ঋণ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা, ভারতীয় এলওসির ১১ প্রকল্প বাদ দেবে বাংলাদেশ

বাংলাদেশকে দেওয়া ভারতের তিনটি ঋণ কর্মসূচি – লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) নিয়ে দুই দেশের মধ্যে নতুন সিদ্ধান্তের ফলে, বর্তমানে এর তালিকায় থাকা ৪০ প্রকল্প থেকে কমপক্ষে ১১টি প্রকল্প বাদ যাবে। অনুমোদন পর্যায়ে থাকা প্রকল্প এবং অনুমোদন হলেও নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি, এমন প্রকল্প এলওসি থেকে বের হয়ে যাবে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তাদের মতে, এর ফলে এলওসির মোট আকার ৭৩৪ কোটি ডলার থেকে হ্রাস পেয়ে হবে ৪৬৮ কোটি ডলার।
পর্যালোচনা সভায় নেওয়া মূল সিদ্ধান্তগুলো
গত ৫ ও ৬ মার্চ দুই দেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত এলওসি পর্যালোচনা সভা থেকে এসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছ। রাজধানীর শেরে বাংলানগরের ইআরডির সম্মেলন কক্ষে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সস্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব মিরানা মাহরুখ এবং ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লাইন অব ক্রেডিটের পরিচালক সুজা কে মেনন— নিজ নিজ দেশের পক্ষে সভায় নেতৃত্ব দেন।
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, এলওসি পর্যালোচনা সভায় যেসব সুপারিশ করা হয়েছে, তা চূড়ান্ত করবে উভয় দেশের সরকার। অতিরিক্ত সচিব মিরানা মাহরুখ বলেন, দুই দিনব্যাপী ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। প্রত্যেকটি এলওসি প্রকল্প যাচাই-বাছাই করে এলওসি র্যাশনালাইজ (যৌক্তিকীকরণ) করার বিষয়ে একমত হয়েছে দুই দেশ।
ভবিষ্যতে ঋণ নীতিতে পরিবর্তন
ভবিষ্যতে ভারতীয় ঋণের নীতির ক্ষেত্রেও পরিবর্তনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে পর্যালোচনা সভায়। ভবিষ্যতে এলওসির আওতায় অ্যামব্রেলা-ভিত্তিক (গুচ্ছ) প্রকল্প নেওয়া হবে না। চলমান প্রকল্পগুলোর অর্থ ছাড় ও বাস্তবায়নে গতি আনার বিষয়েও একমত হয়েছে দুই পক্ষ।
এলওসি বাস্তবায়ন ঘিরে যেসব সমালোচনা ও প্রতিকূলতা
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান– সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ভারতীয় এলওসি ঋণের প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক সময় লাগে। প্রত্যেক এলওসিতে ১৫ - ১৬টা করে প্রকল্প থাকে। ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করতে অনেক সময় নেয় বাংলাদেশ। আবার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অভিযোগ আছে, এতগুলো প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি একসঙ্গে করা সম্ভব না। এখানে সক্ষমতার বিষয় জড়িত। ফলে ভারতীয় প্রকল্পে অর্থছাড় অনেক কম।
তিনি আরও বলেন, আবার কোনো একটা প্রকল্পে ঋণ ছাড় হলেই – ওই প্রকল্প যে এলওসিভুক্ত তার গ্রেস পিরিয়ড ও ঋণ পরিশোধের পিরিয়ড শুরু হয়ে যায়। যা আমাদের ওপর আর্থিক বোঝা হয়ে ওঠে।
তিন এলওসি
২০১০ সালের ৭ আগষ্ট বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রথম ১০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি সই হয়। এবং পরে ২ কোটি ডলার অনুদান ঘোষণা করে ভারত, আর কিছু নতুন ঋণ যোগ হয়ে প্রথম এলওসির আকার দাড়ায় ৮৬ কোটি ২০ লাখ (৮৬২ মিলিয়ন) ডলার। এই এলওসির তালিকায় ১৫টি প্রকল্প নেওয়া হয়। এরমধ্যে ১২টি'র বাস্তবায়ন কাজ শেষ হয়েছে। বাকি তিনটি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রথম এলওসির অর্থছাড় হয়েছে ৭৬ কোটি ৮৭ লাখ (৭৬৮.৭০৫ মিলিয়ন) ডলার।
২০০ কোটি ডলারের দ্বিতীয় এলওসি চুক্তি সই হয় ২০১৬ সালের ৯ মার্চ। দ্বিতীয় এলওসির তালিকায় ১৫টি প্রকল্প নেওয়া হলেও— পরে তিনটি প্রকল্প বাদ যায়। বর্তমানে ১২টি প্রকল্প এই তালিকায় রয়েছে। গত জুন পর্যন্ত দ্বিতীয় ঋণে ছাড় হয়েছে প্রায় ৫১ কোটি ৮৮ লাখ ডলার।
দ্বিতীয় এলওসির দুটি প্রকল্প খুলনা-দর্শনা রেললাইন এবং পার্বতীপুর থেকে কাউনিয়া সেকশন পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ— পর্যালোচনা সভায় এলওসি থেকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
এছাড়া দ্বিতীয় এলওসির তালিকায় থাকা সৈয়দপুরে রেলওয়ে ওয়াকশর্প নির্মাণ, মোংলায় ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন, এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর প্রকল্প এখনো অনুমোদন পর্যায়ে রয়েছে। দুই দেশের এলওসি পর্যালোচনা সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এসব প্রকল্পও তালিকা থেকে বাদ যাবে।
ভারতের সঙ্গে ৪৫০ কোটি ডলারের ততৃীয় এলওসি চুক্তি সই হয় ২০১৭ সালের ৪ অক্টোবর। শুরুতে ১৬টি প্রকল্প থাকলেও,তিন প্রকল্প বাদ দেওয়ার পর বর্তমানে এই এলওসির প্রকল্পের সংখ্যা ১৩টি। এই এলওসির কোনো প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজই শেষ হয়নি। চলমান রয়েছে আট প্রকল্প। এই এলওসির অর্থছাড় হয়েছে প্রায় ৫১ কোটি ৩১ লাখ ডলার।
এর মধ্যে বাস্তবায়ন কাজ শুরুর ৬ বছরেও নির্মাণ কাজে যেতে পারার কারণে কারণে বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জের শহীদ এম. মনসুর আলী স্টেশন পর্যন্ত ডুয়েল গজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প এলওসি তালিকা থেকে বাদ যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এছাড়া অনুমোদন পর্যায়ে থাকা পাঁচটি প্রকল্প তৃতীয় এলওসি থেকে বাদ যাচ্ছে, এরমধ্যে আছে সৈয়দপুর বিমানবন্দর নির্মাণ, পায়রা পোর্ট মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণসহ অন্যান্য প্রকল্প।
প্রকল্প বাদ দেওয়ার কারণ
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, অনেক প্রকল্প নিয়ে প্রতিটি এলওসি চুক্তি সই হওয়ার— ফলে প্রকল্পের যথাযথ প্রস্তুতি থাকে না। প্রায়ই এলওসি চুক্তির পরই প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়, তার আগে দীর্ঘ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করতে হয়।
চুক্তি সই হলেও প্রকল্প বাস্তবায়নে যেতে পারে না। প্রকল্পের অনুমোদন প্রক্রিয়ায় অনেক সময় চলে যায়। এরমধ্যে অনুমোদনের পর্যায়েও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বারবার সম্মতি নিতে হয়।
প্রকল্প অনুমোদনের পর চুক্তির নিয়ম অনুযায়ী, ভারতীয় পরামর্শক নিয়োগ নিতে হয়। এই নিয়োগ প্রক্রিয়াতেও ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের সম্মতি নিতে হয় বিভিন্ন পর্যায়ে। এতে সময়ক্ষেপণে দেখা যায়, প্রকল্পের মূল মেয়াদই শেষ হয়ে যায়।
এলওসি চুক্তি অনুযায়ী ভারতীয় ঠিকাদরাই দরপত্রে অংশগ্রহণ করতে পারে। এতে দেখায় নির্ধারিত মূল্যে নির্মাণ ঠিকাদার পাওয়া যায় না।
আবার বাস্তবায়ন পর্যায়ে ভারতীয় ঠিকাদারদের দায়িত্বে অবহেলা দেখা যায়। এতেও প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজে বিলম্ব হয়। এসব কারণে ভারতীয় প্রকল্পগুলো নিয়ে জটিলতায় পড়তে হয় বলে বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা জানান।
ঋণ পরিশোধ ও শর্ত নিয়ে যেখানে উদ্বেগ
পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক সচিব মো. মামুন -আল- রশিদ টিবিএসকে বলেন, ভারতীয় এলওসি ঋণের প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আবার এর ফলে সরকারি তহবিলের অর্থের অপচয় হচ্ছে। তাই এর থেকে বের হওয়া আমাদের জন্য মঙ্গলজনক।
তিনি বলেন, ভারতীয় ঋণের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে বিলম্ব হওয়ার মূল কারণ হলো- বিভিন্ন পর্যায়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সম্মতি আদায়ে সময়ক্ষেপণ হওয়া। আমব্রেলা প্রকল্পে কারণে ভারতীয় ঋণের প্রকল্পে— গ্রেস পিরিয়ড ও ঋণ পরিশোধের সময়ও পাওয়া যায় না।
অন্যদিকে ঠিকাদার ও পণ্য সামগ্রী ভারতের থেকে নেওয়া বাধ্যতামূলক।
এলওসি চুক্তি অনুযায়ী, ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ এলওসি ঋণ পরিশোধ করতে বাংলাদেশ সময় পাবে ২০ বছর। তবে কোনো একটি এলওসির প্রথম অর্থছাড় থেকেই গ্রেস পিরিয়ড ও পরিশোধ শুরু হয়ে যায়। ফলে এলওসির বেশিরভাগ ঋণের পরিশোধের সময় খুবই কম পাচ্ছে বাংলাদেশ।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, দ্বিতীয় এলওসির প্রথম অর্থছাড় অনুযায়ী, ঋণ পরিশোধের সময় শেষ হবে ২০৩৮ সালের ৯ অক্টোবর। ২০ বছরের পরিশোধ সময়ের মধ্যে ইতোমধ্যে ৫ বছর সময় চলে গেছে। কিন্তু, এপর্যন্ত ২০০ কোটি ডলারের সামান্যই (৫১ কোটি ৮৮ লাখ ডলার) ছাড় হয়েছে।
তৃতীয় এলওসির ঋণ পরিশোধ নিয়েও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ। কোনো প্রকল্পের কাজ শেষ না হলেও— সুদ, আসল ও কমিটমেন্ট ফি দিতে হচ্ছে সরকারকে।
চুক্তিতে ঋণ পরিশোধের সমস্যা
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে সই হওয়া তৃতীয় এলওসির তালিকাভুক্ত ১৩ প্রকল্পের কোনটিই শেষ হয়নি। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত তৃতীয় এলওসির অর্থ ছাড় হয়েছে মাত্র ৫১ কোটি ৩১ লাখ ডলার।
এরমধ্যে ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ায় আসল পরিশোধ দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। আসলের সঙ্গে সুদ ও কমিটমেন্ট ফি বাবদ সরকার ইতোমধ্যে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ (১৩ মিলিয়ন) ডলার পরিশোধ করেছে।
এ অবস্থায় তৃতীয় এলওসির কোনো অর্থ যদি এখন ছাড় হয়, তাহলে ঋণের গ্রেস পিরিয়ডের সুবিধা পাওয়া যাবে না, আবার ঋণ পরিশোধেও ২০ বছরের কম সময় পাবে বাংলাদেশ।
টেকনিক্যাল কমিটি
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, এলওসি থেকে যেসব প্রকল্প বের হবে— তা আরো যাচাই-বাছাইয়ে দুই দেশের একটি কারিগরি কমিটি কাজ করবে। যেমন কিছু প্রকল্পে বাস্তবায়ন শুরু হলেও— পরামর্শক নিয়োগসহ বিভিন্ন কারণে নির্মাণ কাজ শুরু করা যায়নি। সম্ভাব্য সমাধান বের করতে এসব প্রকল্প আরও বিশদ পর্যালোচনা করা হবে। এক্ষেত্রে ইআরডি, ভারতীয় হাইকমিশন, ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের প্রতিনিধি এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো এই টেকনিক্যাল কমিটিতে থাকবে।
তাঁরা বলেন, এলওসির বিদ্যমান ফ্রেমওয়ার্ক পর্যালোচনা করবে এই কমিটি, এবং এক্সিট পলিসিও খুঁজে বের করবে।
ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) প্রকল্পে ৭৫ শতাংশ পণ্য ভারত থেকে কেনার বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে দেওয়ার বিষয়ে দুই দেশ একমত পোষণ করেছে এলওসি পর্যালোচনা সভায়। তবে কোনো নির্মাণ প্রকল্পে ভারত থেকে পণ্য আনার বাধ্যবাধকতা কমিয়ে ৬৫ শতাংশ করা হয়।
পর্যালোচনা সভায় এই শর্ত আরো শিথিল করার বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছে ভারত। তবে এটা হবে প্রকল্প-ভেদে। যেমন মিরসরাইয়ে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ প্রকল্পে ৯০ শতাংশ পণ্য বাংলাদেশ থেকে, এবং ১০ শতাংশ পণ্য ভারত থেকে আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।