নতুন ফর্মুলাতে বদলে যাবে কোকাকোলার জনপ্রিয় পানীয়ের স্বাদ!

আপনি যদি সম্প্রতি 'কোক জিরো সুগারে'র বোতলে চুমুক দিয়ে থাকেন এবং এর স্বাদ কিছুটা ভিন্ন ঠেকে, তবে বুঝবেন এ দলে আপনি একা নন। পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে কোকাকোলা কোম্পানি তাদের এই পানীয়ের স্বাদ বদলাতে চলেছে; তবে পরিবর্তীত স্বাদ সাধারণ কোকের কাছাকাছি নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে।
কোকাকোলা এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের 'সিগনেচার প্রডাক্টের' ক্ষেত্রে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট পরিসীমার মধ্যে থাকতে হয়। ভোক্তাদের পছন্দ যেমন মাথায় রাখতে হয়, তেমনি প্রতিযোগিতার বাজারেও পিছিয়ে পড়লে চলে না। স্বাভাবিকভাবেই তারা যখন পানীয়ের স্বাদে পরিবর্তন নিয়ে আসে, তা নিয়ে ভোক্তাদের মিশ্র প্রতিক্রিয়ার শঙ্কা তৈরী হয়। এমনকি নতুন ফ্লেভার নিয়ে নিরীক্ষা করতে গিয়ে সফল না হলে অনেক বিশ্বস্ত ভোক্তা বা কোকপ্রেমীই তা পছন্দ না করে খোদ কোকাকোলা ব্র্যান্ডটিকেই রেগেমেগে পরিহার করতে পারেন।
২০১৫ সালে কোকাকোলার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান পেপসিকোও এটি ভালভাবেই টের পেয়েছিল। ভোক্তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে তারা সে বছর ডায়েট পেপসি থেকে অ্যাসপারটেম (কৃত্রিম চিনি) সরিয়ে নেয়।
কোকাকোলাকেও তাই তাদের জনপ্রিয় পণ্যে নতুন কোন উপাদান সংযোজন বা পরিবর্তনের আগে সাবধানে পা ফেলা উচিত।
ফিরে দেখা, ১৯৮৫
১৮৮৬ সালে কোকাকোলার জন্ম; এর প্রায় ১০০ বছর পর ১৯৮৫ সালের এপ্রিলে নিউইয়র্কে প্রথম কোম্পানিটি তাদের পানীয়ের নতুন এক ফর্মুলা নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে। সেসময় গুজব উঠেছিল যে, কোকাকোলা ১০০ বছরে প্রথমবারের মতো তাদের পানীয়ের স্বাদে পরিবর্তন আনছে।
সে ঘটনার স্মৃতিচারণ করে টমাস অলিভার তার ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত বইয়ের 'দ্য রিয়েল কোক, দ্য রিয়েল স্টোরি' টপিকে লেখেন, "লিংকন সেন্টারের ভিভিয়ান বিউমন্ট থিয়েটারে সেদিন প্রায় দুই শতাধিক সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার এবং ক্যামেরাম্যান আগ্রহ নিয়ে এই চাঞ্চল্যকর খবরটি নিশ্চিতের অপেক্ষায় ছিলেন; ঘরে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সে সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিল আরও শত শত মানুষ"।
পেপসির কাছে তখন বাজার হারাচ্ছিল এই আইকনিক পানীয় ব্র্যান্ড; ফলে নতুন স্বাদের এই কোক কোম্পানির বড় এক সমস্যা সমাধানের আশা দেখাচ্ছিল।
পরীক্ষামূলক টেস্ট (Taste) ট্রায়ালের মধ্য দিয়ে নতুন স্বাদের সে কোকের উত্থান ঘটে। প্রায় ২ লাখ ভোক্তা নতুন সে কোক চেখে দেখেন এবং পুরনো কোকের চাইতেও এগিয়ে রাখেন। অরিজিনাল কোকের চাইতে নতুন সংস্করণকে তারা আরও বেশি কোমল এবং মিষ্টি হিসেবে চিহ্নিত করেন।

তবে নতুন কোককে বরণ করে নিতে হয় বিষোদগার! ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, 'আপনি এর স্বাদ বদলেছেন' শিরোনামে ভোক্তাদের একজন নাকি রীতিমত গানই রচনা করে ফেলেন। গানটির কথা ছিল অনেকটা এমন, 'আমাদের অনুভূতি অত্যন্ত তীব্র। আপনি হয়ত ৯৯ বছর সঠিক থেকে থাকবেন, কিন্তু এরপর আপনি আপনার দেশের সাথে ভুল করলেন'।
'তাই এখন আমাদের আর্জি শুনুন, এটা কোন কৌতুক নয়। কোকের প্রকৃত স্বাদ আমাদের ফিরিয়ে দিন'।
আরেকজন ভোক্তা নতুন এই স্বাদকে প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুর সাথে তুলনা করেন বলেও তখনকার আরেকটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
অলিভারের মতে, ১৯৮৫ সালের মে মাসের দিকে, কর্মকর্তাদের মধ্যে এই আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ছিল যে এই ক্ষোভ থেকে ভোক্তারা কোকাকোলার অন্যান্য পণ্য বর্জন করতে পারে।
একটি ব্লগ পোস্টে নতুন কোকের ইতিহাস বর্ণনা করে, কোম্পানিটি যে প্রতিক্রিয়া পেয়েছিল তা এভাবে তুলে ধরে: "আগে যেখানে দিনপ্রতি ৪০০ এর কাছাকাছি কল আসত, সেখানে কোকের স্বাদ বদলের পর থেকে, ১৯৮৫ সালের জুন মাসে কোকাকোলা কোম্পানির কনজ্যুমার হটলাইনে প্রতিদিন ১৫০০ ফোন আসতে লাগল।
কোকাকোলার কোন কর্মচারী হোক কিংবা সদর দপ্তরের নিরাপত্তা কর্মীদের থেকে শুরু করে তাদের প্রতিবেশি কেউ- যারাই কোকোকোলা কোম্পানির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, মানুষ মনে করত তাদের প্রত্যেকে কোকের এই পরিবর্তনের জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী।"
একই বছরে নিউইয়র্ক টাইমসের জুলাইয়ের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নতুন পণ্য উন্মোচনের কয়েক মাস না পেরোতেই জুন মাসে কোম্পানির নির্বাহীরা পুরানো সংস্করণটি ফিরিয়ে আনার বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে শুরু করেন।
হ্যা, কোকাকোলা তার ভক্তদের কথা রাখে। কোকের পুরনো ফর্মুলাই তারা ফিরিয়ে আনে এবং শেষ পর্যন্ত নতুন কোককে সম্পূর্ণভাবে বাজার থেকে বিদায় করে।
তবে নতুন কোকের সে স্বাদ একেবারে বিস্মৃত হতে দেয়নি কোকাকোলা। ২০১৯ সালে নেটফ্লিক্সের সাথে বহুল জনপ্রিয় 'স্ট্রেঞ্জার থিংস' সিরিজের তৃতীয় মৌসুমের প্রচারের স্বার্থে সীমিত সংখ্যক নতুন কোকের ক্যান ফিরিয়ে এনেছিল কোকাকোলা।
কোকের বিজনেস ইউনিটের তৎকালীন সভাপতি এবং কোকাকোলা উত্তর আমেরিকার বিপণন বিভাগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট স্টুয়ার্ট ক্রোনাজ সে সময় সিএনএনকে জানান, নতুন এই কোকের ফর্মুলা ও রেসিপির জন্য তাদের রীতিমত প্রতিষ্ঠানের আর্কাইভে ঢুঁ মারতে হয়েছিল।
বেভারেজ ডাইজেস্টের সম্পাদক এবং প্রকাশক ডুয়ান স্ট্যানফোর্ড বলেন, "১৯৮৫ সালে কোকাকোলা নতুন কোক বাজারে এনে যে শিক্ষা পেয়েছিল তা হল ... ভোক্তারা সত্যিই এই ধরনের ব্যাপারগুলোর দিকে মনোযোগ দেয়... তবে মানুষকে আপনার ব্র্যান্ড সম্পর্কে ভাবতে দেওয়ার জন্য এটি একটি দুর্দান্ত উপায়"।
পাশাপাশি তিনি এই বলে সতর্ক করে দেন যে, এই বিষয়গুলো যেন বেশিদূর না এগোয় সেটি কোম্পানিকে নিশ্চিত করতে হবে। "আপনি নিশ্চয়ই আপনার সবচেয়ে পুরনো, বিশ্বস্ত ক্রেতাদের হারাতে চান না, তাইনা?"

যা থাকছে কোক জিরো সুগারে
ইতিমধ্যে এই গ্রীষ্মে কোকাকোলার নতুন সংস্করণ কোক জিরো সুগার বাজারে ছেড়েছে কোকাকোলা। কোকাকোলার দাবি, এই নতুন রেসিপির জিরো ক্যালরিযুক্ত কোকের স্বাদ আগের চাইতে অনেক ভালো।
কেউ কেউ 'পজেটিভ রিভিউ' দিলেও তাদের সাথে সুর মেলাতে দেখা যায় নি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা কোকের বেশিরভাগ গ্রাহককে। 'ভাল না', 'বাজে', 'স্বাদহীন' নানানভাবে টুইটারে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন তারা।
উত্তর আমেরিকা কোকাকোলার কর্মকর্তা রাফায়েল প্রানডিনি বলেন, "আমরা জিরো কোকের নিয়মিত ভোক্তা ও যারা ভোক্তা নন উভয় শ্রেণির মানুষের ওপরই নতুন জিরো কোকের স্বাদ নিয়ে জরিপ করেছি, এবং তারা সবাই নতুন স্বাদটি পছন্দ করেছেন। নতুন কোক বাজারে ছাড়ার ব্যাপারে আমরা তাই বেশ উৎসাহী"।
শেষবার ২০১৭ সালে যখন কোম্পানিটি পানীয়ের ফর্মুলা এবং প্যাকেজিং পরিবর্তন করেছিল, তখনও অনেক ভোক্তা হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। তবুও, বাজার গবেষণা সংস্থা ইউরোমনিটর ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী, কোক জিরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লো-ক্যালোরি সোডার বাজারে ঠিকই তার পসার বাড়িয়ে চলেছে।
স্ট্যানফোর্ডের মতেও, প্রকৃতপক্ষে সামাজিক মাধ্যমে সামান্য বিতর্ক উসকে দেয়া কিছুক্ষেত্রে ব্র্যান্ডগুলোর জন্য খারাপ না!
তাছাড়া কোকাকোলা জিরো সুগার এখনও পণ্যটির প্রতিদ্বন্দ্বী পেপসির সংস্করণ থেকে অনেক এগিয়ে। ইউরোমনিটর ইন্টারন্যাশনালের মতে, ২০২০ সালে কোক জিরো সুগার মার্কিন লো-ক্যালোরি সোডার ২১% বাজার দখল করে রেখেছিল। পেপসি জিরো সুগার তালিকায় থাকা শীর্ষ ৫ পণ্যের মধ্যেই জায়গা করে নিতে পারেনি- ডায়েট কোক, ডায়েট পেপসি, চেরি কোক জিরো এবং জেভিয়া ছিল তালিকাতে।
কোক জিরো এবং ডায়েট কোক উভয়ই শূন্য-ক্যালোরিযুক্ত পানীয়, তাহলে এ দুটোর মধ্যে মূল পার্থ্যকটা কোথায়? আসলে ডায়েট কোকের স্বকীয় স্বাদ রয়েছে। অন্যদিকে জিরো কোকের স্বাদ যেন মূল কোকাকোলার আরো কাছাকাছি হয় সে চেষ্টা করা হচ্ছে। কোকাকোলারও এটাই দাবি, নতুন ফর্মুলা অনুযায়ী জিরো কোকের স্বাদ একদম মূল কোকের মতোই হবে।
- সিএনএন অবলম্বনে