বিরোধীরা জোট গড়লে নেতানিয়াহুর টানা এক যুগ শাসনের অবসান হতে পারে

নেতানিয়াহু যুগের শেষ হতে পারে ইসরায়েলে। গত রোববার এনিয়ে রাজনৈতিক নাটকের উত্তেজনায় রুদ্ধশ্বাস একদিন পার করেছে ইসরায়েলিরা। তেমনটা হওয়াটাই সঙ্গত, কারণ নেতানিয়াহু-ই হচ্ছেন সেদেশের ক্ষমতায় সবচেয়ে দীর্ঘদিন টিকে থাকা প্রধানমন্ত্রী।
ইসরায়লের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক কালে যে অচলাবয়স্থা দেখা দিয়েছে, তাতে এককভাবে সরকার গঠনের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোনো রাজনৈতিক দলই পাচ্ছে না। আবার জোটের রাজনীতির সমীকরণও জটিল।
গত দুই বছরে পর পর চারটি নির্বাচনে কোনো দলই সরকার গঠনের মতো আসন পায়নি। তবে বিরোধীদলীয় নেতা ইয়ার ল্যাপিড সরকার গঠনের জন্য ২৮ দিনের ম্যান্ডেট পান, আগামী বুধবারেই এই সময়সীমা শেষ হবে।
এরমধ্য রোববার ইসরায়েলি গণমাধ্যম জানায়, ল্যাপিড একটি জোট গঠনে এগিয়ে গেছেন। এমনকি ওইদিনই জোটের ঘোষণা আসতে পারে। এমনটা হলে নেতানিয়াহুর টানা ১২ বছরের প্রধানমন্ত্রীত্বের অবসান হবে, আর সে জন্যেই রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা ছিল ইসরায়েলিদের। তবে নেতানিয়াহু প্রধানমন্ত্রী পদে দায়িত্ব পালন করেছেন মোট ১৫ বছর।
রোববার ঘোষণা আসেনি, কিন্তু তা আজ সোমবার, বা আগামী মঙ্গলবার, এমনকি বুধবার শেষমুহূর্তে আসাও কাকতলীয় কিছু হবে না। ইসরায়েলি রাজনীতিতে জোট গঠনের সমীকরণে অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত দর কষাকষি ও চমকে দেওয়ার নজির আছে।

ল্যাপিড কি সরকার গঠনে সফল হবেন?
বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করছে কট্টর ডানপন্থী রাজনীতিক নাফতালি বেনেটের ওপর। পার্লামেন্ট নেসেটে মাত্র ছয়টি আসন আছে বেনেটের ইয়ামিনা পার্টির, তবুও তার সমর্থনই এখন ক্ষমতার চাবিকাঠি।
৪৯ বছরের বেনেট- ইয়েশ আতিদ দলের প্রধান ল্যাপিডের সঙ্গে জোট গঠন করবেন কিনা তা তিনি রোববারে ঘোষণা দেবেন বলে আশা করছিল দেশটির গণমাধ্যম।
তবে বাম, মধ্য ও ডানপন্থী সকলের সমন্বয়ে একটি সরকার গঠনের প্রস্তাব মনে ধরেছে ল্যাপিডের দলের অনেক আইনপ্রণেতার। তাদের সিদ্ধান্ত বদলাতেই আগে ল্যাপিডকে সচেষ্ট হতে হবে।
মূলত, গত ২৩ মার্চে সমাপ্ত নির্বাচন রাজনীতির এই অচলাবস্থা অবসান করতে পারেনি। এই অবস্থায় বিভিন্ন মতাদর্শের পক্ষকে একসঙ্গে নিয়ে গঠিত জোট সরকার খুবই দুর্বল হতে পারে। হয়তো তাদের পার্লামেন্টের আরব সদস্যদের সমর্থনও দরকার হবে। কিন্তু, বেনেটের কট্টর আরব বিদ্বেষী ইয়ামিনা দলের সঙ্গে আরব আইনপ্রণেতাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পূর্ণ বিপরীত। অর্থাৎ, বেনেট-ল্যাপিড কোয়ালিশিনে তাদের সমর্থন না দেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
ইসরায়েলি রাজনীতিতে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর উত্থান নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা এখানে তুলে ধরা হলো;
নেতানিয়াহুর বেড়ে ওঠা:
১৯৪৯ সালে তেল আবিবে জন্মগ্রহণ করেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তার বাবা ছিলেন একজন প্রভাবশালী ঐতিহাসিক ও জায়নবাদী অধিকারকর্মী বেন জায়ন। ১৯৬৩ সালে বেন জায়ন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরির প্রস্তাব পেলে তা গ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে পাড়ি জমান।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৮ বছর বয়সে ইসরায়েলে ফেরত আসেন নেতানিয়াহু। এরপর পাঁচ বছর তিনি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অভিজাত কম্যান্ডো ইউনিট- সায়েরাত মাকতালের একজন দক্ষ ক্যাপ্টেন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৮ সালে লেবাননের বৈরুত বিমানবন্দরে অভিযান চালানোসহ ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধেও তিনি অংশ নেন।

সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব পালন শেষে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান নেতানিয়াহু। সেখানে তিনি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে প্রথমে স্নাতক ও পরে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন।
বিখ্যাত ভাইয়ের খ্যাতি:
১৯৭৬ সালে নেতানিয়াহুর বড় ভাই জনাথন উগান্ডার এনটেবে বিমানবন্দরে ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির উদ্দেশ্যে চালানো এক অভিযানে অংশ নিয়ে নিহত হন। জনাথনের বীরত্বে অভিভূত হয় ইসরায়েলবাসী আর রাতারাতি তার নাম ইসরায়েলিদের মুখে মুখে ধ্বনিত হতে থাকে। নেতানিয়াহুর পরিবারের সদস্যরাও সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করে।
১৯৮২ সালে ওয়াশিংটনে ইসরায়েলি কূটনৈতিক মিশনের ডেপুটি চিফ থাকার সময় ভাইয়ের নামে একটি সন্ত্রাসবাদ বিরোধী ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন নেতানিয়াহু।
এরপর, রাতারাতি জনসম্মুখে আসা শুরু হয় তার। মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে তিনি ইসরায়েলের স্বপক্ষে একজন কার্যকর বক্তা হিসেবে হাজির হন।
১৯৮৪ সালে নেতানিয়াহুকে জাতিসংঘে ইসরায়েলের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

ক্ষমতার কেন্দ্রে উত্থান:
১৯৮৮ সালে ইসরায়েলে ফিরে আসার পর রাজনীতিতে প্রথম জড়ান নেতানিয়াহু। এসময় তিনি নেসেটের একটি আসনে লিকুদ পার্টির টিকেটে জয়ী হন, এবং পরবর্তীতে তিনি উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ পান।
এরপর, তিনি লিকুদ পার্টির চেয়ারম্যান হন এবং আইজ্যাক রবিন গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হওয়ার পর ১৯৯৬ সালের আগাম নির্বাচনে ইসরায়েলের প্রথম সরাসরি নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হন নেতানিয়াহু।
ওই সময়ে নেতানিয়াহুই ছিলেন ইসরায়েলের তরুণতম প্রধানমন্ত্রী এবং ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রটি গঠনের পর সেখানে জন্ম নেওয়া প্রথম প্রজন্মের ইহুদী।