চার বছরের মধ্যেই বার্ষিক বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ২.৫ বিলিয়ন ডলার হবে

আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে বাংলাদেশকে বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল মিলিয়ে প্রতি অর্থবছরে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি পরিশোধ করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের এ ধরনের বেশিরভাগ ঋণের গ্রেস পিরিয়ড চলতি অর্থবছরেই শেষ হচ্ছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং পদ্মা সেতু রেল লিঙ্কের মতো বিদেশি অর্থায়নের মেগাপ্রকল্পগুলি যখন আগামী চার বছরের মধ্যে সুদের পাশাপাশি মূল বা আসলের অর্থপ্রদান শুরু করবে, তখন ঋণ পরিশোধের বোঝা আরও ভারী হবে।
তার ওপর নতুন ঋণ চুক্তির সুদ পরিশোধের ফলে সার্বিক ঋণ পরিশোধের বোঝা বাড়বে।
ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি চাপে থাকবে ২০২৬-২৭ , ২০২৭-২৮, ২০২৮-২৯ অর্থবছরে। কারণ এ তিন অর্থবছরে দেশের ঋণ পরিশোধের পরিমাণ কমপক্ষে ২.৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ- ইআরডি'র একটি প্রতিবেদন অনুসারে, এ ধরনের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ২০৩২-৩৩ অর্থবছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
ইআরডি কর্মকর্তারা বলছেন যে, প্রতি অর্থবছরে বিতরণ বৃদ্ধির সাথে সাথে আসল ও সুদসহ বৈদেশিক ঋণের অর্থপ্রদান বাড়ছে।
২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে, বাংলাদেশ ১ বিলিয়ন ডলার বা তার বেশি পরিমাণের আসল এবং সুদ পরিশোধ করছে, কিন্তু ২০২০-২১ অর্থবছরে এর পরিমাণ ১.৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর বিষয়টি উল্লেখ করেন তারা।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে আরও বেড়েছে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ-- গত মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন উন্নয়ন অংশীদারকে ১.৫৯ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ।
এদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে বিদেশি ঋণের অর্থছাড় ৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ২০২০-২১ বিদেশি ঋণ ছাড় হয়েছে ৭.৪৪ বিলিয়ন ডলার। ক্রমবর্ধমান ঋণ পরিশোধের চাপ নেট বিতরণকেও পতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
ইআরডির সূত্র অনুযায়ী, জুন ২০২১ পর্যন্ত বাংলাদেশের বকেয়া বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৫০.৮৭ বিলিয়ন ডলার, পাইপলাইনে রয়েছে আরও ৪৮ বিলিয়ন ডলার।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ইআরডির বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের হিসাব অতিসরলীকরণ করা হয়েছে, কারণ এটি ইতোমধ্যেই ২ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। কয়েক বছরের মধ্যে কিছু বড় প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হলে এর পরিমাণ আরও বাড়বে।
"পরিশোধ এভাবে বাড়ার সাথে সাথে সে পরিমাণে অর্থছাড় না বাড়লে নেট বৈদেশিক অর্থায়ন কমে যাবে। এতে বাজেটের ওপর চাপ বাড়বে"- উল্লেখ করেন তিনি।
নমনীয় ঋণের পাশপাশি কিছু সরকারি সংস্থা উচ্চ সুদে বৈদেশিক ঋণ নেয়, যা ইআরডির হিসাবের বাইরে রয়েছে। আমাদের এসব ঋণকেও হিসাবের আওতায় আনতে হবে।"
পরিশোধের অঙ্ক লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকায় বিদেশি ঋণ ছাড়করণ দ্রুততর করার পরামর্শও দেন এ অর্থনীতিবিদ।
"আমাদের ভালো প্রকল্প হাতে নিয়ে নমনীয় ঋণের ব্যবহারও বাড়াতে হবে। বর্তমানে, প্রকল্পের প্রস্তুতির অভাবের কারণে আমরা লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এ ধরনের ঋণ নিতে পারছি না," তিনি যোগ করেন।
"যেমন বিশ্বব্যাংকের আইডি-১৯ ঋণ প্যাকেজ থেকে আমাদের এক বিনিয়ন ডলারের কম প্রতিশ্রুতি আদায় হবে বলে শঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় আমাদের নমনীয় ঋণের প্রতিশ্রুতি আদায় এবং অর্থছাড় বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে।"
অনেক বড় প্রকল্প অর্থায়নের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ার পথে
দেশের বৃহত্তম উদ্যোগ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ১০-বছরের গ্রেস পিরিয়ড ২০২৬ সালে শেষ হতে চলেছে। যার অর্থ হলো- সুদের পাশাপাশি আসল পরিশোধ শুরু হবে ২০২৭ সালে৷ বার্ষিক কিস্তিতে ৫৬৫ মিলিয়ন ডলার করে ২০ বছর ধরে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এর আগে ২০১৬ সালে এ প্রকল্পের জন্য রাশিয়ার সাথে ১১.৩৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি সই করে সরকার।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য নেওয়া ঋণ পরিশোধও ২০২৪ সাল থেকে শুরু হবে। মূল পরিমাণ ২৬৮ কোটি ডলার ঋণদাতা চীনকে ফেরত দিতে হবে। এটি পরিশোধে ১৫ বছর সময় লাগবে বাংলাদেশের, যার বার্ষিক কিস্তির পরিমাণ ৫৬৫ মিলিয়ন ডলার।
এছাড়াও, ২০২৫ সাল থেকে "ডিপিডিসি এরিয়ার অধীনে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ" প্রকল্পের জন্য নেওয়া আরও ১ বিলিয়ন ডলার ঋণের আসল অঙ্ক দেশটিকে পরিশোধ করতে হবে।
কর্ণফুলী টানেলের জন্য নেওয়া দুটি চীনা ঋণের আসল চলতি অর্থবছর থেকে পরিশোধ করতে হবে। দুটি ঋণের পরিমাণ ৮০০ মিলিয়ন ডলার, যা ১৫ বছরে পরিশোধ করা হবে।
"বাংলাদেশ প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড ডিজিটাল এন্টাপ্রেনিউরশিপ"প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ৪৬০ মিলিয়ন ইউরোর ঋণের আসল পরিশোধ করতে হবে ২০২৫ সাল থেকে।
এ ধরনের বড় ঋণের বেশ কিছু প্রকল্পের গ্রেস পিরিয়ড খুব শিগগিরই শেষ হবে। বিদেশি ঋণ কার্যকর হওয়ার পরই সুদ এবং অন্যান্য ফি প্রদান শুরু হয়। গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ার পরে আসল অঙ্কের পরিশোধ শুরু হয়।
২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাকে সুদ-আসল মিলিয়ে ২৭.৯ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে। এর মধ্যে আসল ২০.৭ এবং সুদ ৭.২৩ বিলিয়ন ডলার।