে পুনর্গঠন করতে "বহু বছর" লেগে যাবে।
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এসমাইল বাঘাই স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ বোমারু বিমানের হামলায় তাদের স্থাপনাগুলো ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে, তবে তিনি বিস্তারিত কিছু জানাননি।
বাঘাই ইঙ্গিত দেন, আইএইএর সঙ্গে সম্পর্ক সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হচ্ছে না, কেবল সহযোগিতা স্থগিত থাকবে। একইসঙ্গে, তিনি বলেন, "আমরা শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তি অর্জনের অধিকার যেকোনো পরিস্থিতিতে রক্ষা করব।"
দীর্ঘমেয়াদে শান্তির পথ?
ইসরায়েলের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যুদ্ধবিরতি মূলত "শান্তির বিনিময়ে শান্তি" নীতিতে হয়েছে, এর বাইরে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে কোনো বিস্তৃত চুক্তি হয়নি।
ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে, মার্কিন দূত উইটকফ বলেন, ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ ক্ষমতা সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে, যা ছিল আলোচনার পূর্বশর্ত। তিনি বলেন, "প্রমাণ চোখের সামনে। কেউ গুলি ছুঁড়ছে না। যুদ্ধ শেষ।"
তবে উইটকফ আশাবাদ ব্যক্ত করেন, আরও বড় পরিসরের শান্তি চুক্তির আলোচনা এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, "আমরা ইতোমধ্যে সরাসরি ও মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে কথা বলছি।"
অন্যদিকে, ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। বাঘাই অভিযোগ করেন, যুক্তরাষ্ট্র বিমান হামলার মাধ্যমে কূটনীতির পরিবেশকে নষ্ট করেছে এবং ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা তাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
তিনি বলেন, "আমরা কূটনীতির জন্য উন্মুক্ত, তবে আমাদের নিশ্চিত হতে হবে, অন্যরা আন্তরিক কিনা, নাকি শুধু আমাদের অঞ্চলকে আরও অস্থিতিশীল করতে এটি ব্যবহার করছে।"
আইএইএ প্রধান গ্রসি সব পক্ষকে যুদ্ধবিরতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে কূটনীতিতে ফিরতে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, "সংঘাতের ধ্বংসাবশেষ থেকে এখন শান্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটিকে হাতছাড়া করা যাবে না।"
মোসাদের গোপন অভিযানের ভিডিও প্রকাশ
ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে, যেখানে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের টার্গেট ও অবকাঠামো ধ্বংসে গোপন অভিযানের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। মোসাদপ্রধান ডেভিড বার্নেয়া জানান, সিআইএ'র সহযোগিতা ও উন্নত নজরদারি প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই অভিযান সম্ভব হয়েছে।
মোসাদ এক ফেসবুক পোস্টে বলে, "অতুলনীয় গোয়েন্দা তথ্য ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের বিমান বাহিনী ইরানের আকাশপথের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা, এবং ক্ষেপণাস্ত্র হুমকি কমাতে সক্ষম হয়েছে।"
ইসরায়েলি সামরিক প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এয়াল জামির জানান, সংঘাতের সময় ইসরায়েলের বিশেষ বাহিনী "শত্রু অঞ্চলের গভীরে" অভিযান চালিয়েছে।
তেহরান জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের হামলায় ইরানে ৬০৬ জন নিহত এবং ৫,৩০০ জনের বেশি আহত হয়েছে। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্টস দাবি করেছে, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা ১,০৫৪ জন, যার মধ্যে ৪১৭ জন বেসামরিক নাগরিক ও ৩১৮ জন নিরাপত্তাকর্মী রয়েছেন।
ইসরায়েলের সরকারি তথ্যমতে, ওই সংঘাতে ইসরায়েলে ২৮ জন নিহত এবং ১,০০০-এর বেশি আহত হয়েছে।
এদিকে, গত দুই সপ্তাহে ইরানে ইসরায়েলের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ইরানে ছয়জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে তিনজনকে গতকাল (২৫ জুন) ফাঁসি দেওয়া হয়।