‘আমরা ওদের থেকে দ্বিগুণ টাকা আদায় করব': প্রতিরক্ষা ব্যয় ৫ শতাংশ না করায় স্পেনকে ট্রাম্পের হুমকি

অত্যন্ত সংবেদনশীল ন্যাটো সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বক্তব্য না দেওয়া পর্যন্ত স্পেনের জন্য সবকিছু মোটামুটি স্বাভাবিকভাবেই চলছিল। সম্মেলনে স্পেনই একমাত্র দেশ যে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় ৫ শতাংশে উন্নীত করার দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে। ব্যয় বাড়ানো প্রত্যাখ্যান করায় স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজের বিরুদ্ধে এক ধরনের রাজনৈতিক যুদ্ধ ঘোষণা করেন ট্রাম্প।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন যে, ন্যাটো সম্মেলনে স্পেনের অবস্থানের প্রতিশোধস্বরূপ তিনি দেশটির ওপর নির্ধারিত শুল্ক দ্বিগুণ করবেন: 'তারা এর খেসারত দেবে, এভাবেই তাদের আরও বেশি টাকা দিতে হবে।'
ট্রাম্প বলেন, 'তোমরাই একমাত্র দেশ যারা টাকা দিচ্ছে না। আমি বুঝি না সমস্যা কোথায়।' তিনি আরও জানান, তিনি সরাসরি সানচেজের সঙ্গে আলোচনা করবেন। 'তারা যা করেছে তা ভয়াবহ। তারাই একমাত্র দেশ যারা সম্পূর্ণ অর্থ দিতে চায় না, তারা ২ শতাংশেই থাকতে চায়।'
তিনি আরও বলেন, স্পেনের অর্থনীতি বর্তমানে 'খুব ভালো করছে, কিন্তু কোনো খারাপ কিছু ঘটলে সেই অর্থনীতি একেবারে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।'
ট্রাম্প বলেন, 'আপনারা জানেন, আমরা এখন স্পেনের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছি। আমরা তাদের দ্বিগুণ মূল্য দিতে বাধ্য করব। আর আমি আসলেই এ ব্যাপারে সিরিয়াস।'
ট্রাম্প স্পষ্টভাবে 'শুল্ক' শব্দটি ব্যবহার না করলেও, তিনি যে সেটির কথাই বোঝাতে চাচ্ছিলেন, তা ছিল একেবারেই পরিষ্কার — বিশেষ করে যখন ৯ জুলাইয়ের সময়সীমা দ্রুত এগিয়ে আসছে, যেদিন থেকে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব দেশের ওপর, স্পেনসহ, শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছে।
ট্রাম্প বলেন, 'আমি স্পেনকে পছন্দ করি, ওটা দারুণ একটা দেশ এবং সেখানকার মানুষও খুব ভালো। কিন্তু সমস্ত দেশের মধ্যে একমাত্র স্পেনই অর্থ দিতে অস্বীকার করছে। তারা একটু সুবিধা নিতে চায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের সেটা বাণিজ্যের মাধ্যমে ফিরিয়ে দিতে হবে, কারণ আমি এটা হতে দেব না,' তিনি জোর দিয়ে বলেন।
পরে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প স্পষ্ট করেন, তিনি নিজেই এই বাণিজ্য আলোচনার নেতৃত্ব দেবেন। 'এভাবে তারা আমাদের আরও বেশি অর্থ দেবে,' তিনি বলেন।
ন্যাটো সম্মেলনের শুরুতে পলিটিকোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওও স্পেন সরকারের অবস্থানের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, 'আমি মনে করি না, স্পেন যে চুক্তিতে পৌঁছেছে তা টেকসই।' তিনি ইঙ্গিত দেন, প্রধানমন্ত্রী সানচেজের এই অবস্থান মূলত অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চিন্তা থেকে এসেছে।
মার্কো রুবিও বলেন, 'স্পেন বর্তমানে গভীর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে আছে। দেশটিতে একটি বামঘেঁষা সরকার ক্ষমতায়, যারা সামরিক খাতে খুব সামান্য, কিংবা প্রায় কিছুই খরচ করতে চায় না। তারা একরকম একগুঁয়েভাবে অমান্য করে আসছে। এটা দুর্ভাগ্যজনক। স্পেন এমন একটি দেশ যাদের সামর্থ্য আছে, এবং তারা সৈন্য পাঠানো, সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে অবদানও রাখে।'
দ্য হেগে ন্যাটো সম্মেলনে স্পেনের প্রতিরক্ষা ব্যয় না বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে ঘিরে দেশটি আলোচনার কেন্দ্রে ছিল। সম্মেলনের ছবিতে প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজকে অনেকটাই একঘরে দেখা যায়। তবুও, এক সংবাদ সম্মেলনে সানচেজ আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে হাজির হন এবং ব্যাখ্যা করেন, তিনি এমন একটি বিশাল অতিরিক্ত ব্যয় এড়াতে পেরেছেন, যা স্পেনের কল্যাণ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারত।
এছাড়া, ঘনিষ্ঠ মিত্রদের বিরুদ্ধে চলমান দুর্নীতির অভিযোগের কারণে যখন তিনি চরম রাজনৈতিক সংকটে, তখনই সানচেজ সুযোগটি কাজে লাগান এবং বিরোধী নেতা আলবার্তো নুয়েস ফেইখোর বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অবস্থান নেন। সানচেজ মূলত বলেন, যদি রক্ষণশীল পপুলার পার্টি (পিপি) ক্ষমতায় থাকত, তাহলে তারা যুক্তরাষ্ট্রের দাবির কাছে নতি স্বীকার করত, যেটা ইউরোপের অন্যান্য দেশ ইতোমধ্যেই মেনে নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ ব্যাখ্যা করে বলেন, 'যদি আমরা ৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা ব্যয় মেনে নিতাম, তাহলে এখন থেকে ২০৩৫ সালের মধ্যে স্পেনকে অতিরিক্ত ৩০০ বিলিয়ন ইউরো প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ দিতে হতো। সেই অর্থ আসত কোথা থেকে? স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে কাটছাঁট করেই।'
সম্মেলনে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও আড়ালেও কঠোর সমালোচনার মুখে পড়লেও তাকে ফলাফল নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট মনে হয়েছেন।
তবে স্পেনীয় প্রতিনিধিদলের সূত্র অনুযায়ী, সম্মেলনের ভেতরের পরিবেশ ছিল অনেক শান্ত। সেখানে কেউ স্পেনকে সরাসরি আক্রমণ করেনি, বরং লিথুয়ানিয়া স্পেনের সামরিক উপস্থিতির জন্য ধন্যবাদ জানায়। একমাত্র ট্রাম্পই সানচেজের প্রতিরোধকে ঘিরে পরোক্ষ মন্তব্য করেন। সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বলেন, 'অধিকাংশ মিত্র দেশ ৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে সবাই নয়। কেন নয়, সেটা আমি বুঝতে পারছি না।'
তবে পরে এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প সরাসরি ও কড়া ভাষায় পেদ্রো সানচেজের বিরুদ্ধে দুটি আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেন।
বাস্তবে, ট্রাম্প ছাড়া বাকি অধিকাংশ দেশই মনে করছে যে, পেদ্রো সানচেজের যৌথ ঘোষণাপত্রে সই করাই যথেষ্ট। তারা স্পেন ও ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটের মধ্যে করা আলাদা চুক্তি নিয়েও কোনো আপত্তি তোলেনি, যার ফলে স্পেন কেবলমাত্র ২.১ শতাংশ প্রতিরক্ষা ব্যয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ হচ্ছে, ৫ শতাংশ নয়।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, যিনি তার দেশের তুলনামূলক দুর্বল অর্থনীতি, ঋণ ও ঘাটতি সত্ত্বেও ৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, মজার ছলে বলেন— যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয় কেন তিনি সানচেজের পথ অনুসরণ করেননি: 'ইতালি যা করেছে, স্পেনও তাই করেছে। কিংবা স্পেন যা করেছে, ইতালিও তাই করেছে — যেমনটা বলা যায়। আমরা তো একই নথিতে সই করেছি,'— বলে তিনি হেসে ওঠেন।
ন্যাটো সম্মেলনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও পেদ্রো সানচেজের মধ্যে দূরত্ব ছিল চোখে পড়ার মতো। তারা একে অপরকে সম্ভাষণ পর্যন্ত জানাননি — বিষয়টি স্বীকারও করেন সানচেজ। যদিও তিনি বলেন, এটা ইচ্ছাকৃত ছিল না, বাস্তবে তিনি দ্রুত বসে পড়ে ট্রাম্পের সঙ্গে সম্ভাব্য সাক্ষাৎ এড়িয়ে যান। ট্রাম্পের দাবির বিরুদ্ধে তিনি প্রকাশ্যে মুখোমুখি হননি; বরং ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটের সঙ্গে চিঠি বিনিময়ের মাধ্যমে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন। ক্যামেরার সামনে তিনি বেশিরভাগ নেতাদের কাছ থেকেও নিজেকে দূরে রাখেন।
সানচেজ বলেন, 'আমি তার (ট্রাম্পের) সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় বা দুই একটা কথা বলার সুযোগই পাইনি। তবে সমস্ত সদস্য রাষ্ট্র জানে, ন্যাটোর প্রতি স্পেনের নির্ভরযোগ্যতা ও প্রতিশ্রুতি কতটা দৃঢ়।'
মঙ্গলবার ট্রাম্প যখন বলেন, স্পেন ন্যাটো চুক্তির জন্য একটি 'সমস্যা', তখন এর জবাবে সানচেজ বলেন, 'স্পেন কখনোই সমস্যা নয়, বরং সবসময়ই সমাধান।'
'এই সম্মেলনের পর ন্যাটো জয়ী হয়েছে, স্পেন জয়ী হয়েছে, এবং নিরাপত্তা ও কল্যাণ রাষ্ট্রব্যবস্থাও জয়ী হয়েছে,' বলেন স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ। 'ন্যাটো এখন আরও ঐক্যবদ্ধ এবং ইউরোপ ও ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্কের সামনে থাকা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এই সম্মেলনের পর আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।'
তবে বেশ কয়েকজন বিশ্বনেতা এবং স্পেনের বিরোধী পক্ষ মনে করছেন, শেষ পর্যন্ত সানচেজ ৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা মানতে বাধ্য হবেন। সেই প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটের একটি চিঠি পড়ে শোনান।
তিনি বলেন, 'আজ আমরা যে ঘোষণাপত্রে সই করেছি, তা স্পেনকে তার সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে নিজস্ব পথ নির্ধারণের সুযোগ দেয় এবং জিডিপির শতকরা হিসাবে বাৎসরিক ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারণের স্বাধীনতাও দেয় — এটা একেবারেই স্পষ্ট।'
এখন সবাই যেন স্পেনকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্কটি পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চাইছে — এমনকি ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটেও, যিনি জানিয়েছেন যে স্পেন প্রতিরক্ষা ব্যয় নিয়ে 'গম্ভীর' অবস্থানে আছে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। যদিও স্পেন এখনো ধরে আছে যে, হেগে নির্ধারিত ৩.৫ শতাংশ লক্ষ্যে পৌঁছাতে তাদের এতটা খরচের প্রয়োজন নেই।
রুটে বলেন, 'স্পেন মনে করছে, তারা ২.১ শতাংশ ব্যয় করেই সেই সামরিক লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবে। কিন্তু ন্যাটো পুরোপুরি বিশ্বাস করে, সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে স্পেনকে ৩.৫ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় করতেই হবে।'
তিনি আরও যোগ করেন, 'দেখা যাক কী হয়। যাই হোক, ২০২৯ সালে এ নিয়ে একটি পর্যালোচনা হবে।'