ইউনূসের চীন সফরে স্বাক্ষর হতে পারে ১৩৮ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি

সরকার আশা করছে, প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের আসন্ন চীন সফরের সময় বেইজিংয়ের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে, যার আওতায় বাংলাদেশ ১ বিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ১৩৮ মিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা) অনুদান পাবে। এই অর্থ যৌথভাবে নির্বাচিত প্রকল্পগুলোর জন্য ব্যবহার করা হবে, যার মধ্যে একটি বিশ্বমানের হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনাও রয়েছে।
গত জুলাইয়ে চীন সফরের সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনার পর বেইজিং এই অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে গত আগস্টে তার পতনের পর থেকে এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি।
ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই অনুদান নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টার সম্মতির জন্য চুক্তির একটি সারসংক্ষেপ পাঠিয়েছে। অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস ২৬ মার্চ চীনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। তিনি দক্ষিণ চীনের হাইনান প্রদেশে অনুষ্ঠিতব্য বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া (বিএফএ) বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেবেন এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন।
সূত্র জানায়, সফরের মূল লক্ষ্য চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করা। বৈঠকে ইউনূস চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করবেন, যার মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় একটি চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, বাংলাদেশ-চীন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) এবং বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর নিয়ে আলোচনা শুরু করা।
এছাড়া, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে চীনা বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা এবং আসিয়ান-এ (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট) বাংলাদেশের যোগদানের বিষয়েও আলোচনা হতে পারে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোহাম্মদ তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, ২৮ মার্চ চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এ সময় দুই দেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে।
ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন আশা প্রকাশ করেছেন যে ইউনূসের সফর অত্যন্ত সফল হবে এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা আসতে পারে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১৩৮ মিলিয়ন ডলারের অনুদানের একটি অংশ দিয়ে বাংলাদেশে ৫০০ থেকে ১,০০০ শয্যার একটি আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণ করার বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে। হাসপাতালটি এমনভাবে গড়ে তোলা হবে, যাতে বিদেশে চিকিৎসার জন্য রোগীদের যাওয়া কমে আসে এবং দেশেই উন্নত চিকিৎসার সুযোগ নিশ্চিত হয়।
হাসপাতালের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঢাকার উত্তরা ও মিরপুর এবং চট্টগ্রামের একটি এলাকা প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করেছে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের চীন সফরের সময় এ বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। মূলত ভারতীয় ভিসা পেতে বাংলাদেশি রোগীদের অসুবিধার কারণে চিকিৎসার বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সফরের সময় চীন বাংলাদেশে একটি উচ্চতর চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। চীনা অনুদানের একটি অংশ এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণেও ব্যয় হতে পারে।
চীনের সঙ্গে গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্কের লক্ষ্য বাংলাদেশের
বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চাইছে। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং চীন থেকে বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করাকে সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)।
আনোয়ারায় অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের বিষয়ে দীর্ঘদিন আলোচনা চললেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। আশা করা হচ্ছে, প্রধান উপদেষ্টার সফরের সময় একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হতে পারে, যার মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির পরিবর্তে চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ কর্পোরেশনকে দেওয়া হতে পারে।
বাংলাদেশ রপ্তানিমুখী শিল্প ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে চীনা বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে চায়। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্কের কারণে চীনা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মধ্যে আলোচনা হতে পারে।
সফরের আগে চীন বাংলাদেশকে দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তির একটি সংশোধিত খসড়া পাঠিয়েছে। 'দ্য এনকারেজমেন্ট অ্যান্ড রেসিপ্রোকাল প্রোটেকশন অব ইনভেস্টমেন্ট' শীর্ষক মূল চুক্তিটি ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এবার চীন এর হালনাগাদ সংস্করণ চূড়ান্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে, যা সফরের আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে।
২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পরও বাংলাদেশ যেন এশীয় বাজারে শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুবিধা বজায় রাখতে পারে, সে লক্ষ্যে দেশটি গত বছর আসিয়ান ও রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি)-এ অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করেছিল। তবে এখনো কোনো পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া মেলেনি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বৈঠকে আসিয়ান ও আরসিইপি-এ বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির জন্য চীনের সহযোগিতা চাওয়া হতে পারে। পাশাপাশি, বেইজিং বাংলাদেশ-চীন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়ে আলোচনা শুরুর প্রস্তাব দিতে পারে। ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার শেষ চীন সফরের সময় এফটিএ আলোচনা শুরুর বিষয়ে চুক্তি হলেও এখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সূত্র জানিয়েছে, শেখ হাসিনার সফরের সময় চীনের কাছে ১২টি প্রকল্পে অর্থায়নের প্রস্তাব করা হলেও তখন অগ্রগতি হয়নি। এবার সেই প্রকল্পগুলোর কয়েকটি আলোচনায় আসতে পারে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ চুক্তি হয়নি। চলতি অর্থবছরেও চীনের সঙ্গে নতুন কোনো ঋণচুক্তির সম্ভাবনা নেই। সর্বশেষ ঋণচুক্তি ২০২৩ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সেটি ছিল রাজশাহী ওয়াসার সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট প্রকল্পের জন্য ২৭৬.২৫ মিলিয়ন ডলারের।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টার সফরের সময় চীনের সঙ্গে নতুন প্রকল্পের ঋণ চুক্তি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এর মধ্যে চারটি জাহাজ কেনার জন্য ২৫০ মিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি এবং মংলা বন্দরের সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের জন্য ৩৫৩.৫২ মিলিয়ন ডলারের ঋণ আলোচনায় থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।