একবাক্যে ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে গেছেন আমেরিকানরা, সেসব দিন কি বিগত হচ্ছে?

এক সময় ইসরায়েলের প্রতি আমেরিকানদের সমর্থন ছিল অটল। কিন্তু এখন বদলে যাচ্ছে সেই দৃশ্যপট।
এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক করেন—রাষ্ট্রপতির পদে ট্রাম্পের শপথ নেওয়ার পর কোনো বিদেশি নেতার সঙ্গে এটিই ছিল প্রথম সাক্ষাৎ। বৈঠকে ট্রাম্প জানান, গাজা উপত্যকার ওপর নিয়ন্ত্রণ নেবে যুক্তরাষ্ট্র এবং সেখান থেকে ফিলিস্তিনিদের 'সাফ করে' দেবে।
এই মন্তব্য বিশ্বের নজর কাড়ে, কারণ এটি ইসরায়েলের প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের অতিরঞ্জিত সমর্থন এবং আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি ও আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের জন্মভূমি ছাড়া করার ইঙ্গিত দেয়। আসলে এটি রিপাবলিকান পার্টির 'যে কোনো মূল্যে ইসরায়েল সমর্থন' নীতির চূড়ান্ত প্রকাশ ছিল।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে আক্রমণ চালানোর পর এবং ইসরায়েলের পাল্টা হামলার প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্ক আবার আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে।
এই যুদ্ধ চলাকালে ট্রাম্পের পূর্বসূরি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সরবরাহ করে ইসরায়েলকে, যা ছিল নজিরবিহীন। তবে এই সমর্থন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ব্যাপক প্রতিবাদও ডেকে আনে, বিশেষত ডেমোক্র্যাট ঘরানার তরুণ ভোটারদের মধ্যে। অনেকেই বাইডেনকে 'গণহত্যাকারী জো' বলে সম্বোধন করেন— তবে গণহত্যায় নিজের সমর্থনের অভিযোগ বাইডেন সবসময়ই প্রত্যাখ্যান করে এসেছেন।
অন্যদিকে, ট্রাম্প এই বিক্ষোভকারীদের 'চরম বামপন্থী উন্মাদ' বলে অভিহিত করেন এবং তার প্রশাসন এখন শত শত বিদেশি শিক্ষার্থীকে হামাসকে সমর্থন বা ইহুদিবিরোধী আচরণের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়নের উদ্যোগ নিয়েছে, যা দেশটির আদালতে আইনি চ্যালেঞ্জের মুখেও পড়েছে।

তবে বাইডেনের জন্য রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি ছিল আরও জটিল। ঐতিহাসিকভাবে যারা তাকে ভোট দিতেন, অর্থাৎ তরুণ ও উদারপন্থীরা— তাদের একটি বড় অংশই ইসরায়েলের প্রতি এই অন্ধ সমর্থনের কারণে ডেমোক্রেট দলের প্রতিই ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন।
বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান বলেছিলেন, "আমরা একদিকে ইসরায়েলের অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া, বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা ও মানবিক সহায়তার প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছি। অন্যদিকে, চেয়েছি ইসরায়েল যেন বিভিন্ন ফ্রন্টে শত্রুদের মোকাবেলায় সক্ষম থাকে।"
তিনি আরও বলেন, "৭ অক্টোবরের পর যুক্তরাষ্ট্র সব দিক থেকে ইসরায়েলের পাশে ছিল—অস্ত্রের চালান, নৈতিক সমর্থন এবং কূটনৈতিকভাবে।"

জনমত বদলাচ্ছে
তবে সাম্প্রতিক জরিপগুলো বলছে, মার্কিন জনসাধারণের মধ্যে ইসরায়েলপ্রীতি ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। জরিপসংস্থা গ্যালোপের মার্চ মাসের সমীক্ষা অনুযায়ী, মাত্র ৪৬ শতাংশ আমেরিকান এখন ইসরায়েলকে সমর্থন করেন—যা গত ২৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। বিপরীতে, ৩৩ শতাংশ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন—যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য বলছে, ২০২২ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে রিপাবলিকানদের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ২৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৭ শতাংশ হয়েছে, যার একটি বড় অংশই এসেছে ৪৯ বছরের নিচের তরুণদের কাছ থেকে।
ঐতিহাসিক সম্পর্ক: একক সিদ্ধান্তে গড়া বন্ধুত্ব
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণার দুই ঘণ্টার মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান তাকে স্বীকৃতি দেন। যদিও সেসময় মার্কিন প্রশাসন এনিয়ে বিভক্ত ছিল। প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিভাগ এর বিরোধিতা করেছিল, আশঙ্কা ছিল এটি আরব বিশ্বের সঙ্গে যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়াবে, এবং তা সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে।
তবুও ট্রুম্যান ব্যক্তিগত আবেগ ও ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের পরামর্শে ইসরায়েলের স্বীকৃতি দেন। এই সিদ্ধান্তই গড়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্কের ভিত্তি।
ইতিহাসবিদ রাশিদ খালিদি বলেন, "ইসরায়েলি পক্ষের নেতৃত্বে ছিলেন ইউরোপ ও আমেরিকার সংস্কৃতি বোঝা নেতারা। আরবদের সে ধরনের দক্ষতা ছিল না। তারা জানতই না কীভাবে আমেরিকান জনমতের কাছে নিজেদের দাবি তুলে ধরতে হয়।"
জনমনে সিনেমার প্রভাব
১৯৫৮ সালের উপন্যাস ও পরবর্তী সময়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্র 'এক্সোডস' ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গল্প আমেরিকানদের কাছে জনপ্রিয় করে তোলে। এতে ইসরায়েলি সংগ্রামকে মার্কিন আদর্শের সঙ্গে মিলিয়ে উপস্থাপন করা হয়।
সাবেক ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট বলেন, "১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে আমেরিকা বুঝতে পারে ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে একটি শক্তিশালী সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি—সেখান থেকেই সম্পর্ক গভীর হয়।"
সম্পর্কের টানাপড়েন
যদিও ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ সামরিক সহায়তাপ্রাপ্ত দেশ, তবুও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সম্পর্ক সহজসাধ্য নয়। বাইডেন প্রশাসনের ইসরায়েল সমর্থন মিশিগানের আরব আমেরিকান ভোটারদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তারা অনেকে হয় নির্বাচন বর্জন করেন অথবা ট্রাম্পকে ভোট দেন।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের আরেক জরিপ বলছে, বর্তমানে ৫৩ শতাংশ আমেরিকান ইসরায়েল সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন—২০২২ সালের তুলনায় যা ১১ পয়েন্ট বেশি।
তবে এখনো মার্কিন কংগ্রেসে ইসরায়েলপ্রীতির ধারায় বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। কিন্তু বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দীর্ঘমেয়াদে জনমতের এই পরিবর্তন আইনপ্রণেতাদের ওপর নীতিগত প্রভাব ফেলতে পারে।
ইসরায়েলের ভাবনায় আমেরিকান ইহুদিদের সরে যাওয়া
ইসরায়েলে ডানপন্থী ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ও নেতানিয়াহুর বিচার বিভাগীয় সংস্কারের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভের মধ্যে অনেক মার্কিন ইহুদিও নেতানিয়াহুর সমালোচনায় মুখর হন।
আসন্ন বিপদকে স্বীকার করেই যেন তেল আবিবের ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের গবেষণা বলছে, "যুক্তরাষ্ট্রের জনমত এখন 'ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে' প্রবেশ করেছে," এবং এই সমর্থন হ্রাস পেলে ইসরায়েলের জন্য তা হবে ভয়াবহ।
তরুণদের মত বদলাচ্ছে
পিউ রিসার্চের জরিপ অনুযায়ী, ৩০ বছরের কম বয়সী আমেরিকানদের ৩৩ শতাংশ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন, যেখানে মাত্র ১৪ শতাংশ ইসরায়েলিদের প্রতি সহমর্মিতার কথা বলেছেন। তবে বয়স্কদের মধ্যে ইসরায়েলপ্রীতি তুলনামূলক বেশি।
আর্দেন ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি প্র্যাকটিসের চেয়ারম্যান কারিন ভন হিপেল বলেন, "তরুণ কংগ্রেস সদস্যরা ইসরায়েল সমর্থনে আগের মতো প্রতিক্রিয়াশীল নন। এমনকি তরুণ ইহুদিরাও পূর্বপুরুষদের মতো ইসরায়েলপ্রীতি রাখেন না।"
তবে তিনি মনে করেন, এই পরিবর্তন নীতিগত কোনো বড় প্রভাব ফেলবে না। ২০২৮ সালের নির্বাচনে ডেমোক্রেট দলের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থীরা এখনো 'ইসরায়েলপন্থী' অবস্থানে রয়েছেন।
এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কোথায়?
ফেব্রুয়ারির ট্রাম্প-নেতানিয়াহু যৌথ সংবাদ সম্মেলনের পরে জেক সুলিভানকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আমেরিকা-ইসরায়েল সম্পর্ক কোথায় যাচ্ছে? তিনি উত্তর দেন, "এটা বিদেশনীতি নয়, বরং দুই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রশ্ন। আমেরিকা ও ইসরায়েল কোন পথে যাবে—তার ওপরই নির্ভর করবে এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ।"