ওয়েলনেস ড্রিংক সত্যিই কি মন শান্ত করে?

এক ক্যানেই শান্তি। কয়েক চুমুকেই আরাম।
কিছু কোম্পানি এমনই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তাদের বিশেষ ধরনের পানীয় নিয়ে। এগুলো পরিচিত 'ওয়েলনেস ড্রিংক' নামে। তাদের মতে এইধরণের পানীয় পান করলে মন শান্ত হয়, মেলে প্রশান্তি।
লুসি আর সেরেনা এই পানীয়গুলোর ওপর দারুণ ভরসা করেন। তারা দুজন ভালো বন্ধু। আরও অনেকের মতো তারাও চাকরি, সন্তান আর শরীরচর্চাসহ অনেক কিছু সামলাচ্ছেন।
সেরেনা বলেন, "ওয়েলনেস ড্রিংক আমার সব দুশ্চিন্তা দূর করে দেবে না, কিন্তু যদি একটু সাহায্যও করে, তাহলে সেটাই আমার জন্য যথেষ্ট।"
লুসিও এগুলোকে বেশ কার্যকরী মনে করেন, বিশেষ করে যখন তিনি কিছুটা অস্থির অনুভব করেন।
"যদি কখনো হালকা মানসিক দুশ্চিন্তা কাজ করে, তখন ট্রিপ বা এমন কোনো পানীয় পান করলে আমি আবার স্বাভাবিক হতে পারি।"
কিন্তু সম্প্রতি এই শিল্পের একটি সুপরিচিত ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কারণ বিজ্ঞাপনে দাবি করা হয়েছিল যে তাদের পানীয় মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে। এরপর থেকেই প্রশ্ন উঠছে, এই ধরনের পানীয়গুলো সত্যিই কতটা কার্যকর?
পুষ্টিবিদ ও ডায়েটিশিয়ারা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, পানীয়গুলোতে থাকা সামান্য পরিমাণে সাপ্লিমেন্ট সত্যিই সেইধরণের প্রশান্তির অনুভূতি আনতে পারে কিনা।
একজন মনোবিজ্ঞানী মনে করেন, যখন আমরা নিজেদের জন্য কিছুটা সময় বের করি এবং এমন কিছু করি যা আমাদের কাছে 'বিশেষ কিছু' মনে হয়, তখন আমরা আসলে নিজেরাই নিজেদের শান্তি তৈরি করি।

ওয়েলনেস ড্রিংকের বাজার: আসলে কী আছে এসব বোতলে?
ওয়েলনেস ড্রিংককে 'কার্যকরী পানীয়' বলেও ডাকা হয়। এর অর্থ যেসব পানীয়তে বাড়তি স্বাস্থ্যগুণ আছে বলে দাবি করা হয়। এগুলোর বাজার এখন বেশ রমরমা। একটি বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, গত ১২ মাসে ব্রিটিশ সুপারমার্কেটগুলোতে এই ধরনের পানীয়ের বিক্রি ২৪.৫% বেড়েছে। ওয়ার্ল্ডপ্যানেল বাই নিউমেরেটর বলছে, যুক্তরাজ্যের প্রায় ৩০% পরিবার এখন এই কার্যকরী পানীয়গুলো কেনে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এসব পানীয়ের মধ্যে আসলে কী আছে যা আপনাকে শান্ত হতে বা স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে সাহায্য করে বলে দাবি করা হয়? এখানেই বিষয়টি জটিল হয়ে ওঠে, কারণ প্রতিটি ব্র্যান্ডের পদ্ধতি ভিন্ন।
ট্রিপের 'মাইন্ডফুল ব্লেন্ড' ছাড়াও রিয়েল , গ্রাসঅ্যান্ডকো, গুডরেইজ এবং বিভিন্ন সুপারমার্কেটের নিজস্ব ব্র্যান্ডের পানীয়গুলোতে কিছু নির্দিষ্ট কার্যকর উপাদান থাকার কথা বিজ্ঞাপনে প্রচার করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে:
- লায়ন্স মেন নির্যাস : পূর্ব এশীয় দেশগুলোতে পাওয়া এক ধরনের মাশরুম।
- এল-থিয়ানিন : প্রধানত সবুজ ও কালো চায়ে পাওয়া একটি অ্যামিনো অ্যাসিড।
- অশ্বগন্ধা : এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের কিছু অঞ্চলে চাষ করা একটি ভেষজ।
- ম্যাগনেসিয়াম : মানবদেহের সঠিক কার্যকারিতার জন্য প্রয়োজনীয় একটি খনিজ।
এই উপাদানগুলো সাধারণত অনেক স্বাস্থ্য ও সুস্থতার পণ্যে পাওয়া যায় এবং এগুলোর সঙ্গে মেজাজ ভালো করা, শক্তি বৃদ্ধি, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ানো এবং মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করার সম্পর্ক রয়েছে বলে দাবি করা হয়।
তবে, এই দাবির পেছনে কতটা জোরালো প্রমাণ আছে? বিষয়টি বেশ জটিল, কারণ বিভিন্ন বিশ্বাসযোগ্যতার অনেক গবেষণা রয়েছে, যেখানে কার্যকারিতার ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা দেখানো হয়েছে।
ট্রিপের একটি বিজ্ঞাপনে দাবি করা হয়েছিল যে তাদের উপাদানগুলো মানসিক চাপ ও উদ্বেগ দূর করে। এটি বিজ্ঞাপন মান নিয়ন্ত্রক সংস্থাএর নিয়ম ভঙ্গ করে। তারা রায় দিয়েছে যে, ট্রিপের এই দাবি যে তাদের পানীয় "মানসিক রোগ প্রতিরোধ, চিকিৎসা বা নিরাময়" করতে পারে, তা বাড়াবাড়ি ছিল।
ট্রিপ বিবিসি নিউজকে জানিয়েছে, তারা "অনুরোধ করা পরিবর্তনগুলো" করেছে। তারা আত্মবিশ্বাসী যে তাদের পানীয়ের উপাদানগুলো 'শান্ত' শব্দটি ব্যবহারের অনুমতি দেয়, যা "অনেক ব্র্যান্ড দ্বারা ব্যাপকভাবে এবং আইনত ব্যবহৃত হয়"।
পুষ্টিবিদ রিমা প্যাটেল উদ্বিগ্ন যে, এই পানীয়গুলোতে কার্যকর উপাদানের যে পরিমাণ থাকে, তা সম্ভবত ভোক্তাদের বিজ্ঞাপনে প্রতিশ্রুত মানসিক ভারসাম্য, শান্ত অনুভূতি বা মানসিক চাপ থেকে মুক্তি দিতে পারে না। তিনি লায়ন্স মেন ছত্রাক নিয়ে ক্রমবর্ধমান গবেষণার দিকে ইঙ্গিত করেন, তবে বলেন যে এটি কোনো প্রভাব ফেলতে পারে কিনা সে সম্পর্কে এখনও কোনো চূড়ান্ত ফলাফল পাওয়া যায়নি।
"গবেষণা এখনও একদম প্রাথমিক পর্যায়ে আছে," তিনি বলেন। "সবচেয়ে উন্নত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালগুলোর একটিতে, অল্প সংখ্যক অংশগ্রহণকারীকে ১৮০০ মিলিগ্রাম লায়ন্স মেন দেওয়া হয়েছিল – যা এই পানীয়গুলোর কোনো কোনোটিতে থাকা পরিমাণের চেয়ে অন্তত চার গুণ বেশি।"
গবেষণায় দেখা যায়, নারীরা এই ধরনের উপাদান বেশি গ্রহণ করেন, কিন্তু গবেষণায় তাদের সবসময় সামনে রাখা হয় না। মিসেস প্যাটেল ব্যাখ্যা করেন যে, নারী অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে গবেষণার অভাবের একটি কারণ হলো মাসিকের চক্র এবং হরমোনের ওঠানামা, যা 'পর্যবেক্ষণ করাকে আরও জটিল' করে তোলে।
তবে, তিনি বলেন, এই পানীয়গুলো অ্যালকোহল পান করার একটি ভালো বিকল্প হতে পারে। তার কিছু ক্লায়েন্ট আছেন যারা প্রতিদিন রাতে ওয়াইন বা জিন অ্যান্ড টনিকের পরিবর্তে এই পানীয়গুলোর একটি ক্যান খুলে স্বস্তি পান।
"আমার মনে হয়, এসব পানীয়ের অনেক দাবিকেই সন্দেহের চোখে দেখা উচিত, কিন্তু এগুলো অবশ্যই মানুষকে একটি বিকল্প দিচ্ছে।"

পারফরম্যান্স পুষ্টিবিদ ড. সিনিয়ড রবার্টস বলেন, উপাদানগুলো পার্থক্য তৈরি করতে পারে, তবে সেগুলো নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট কিছু মানুষের জন্য কাজ করে – যেমন অ্যাথলেট বা নির্দিষ্ট কোনো পুষ্টির ঘাটতি থাকা মানুষ, তবে সাধারণ মানুষের জন্য নয়।
ড. রবার্টস বলেন, যদি কেউ এর স্বাদ উপভোগ করেন, "পান করতে পারেন," কিন্তু মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমাতে চাইলে সম্ভবত আপনার কিছু ক্যানের ২ বা ৩ পাউন্ড টাকা বাঁচিয়ে মাসের শেষে একটি "থেরাপি সেশন বা ম্যাসাজের" জন্য রাখা ভালো।
তিনি আরও যোগ করেন, "একটি ওয়েলনেস ড্রিংকের সামান্য লায়ন্স মেন বা অশ্বগন্ধা কোনো পার্থক্য তৈরি করবে না।"
২৫ বছর বয়সী এমিলি মে কয়েক বছর আগে গ্ল্যাস্টনবারিতে প্রথম এই পানীয়গুলো খুঁজে পান। এগুলোর মাধ্যমে প্রশান্তির বিষয়ে তিনি খুব বেশি চিন্তিত নন। তিনি কেবল এর স্বাদ পছন্দ করেন।
"আমার একধরনের মানসিক সমস্যা 'এডিএইচডি' আছে," এমিলি বলেন, "তাই আমাকে শান্ত করার জন্য নিশ্চিতভাবে একটি পানীয়ের চেয়ে আরও অনেক কিছু প্রয়োজন।"
একটি পণ্য আপনাকে শান্ত ও স্থির অনুভূতি দেবে এমন বিজ্ঞাপন করা এবং এই ধরনের পানীয় মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় সাহায্য করবে বলে দাবি করার মধ্যে একটি সূক্ষ্ম রেখা আছে।
মনোবিজ্ঞানী নাতাশা তিওয়ারি বলেন, "সুতরাং আপনি একটি পানীয় কিনেছেন যা, ধরা যাক, বাজারের বিকল্পগুলোর চেয়ে কিছুটা বেশি দামি। তাই আপনি শান্তভাবে বসে এটি খেতে চান," তিনি বলেন ,"আপনি ব্র্যান্ডিং দেখেন, যা বেশ সুন্দর এবং শান্তিদায়ক। ফলে পারিপার্শ্বিক সব কারণ মিলিয়েই আপনার মনে হয় আসলে আপনি যা অনুভব করছেন তা সত্যিই আপনার ব্যস্ত দিনের মধ্যে একটি শান্ত মুহূর্ত। এটা ভুল নয়।"
আর এই শান্তির ছোট্ট মুহূর্তটিই লুসি এবং সেরেনা আকাঙ্ক্ষা করেন – এবং কয়েক মিনিটের জন্য একটি ক্যানের ওয়েলনেস ড্রিংক তাদের সেটি দেয়, বিজ্ঞান তাতে একমত হোক বা না হোক।