কলা নিয়ে রসিকতার জেরে তুরস্ক থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে সিরীয় শরণার্থীদের

ভিডিও প্ল্যাটফর্ম টিকটকে কলা খাওয়ার 'উসকানিমূলক' ভিডিও প্রকাশের অভিযোগে সম্প্রতি তুরস্কে সিরীয় অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
টিকটকে কৌতুকপূর্ণ বিভিন্ন ভিডিওতে কলা খেয়ে দেখাচ্ছেন তুরস্কে থাকা সিরীয় অভিবাসীরা। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া 'বানানা চ্যালেঞ্জ' নামক এসব ভিডিও দেখে সিরীয়দের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ছে তুর্কি নাগরিকেরা।
এমনকি এ ধরনের ভিডিও প্রকাশের জন্য তুর্কি কর্তৃপক্ষ সিরিয়ানদের বিরুদ্ধে 'ঘৃণা উসকে দেওয়ার' অভিযোগ এনেছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন সিরীয়কে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তাদেরকে তুরস্ক থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে।
এমন বৈরী পরিস্থিতিতে তুরস্কের বৃহৎ সিরীয় জনগোষ্ঠীর প্রতি রীতিমত বিভাজনের প্রতীক হয়ে উঠেছে যেন কলা। এর জেরে ক্রমাগত পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে তুর্কি আর সিরীয়দের মধ্যকার সম্পর্কে।
সত্যটা হলো, তুরস্কের অর্থনীতি এই মুহূর্তে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতিতে ভুগছে যার প্রভাব পড়েছে জীবনযাত্রার মানেও। অর্থনীতির জন্য এমন এক ক্রান্তিকালীন সময়ে কলা নিয়ে বানানো এসব ভিডিও আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছে।
কিন্তু হঠাৎ করে কেন কলা খাওয়ার ভিডিও নিয়ে শোরগোল শুরু হলো!

আসলে কয়েক দিন আগে এক তুর্কি নাগরিক বলেন, "সিরিয়ানদের আমি বাজার থেকে কয়েক কেজি করে কলা কিনতে দেখি, অথচ আমি নিজেই কলা কিনে খেতে পারি না"।
তার এই দাবি, তুরস্কের সিরিয়ান শরণার্থীদের মাঝে বিতর্কের সৃষ্টি করে এবং প্রতিবাদের অংশ হিসেবে তারা পাল্টা ভিডিও প্রকাশ করতে থাকলে তা 'ভাইরালে' হয়।
তুর্কি সে নাগরিককে বিদ্রুপ করে সিরীয়রা একের পর এক কলা খাওয়ার ভিডিও, কলা নিয়ে তৈরী ফিল্টার এবং সামাজিক মাধ্যমে 'মিম কনটেন্ট' প্রকাশ করতে থাকে।
অনলাইনে আনন্দের খোরাক জোগালেও সবাই তাদের এই রসিকতাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেনি।
একটি ছবিতে দেখা যায়, তুরস্কের পতাকার জায়গায় কলার ছবি বসিয়ে দেওয়া হয়েছে; ছবিটি ঘিরে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তুরস্কের নবগঠিত জাতীয়তাবাদী ভিক্টরি পার্টি সিরীয় টিকটক ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে 'তুর্কি জনগণ এবং তাদের পতাকাকে অপমান' এর অভিযোগ আনে।
সামাজিক মাধ্যমের অন্যান্য সমালোচকেরা বলছেন, এসব ভিডিও তুরস্কের ধুঁকতে থাকা অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকেই উপহাস করছে।
স্থানীয় গণমাধ্যমের মতে, ভিডিওর মাধ্যমে 'উস্কানি ও ঘৃণা ছড়ানোর' অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার তুর্কি পুলিশ ১১ জন সিরীয় নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছে।
তুর্কি অভিবাসন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পর তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে।
দেশটির অভিবাসন অধিদপ্তর আরও জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে যত ধরনের উস্কানিমূলক ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে, তার সবই সরিয়ে ফেলা হবে। পাশাপাশি যারা এর প্রচারে অংশ নিয়েছে, তাদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সর্বশেষ গত রোববার ইস্তাম্বুলে 'বানানা চ্যালেঞ্জ' নিয়ে টেলিভিশনে প্রতিবেদন করার জন্য সিরিয়ার সাংবাদিক মাজেদ শামাকে গ্রেপ্তার করে তুর্কি কর্তৃপক্ষ।
বেশ ক'জন তুর্কি রাজনীতিবিদ শরণার্থীদের গ্রেপ্তারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। এক টুইট বার্তায় জাতীয়তাবাদী গুড পার্টির ইলে আকসয় বলেছেন, "তারা কলা খাওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদেরকে বিদ্রূপ করেছে এবং আমাদের জাতীয় পতাকার অবমাননা করেছে।"
তবে সংখ্যালঘুপন্থী পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি এই গ্রেপ্তারের ঘটনাকে 'বর্ণবাদী' হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
এদিকে তুরস্কে থাকা সিরিয়ানরা কলা খাওয়ার এসব ভিডিওর পেছনে তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, "না, আমরা তুর্কিদের উপহাস করছি না, আমাদের উপহাস বর্ণবাদের প্রতি। অর্থনৈতিক বিপর্যয় আমাদের সবাইকেই প্রভাবিত করেছে"।
ইস্তাম্বুলে বসবাসরত সিরিয়ান সাংবাদিক দিমা শুলার বিবিসিকে বলেন, এসব ভিডিওর অধিকাংশই নিরীহ গোছের এবং নিছক রসিকতা ছাড়া কিছুই না।
তবে এদের মধ্যে কিছু 'ক্ষতিকর এবং আপত্তিকর' ভিডিও রয়েছে বলেও তিনি জানান।
তুরস্কে রাষ্ট্র, জাতীয় পতাকা এবং রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে অবমাননার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। কলা খাওয়ার ভিডিও নির্মাতাদের এসব আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানা গেছে।
এক দশক ধরে গৃহযুদ্ধে জর্জরিত দেশটিতে তাদের আবারও ফেরত পাঠানো হতে পারে ভেবে রীতিমত শঙ্কিত হয়ে রয়েছেন অনেক সিরীয়।
শুলার বলেন, "কেবল একটি ফেসবুক পোস্টের জেরে সিরীয় কোনো নাগরিককে বের করে দেওয়া হবে- অনেকভাবে এই ঘটনার ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যেতে পারে"।
এভাবে শরণার্থীদের বহিষ্কারকে তুর্কি সরকারের হুমকি ও ভীতি প্রদর্শন হিসেবে দেখেছেন তিনি।
তার মতে, কলা খাওয়া নিয়ে এসব ভিডিও তুরস্কের শরণার্থী সংকট এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় হতে মনোযোগ সরিয়ে দিয়েছে। পরিবর্তে, সবাই এখন টিকটক ভিডিও নিয়ে মেতে আছে।
- সূত্র- বিবিসি