দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রে আবদুল মোনেম অর্থনৈতিক অঞ্চল
উপযুক্ত অবস্থান, নদী সংযোগ, পরিবেশবান্ধবতা, প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধার সহজলভ্যতাসহ নানা ধরনের আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যের কল্যাণে বেসরকারি আবদুল মোনেম অর্থনৈতিক অঞ্চল দেশ-বিদেশের বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীর তীর ঘেঁষে প্রায় ৩৫০ একর জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে এই অর্থনৈতিক অঞ্চল। এখানে কারখানা স্থাপন করার জন্য চুক্তি করছে যুক্তরাষ্ট্রের হান্টসম্যান করপোরেশন।
ইতোমধ্যেই এখানে জাপানের হোন্ডা মোটর করপোরেশনের বড় একটি কারখানা রয়েছে, যেখানে মোটরসাইকেল উৎপাদন করা হচ্ছে।
এছাড়া তুরস্কের হোম অ্যাপ্লায়ান্স জায়ান্ট আরচেলিকসহ আরও কিছু কোম্পানির বিনিয়োগের বিষয়টিও পাইপলাইনে রয়েছে বলে জানিয়েছে অর্থনৈতিক জোনটির কর্তৃপক্ষ।
আবদুল মোমেন ইকোনমিক জোন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এ এস এম মাইনুদ্দিন মোমেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "হান্টসম্যান করপোরেশন প্রথমে বন্ডেড ওয়্যার হাউস স্থাপন করবে। ওয়ারহাউজ করার পর যত দ্রুত বন্ডেড ফ্যাসিলিটি পাবে তত দ্রুত তারা ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্ট বানিয়ে ফেলবে। এর জন্য নকশাও তৈরি করে ফেলেছে।"
তিনি জানান, হান্টসম্যান বস্ত্রখাতে ব্যবহার্য রাসায়নিক উৎপাদন করবে। তারা পাঁচ একর জমি ইজারা নিয়েছে। শুরুতে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ হবে ২০ মিলিয়ন ডলার। মাইনুদ্দিনের মতে, একবার এ কারখানাটির কার্যক্রম শুরু হলে স্থানীয় আরএমজি উৎপাদনকারীরা খুবই উপকৃত হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশ বস্ত্রখাতে ব্যবহার্য রাসায়নিক চীন, ভারত এবং অন্য কয়েকটি দেশ থেকে আমদানি করে থাকে।
"স্থানীয়ভাবে পোশাক খাতের রাসায়নিকের সহজলভ্যতার ফলে পোশাক রপ্তানিতে লিড টাইম কমে যাবে," মাইনুদ্দিন যোগ করেন।
তুরস্কের আরচেলিক, প্রাইম টেক্সটাইল এবং বসুন্ধরাও এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা স্থাপনের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। শুধু ওয়ালটনই ১০০ একর জমি চাচ্ছে ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনের জন্য।
"আমরা দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবগুলো যাচাই করে দেখছি। জোনটি পুরোপুরি চালু হলে ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। এখানে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের এক বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ আশা করছি আমরা।"
আরচেলিকের বিনিয়োগে আগ্রহ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি সিঙ্গার বাংলাদেশ এর ৫৭ শতাংশ মালিকানা কিনে নিয়েছে আরচেলিক। তারা হোম অ্যাপ্লায়েন্স তৈরি করতে চায়।"
সম্প্রতি অর্থনৈতিক অঞ্চলটি সরেজমিনে পরিদর্শন করতে গিয়ে এই প্রতিবেদক দেখতে পান, সর্বমোট ৩৫০ একর জায়গার মধ্যে ২০০ একরকেই গড়ে তোলা হয়েছে কারখানা নির্মাণের উপযোগী করে।
নিজেদের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাবার লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষ প্রস্তুত একটি পাওয়ারপ্ল্যান্ট বানাতেও। জেটি স্থাপন করে নদী সংযোগকে কাজে লাগানো এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য একটি সিস্টেম গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও তারা কাজ এগিয়ে রেখেছে। এছাড়া এখানে একটি সোলার পাওয়ার গ্রিডও নির্মাণ করা হবে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাজধানী ঢাকা থেকে ৩৭ কিলোমিটার দূরে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে অবস্থিত অর্থনৈতিক অঞ্চলটিকে ৫,০০০ কোটি টাকা বাজেটে একটি গ্রিন ইকোনমিক জোন হিসেবে তৈরি করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) মোটর পার্ট সংযোজন, খাদ্য ও পানীয় উৎপাদন, এবং লাইটইঞ্জিনিয়ারিং, প্যাকেজিং ও রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদনের জন্য ২০১৭ সালে এ অঞ্চলটির অনুমোদন দেয়।
মাইনুদ্দিন মোনেম টিবিএসকে বলেন, "আমরা আশা করছি আগামী দুই বছরের মধ্যে গোটা অর্থনৈতিক অঞ্চলটির নির্মাণকাজ শেষ হয়ে যাবে।"
বাংলাদেশ ও জাপানের যৌথ উদ্যোগে গঠিত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ হোন্ডা প্রাইভেট লিমিটেড (বিএইচএল) মোটরসাইকেল উৎপাদনে কারখানা স্থাপন করেছে এখানে। তারা প্রাথমিকভাবে অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি, সুযোগ সুবিধা এবং ২৫ একর জমির পেছনে ২৩০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে।
বর্তমানে কারখানাটির বছরে ১ লাখ মোটরসাইকেল তৈরির সক্ষমতা রয়েছে। এখানে ৮০০ জন শ্রমিক কাজ করছে।
মাইনুদ্দিন মোনেম বলেন, "হোন্ডা দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও ১০ একর জমি নিয়েছে। আমার ধারণা আগামী ৫ বছরে হোন্ডা এখানে বছরে ২ লাখ মোটরসাইকেল উৎপাদন করার সক্ষমতা হবে। তখন তাদের ৫০ একর জমি লাগবে।"মোটর
আবদুল মোনেম অর্থনৈতিক অঞ্চল দেশের বিদ্যমান ১১টি বেসরকারিভাবে পরিচালিত অর্থনৈতিক অঞ্চলের একটি। বেজা ২০৩০ সালের মধ্যে দেসজুড়ে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
বেজার লক্ষ্য ১ কোটি মানুষের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করা। এছাড়াও তারা এসব অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে প্রতি বছর ৪০ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির আশা করছে।
বিনিয়োগকারীরা এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে ট্যাক্স হলিডে, কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির শুল্কমুক্ত আমদানি, লভ্যাংশ কর মওকুফ, ভ্যাটমুক্ত বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাবে।
এছাড়া তারা আরও বেশ কিছু অনর্থনৈতিক সুবিধা, যেমন বন্ড সুবিধা, লগ্নিকৃত বিনিয়োগ তুলে নেওয়া, আনলিমিটেড টেলিফোনিক ট্রান্সফার ও পৃথক কাস্টম প্রক্রিয়াও উপভোগ করতে পারবে।
এসব গতানুগতিক সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি আবদুল মোনেম অর্থনৈতিক অঞ্চলের কিছু আলাদা সুবিধাও রয়েছে। যেমন এটি রাজধানী থেকে খুব কাছে, এবং গুরুত্বপূর্ণ মেঘনা নদী সংলগ্ন।
তাছাড়া যাত্রার একদম শুরুর দিকেই জাপানি বিনিয়োগের ফলে এ অঞ্চলের প্রতি অন্যদের আস্থার পারদও বেড়ে গেছে।
