টিকা নিতে না চাইলে চাকরি হারাতে পারে রুশ নাগরিকরা

ক্রেমলিনে গিয়ে কাউকে যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন, রাশিয়ায় ভ্যাকসিন নেওয়া একেবারেই কারো ব্যক্তিগত ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে কিনা; কর্তৃপক্ষ আপনাকে হ্যাঁ-সূচক জবাবই দেবে। কিন্তু মস্কোকে এমন এক নীতি প্রণয়ন করতেই হতো যেখানে ভ্যাকসিন নেওয়ার ব্যাপারে জনসাধারণকে সামান্য স্বাধীনতা দেয়া হলেও, ভ্যাকসিন তাদের নিতেই হবে।
টিকাদানের হারের ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত অবিশ্বাস্যরকম পিছিয়ে আছে রাশিয়া। সপ্তাহখানেক আগেই মস্কো ঘোষণা দিয়েছে যে, গৃহস্থালি সেবা থেকে শুরু করে গণপরিবহন পর্যন্ত সব জনসেবামূলক কাজে নিয়োজিত কর্মীদের অন্তত ৬০ শতাংশকে আগামী ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে ভ্যাকসিনের অন্তত একটি ডোজ নিতেই হবে।
তবে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেস্কোভ কিন্তু এখনো বলছেন, 'ভ্যাকসিন নেওয়া এখনো ঐচ্ছিক প্রক্রিয়া।'
কিন্তু পেস্কোভ যখন বলছেন যে কোনো রুশ চাইলেই ভ্যাকসিন নেওয়া প্রত্যাখান করতে পারে; তখন চাকুরীজীবিদের ভয়ের কারণ হচ্ছে, এই প্রত্যাখান তাদের জীবিকা উপার্জনের পথ বন্ধ করে দিতে পারে।
পেস্কোভ বলেন, 'একজন মস্কোবাসী যদি জনসেবা খাতে কাজ করতে চায়, তাকে ভ্যাকসিন নিতেই হবে। আর যদি প্রত্যাখান করে, তাহলে তাকে ওই খাতে কাজ করা ছাড়তে হবে। এরপর সে চাইলে জনসেবা খাতের বাইরে অন্য কিছুতে কাজ করতেই পারে, যেখানে ভ্যাকসিন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকছে না।'
সোমবার পর্যন্ত মস্কোর চিত্রটা ছিল এরকম যে জনসাধারণকে শহরের ক্যাফে বা রেস্টুরেন্টে ঢুকতে হলে টিকা নেওয়ার প্রমাণ ও বিগত ছয় মাসে কোভিড আক্রান্ত হওয়ার নেগেটিভ পিসিআর টেস্টের ফলাফল দেখাতে হচ্ছে।
রাশিয়ার সরকারি কর্তৃপক্ষও দেশে করোনা পরিস্থিতির অবনতির ব্যাপারে নিয়মিত টিভিতে আপডেট ও ব্রিফিং দিয়ে যাচ্ছে। দেশের কোভিড পরিস্থিতির তীব্রতা নিয়ে রুশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও দুশ্চিন্তার চিত্র দেখা গেছে। মস্কো এবং সেন্ট পিটার্সবার্গ, দুই জায়গা থেকেই সোমবার উচ্চ মৃত্যুহার রেকর্ড করা হয়েছে বলে রাশিয়ার অ্যান্টি-করোনাভাইরাস সেন্টার জানিয়েছে।
এই মুহূর্তে ইউরো ২০২০ এর বেশ কিছু ফুটবল ম্যাচ হোস্ট করা সেন্ট পিটার্সবার্গে হাসপাতালের করিডরে পড়ে আছেন রোগীরা। কারণ কোভিড রোগীদের চাপ সামলাতে পারছে না তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা। হাসপাতালগুলোর বাইরে ভর্তিচ্ছু রোগীদের নিয়ে অপেক্ষারত অ্যাম্বুলেন্সের লম্বা লাইন দেখা গেছে।
মিডিয়া এজেন্সি আরআইএ নভোস্তি জানিয়েছে, মস্কোর মেয়র সের্গেই সোবিয়ানিন সোমবার শহরের হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বৃদ্ধির ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। 'গত সপ্তাহ থেকে আমাদের হাসপাতালে, আইসিইউতে করোনা রোগী ভর্তির ও মৃত্যুর সংখ্যায় নতুন রেকর্ড হয়েছে।
বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ২০২০ সালের আগস্টেই করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন স্পুটনিক ভি ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়ার পরেও টিকাদানের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশ পিছিয়ে আছে রাশিয়া।
দেশটির গণমাধ্যমকে দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, সোমবার পর্যন্ত রাশিয়ার ১৪৬ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে ২৬ মিলিয়ন মানুষ অন্তত একটি ডোজ পেয়েছে ভ্যাকসিনের। ভ্যাকসিনের দুটি ডোজই নিয়েছে মাত্র ১৬ দশমিক ৭ মিলিয়ন মানুষ যা দেশের মোট জনসংখ্যার ১১ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে যথাক্রমে ৪৬ শতাংশ ও ৪৮ শতাংশ মানুষ দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সোমবার পর্যন্ত রাশিয়াতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৫,৪৭২,৯৪১ জন এবং মোট মৃত্যু হয়েছে ১৩৩,৮৯৩ জনের। যদিও ধারণা করা হচ্ছে, সত্যিকার মৃত্যুর সংখ্যাআরও বেশি।
কিন্তু মহামারিতে জর্জরিত হওয়ার পরও, জোর করে ভ্যাকসিন দেওয়ার ধারণা রাশিয়াতে অজনপ্রিয়। তবে রুশ সরকার কোনো বাধ্যতামূলক টিকাগ্রহণ স্কিম শুরু করেনি বলে জানালেও; নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শ্রমজীবি মানুষেরা জানিয়েছেন, বোর্ডের পক্ষ থেকে টিকা নেওয়ার জন্য বেশ চাপ ও তাড়া অনুভব করছেন তারা।
মস্কোতে গোর্কি পার্কের বিপরীতে অবস্থিত একটি টিকাদান কেন্দ্রের সামনে গত কয়েক দিন ধরে সকাল ৮টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত টিকা নিতে লাইন ধরতে দেখা গেছে সাধারণ মানুষকে।
শুরুর দিকে রুশ কর্তৃপক্ষ জনসাধারণকে বিনামূল্যে বাস-সার্কাস টিকিট দিয়ে বা খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করে টিকা গ্রহণে আগ্রহী করার চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে তারা খানিকটা কড়া পদক্ষেপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মস্কোতে ভ্যাকসিন না নিলে চাকরি হারাতে পারেন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। নিয়ম মেনে কর্মীদের টিকাদানের ব্যবস্থা না নিলে মালিককেও পড়তে হবে সর্বোচ্চ ৯০ দিন বরখাস্ত হওয়ার ঝুঁকির মুখে।
টিকাগ্রহণের বাধ্যবাধকতা চালু করলেই যে জনরোষের মুখে পড়তে হবে তা যেন মস্কো প্রশাসন আগে থেকেই জানতো। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠকের আলোচনা যখন সরগরম, তার মধ্য দিয়েই টিকাদানের এই ঘোষণা দিয়েছে মস্কো।
গত শনিবার মস্কোর প্রাণকেন্দ্রে, নভোপুশকিনস্কি স্কয়ারে ৫০০ মানুষ প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে 'টিকা গ্রহণে ব্যক্তি স্বাধীনতা' চেয়ে। তারা দাবি করেছে, কোনো রুশ নাগরিক টিকা নেবে কিনা সেটি তার উপরেই ছেড়ে দেওয়া উচিত এবং কর্মীদের চাকরি কেড়ে নেওয়ার ভয় দেখানো বন্ধ করা উচিত।
গত মাসে স্বাধীন পোলস্টার লেভাডা-সেন্টারের করা এক জরিপে এও দেখা গেছে যে ৬২ শতাংশ রুশ নাগরিক স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিন নিতে চান না।
- সূত্র: সিএনএন