রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ পরিশোধের সমস্যা কাটছেই না

রাশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের সুদ ও অন্যান্য বিল পরিশোধে আবারও প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছে বাংলাদেশ।
এই প্রকল্পের তত্ত্বাবধানকারী রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত পারমাণবিক সংস্থা রোসাটমের একটি সহযোগী সংস্থা অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট ২০২২ সালে সোনালী ব্যাংকে একটি হিসাব খোলে। রাশিয়ার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর এই ব্যাংক হিসাব খোলার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করা এবং সাব-কন্ট্রাক্টরদের বিল পরিশোধ করা।
অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট বাংলাদেশি সাবকন্ট্রাক্টরদের সোনালী ব্যাংকের হিসাবের মাধ্যমে বিল দিতে পারলেও— বিদেশি সাব-কন্ট্রাক্টরদের জন্য তহবিল স্থানান্তর করতে পারছে না, বা তাদের বৈদেশিক হিসাবের মাধ্যমেও দিতে পারছে না।
নিষেধাজ্ঞার কারণে লেনদেনে বাধা
অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট সম্প্রতি মিশরে তাদের ব্যাংক হিসাবে এক লাখ ডলার, এবং সাব-কন্ট্রাক্টর রইন ওয়ার্ল্ডকে ২.০৩৮ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে বলে। এছাড়া, স্থানীয় চার ঠিকাদারকে ৫.০১৮ মিলিয়ন ডলার পরিশোধের অনুরোধও করে।
প্রকল্পের সাব-কন্ট্রাক্টর ও স্পেনের কোম্পানি রইন ওয়ার্ল্ডকে দেওয়ার জন্য তখন ২ মিলিয়ন ডলার স্থানান্তরের চেষ্টাও করে সোনালী ব্যাংক। কিন্তু, এই লেনদেন ব্লক করে তহবিল আবার ফেরত পাঠানো হয় সোনালী ব্যাংককে।
সোনালী ব্যাংকের নস্ট্রো একাউন্ট রয়েছে নিউইয়র্কের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে। সোনালী ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে পাঠানো একাধিক চিঠি অনুযায়ী, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে সোনালী ব্যাংকের নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট পরিচালনাকারী নিউইয়র্কের ব্যাংকটি সুইফট এর মাধ্যমে পেমেন্ট বন্ধ করে দিয়েছে।
সোনালী ব্যাংক সুইফট ব্যবহার করে এই লেনদেন করার সম্ভাব্য ঝুঁকি, বা নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করার ঝুঁকি সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংককে আগেই জানিয়েছিল। তবে রূপপুর প্রকল্পটির রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনা করে 'টেস্ট বেসিসে' এই পেমেন্ট করার জন্য সোনালী ব্যাংককে নির্দেশ দেন অর্থ উপদেষ্টা।
সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কে স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে এই পেমেন্ট পাঠানো হয়। স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক তখন পেমেন্টটি কার্যকর না করে এই অর্থ কেন পাঠানো হচ্ছে, এবং অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট এর ট্যাক্স আইডি নম্বর, এই লেনদেনের সহায়ক নথিপত্র ৫ কার্যদিবসের মধ্যে জানাতে সোনালী ব্যাংককে অনুরোধ করে। সে অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংক সকল নথিপত্র স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে পাঠায়। এর পরে গত সোমবার ১৭ মার্চ স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক এক ই-মেইলে সোনালী ব্যাংককে জানিয়েছে, নিষেধাজ্ঞার কারণে তাদের পক্ষে এই লেনদেন করা সম্ভব নয়।
মূলত এসব সমস্যার কারণে, কয়েক বছর ধরেই ঋণের কিস্তি রাশিয়ার ভিইবি.আরএফ ব্যাংককে সরাসরি পরিশোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ।
সোনালী ব্যাংক স্থানীয় সাব-কন্ট্রাক্টদের বিল দিতে পারলেও— রইন ওয়ার্ল্ডের বিল না দিতে পারায়, পরে মিশরেও পেমেন্ট না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
লেনদেনের পূর্বে সোনালী ব্যাংকের উদ্বেগ
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শওকত আলী খান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি দিয়ে জানান যে, রইন ওয়ার্ল্ড এর অ্যাকাউন্টে ডলার জমা করার জন্য সুইফট ম্যাসেজ পাঠালে— সেটি সোনালী ব্যাংকের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় পড়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
সোনালী ব্যাংকের এমডি তার চিঠিতে বলেছেন, বৈদেশিক মুদ্রায় দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং (এএমএল) ও কমন ইক্যুইটি টিয়ার (সিইটি) স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করার শর্ত রয়েছে। অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট যে লেনদেন কার্যকর করতে বলেছে, সেখানে আলটিমেট বেনিফিসিয়াল ওনার (ইউবিও) বিষয়ে অষ্পষ্টতা রয়েছে। ফলে সোনালী ব্যাংকের পক্ষে এই লেনদেন করা সম্ভবপর নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, রূপপুর প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ক্রস বর্ডার লেনদেন সোনালী ব্যাংকের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে এধরনের লেনদেন কার্যকর করা হলে, সোনালী ব্যাংকের সাথে অন্যান্য করসপন্ডিং ব্যাংকের সম্পর্ক বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। যাতে সার্বিক ব্যাংকিং তথা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এরপর গত ২৬ ফেব্রুয়ারি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে বিল পরিশোধ নিয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সরকার ও ব্যাংক খাতের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংক সুইফটের মাধ্যমে এ লেনদেন করার সম্ভাব্য ঝুঁকি ওই সভায় তুলে ধরলেও— 'টেস্ট বেসিসে' এই পেমেন্ট করার জন্য সোনালী ব্যাংককে নির্দেশ দেন অর্থ উপদেষ্টা।
রূপপুর প্রকল্পের ঋণচুক্তি
২০১১ সালের ২ নভেম্বর, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়া সরকারের সাথে ইন্টার-গভর্মেন্ট ক্রেডিট এগ্রিমেন্ট (আইজিসিএ) সই করে বাংলাদেশ সরকার। চুক্তি অনুযায়ী প্রকল্পটির ব্যয় ১২.৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার ৯০ শতাংশ অর্থাৎ ১১.৩৮ বিলিয়ন ডলার রাশিয়া সরকার বাংলাদেশকে ঋণ দেবে।
আইজিসিএ'র অধীনে আর্থিক লেনদেন বা ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সোনালী ব্যাংক ও রাশিয়ান সরকারের পক্ষে ভিইবি.আরএফ ব্যাংককে নির্ধারণ করা হয়। সে অনুযায়ী, এই দুই ব্যাংক ২০১৭ সালের ২৬ জুলাই আন্তঃব্যাংক চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে রূপপুরের প্রয়োজনীয় মালামাল আমদানির এলসি খোলে।
কিন্তু, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ভিইবি.আরএফ ব্যাংক এবং রোসাটমের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধে জটিলতা তৈরি হয়। । পরে অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট এর নামে সোনালী ব্যাংকে একটি এফসি অ্যাকাউন্ট (বৈদেশিক মুদ্রা হিসাব) খোলা হয়। যার মাধ্যমে স্থানীয় সাব-কন্ট্রাক্টরদের এপর্যন্ত ১৮৩.৯৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। আর ভিইবি.আরএফ ব্যাংকের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আগে ২২টি কিস্তিতে ১. ০৭৪ বিলিয়ন ডলার রাশিয়াকে পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ সরকার।
ঋণ পরিশোধে বিদ্যমান প্রতিকূলতা
প্রকল্পের আর্থিক লেনদেনে সংশ্লিষ্ট রাশিয়ান পক্ষের ব্যাংকের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকায়— এই প্রকল্পের জন্য রাশিয়ার ঋণ পরিশোধ করাটা এক চ্যালেঞ্জ হিসেবেই রয়ে গেছে। ফলে বাংলাদেশ তার ঋণ প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারছে না।
গত বছরের ডিসেম্বরে এনিয়ে বাংলাদেশ ও রাশিয়া একটি সমাধানমূলক সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংকে রাশিয়ান সরকার বা তার প্রতিনিধির নামে অ্যাকাউন্ট খুলে বকেয়া অর্থ জমা করা হবে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এই প্রকল্পে রাশিয়ার ১১.৩৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ ছাড় করার কথা ছিল। কিন্তু করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে প্রকল্পটি লক্ষ্য অনুযায়ী এগোয়নি। ঋণের অর্থও পুরেপুরি নিতে পারেনি বাংলাদেশ সরকার। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ ছাড় করেছে রাশিয়া। ঋণের বাকি অর্থ ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছাড় করার বিষয়ে দুই দেশ সম্মত হয়েছে। যদিও এ বিষয়ে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়নি।
বর্তমানে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বাবদ ইতিমধ্যে রাশিয়ার ছাড় করা ঋণের সুদ ও অন্যান্য চার্জ মিলিয়ে বাংলাদেশের কাছে রাশিয়ার পাওনা দাঁড়িয়েছে এক বিলিয়ন ডলার। যা এ প্রকল্পকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট আর্থিক জটিলতাকে আরও বাড়িয়েছে।