কৃষকরা বিরূপ জলবায়ুর ক্ষতিপূরণ পাওয়ায় কৃষি বিমার প্রসার বাড়ছে

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার কৃষক ইউসুফ আলী গত বছর ৩ বিঘা জমিতে আলু আবাদের বিপরীতে ৫০ দিন মেয়াদি বিমা করেছিলেন। এজন্য বিমা কোম্পানিকে দিতে হয়েছিল ৩ হাজার ৬০০ টাকা। দুর্ভাগ্যবশত হঠাৎ করে শীতের তীব্রতা বাড়ায় তার জমির ফসল নষ্ট হয়। কিন্তু, বিমার আওতায় আবহাওয়া জনিত লোকসান থেকে সুরক্ষিত ছিলেন ইউসুফ। কোনোপ্রকার ঝঞ্ঝাট ছাড়াই এ ক্ষতির কারণে তিনি ৯ হাজার ২৩৭ টাকা বিমা দাবি পেয়েছেন।
ইউসুফ আসলে মোট ২২ বিঘা জমিতে আলু আবাদ করেছিলেন। তিনি বিমা কোম্পানির কাছ থেকে আলু চাষ সম্পর্কিত নিয়মিত পরামর্শ পেয়েছেন, এসব জ্ঞান তিনি নিজের সম্পূর্ণ আবাদি জমিতেই প্রয়োগ করেন। ফলে শেষপর্যন্ত বড় লোকসান থেকেও রক্ষা পান।
শিলাবৃষ্টি, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অতিরিক্ত বৃষ্টি, খরা ইত্যাদি প্রাকৃতিক কারণে ফসলের যে ক্ষতিসাধন হয়- তা পূরণের জন্য দীর্ঘদিনের প্রয়োজন ছিল এ সংক্রান্ত বিমার। এ সেবা আসায় কৃষকের দুর্দশা অনেকটা লাঘব হয়েছে, তারা চাষাবাদের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করতে সহযোগিতা পাচ্ছেন।
কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় ২০১৮ সালে সিনজেনটা ফাউন্ডেশন 'সুরক্ষা' নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে। এর আওতায় আছে অন্তত ১৯টি বিমাপণ্য; যা অনেক কৃষককে তাদের আমন ও বোরো ধান, আলু, ভুট্টা ও শিম শস্যের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাণিজ্যিকভাবে সুরক্ষা দিয়েছে।
সিনজেনটা ফাউন্ডেশন এবং বিমা কোম্পানিগুলোর সূত্রমতে, সাধারণ বীমা কর্পোরেশন ও গ্রিন ডেল্টা ইন্সুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড ২০১৯ অর্থবছরে মাত্র ১ হাজার ৫২৬টি কৃষি বিমা পলিসি বিক্রি করে। কিন্তু মাত্র চার বছরের ব্যবধানে তা এখন ২ লাখ ১৪ হাজার ৮৩৬টিতে পৌঁছে গেছে।
বিমাকারী কৃষকরা প্রতি সপ্তাহে ফোনে আবহাওয়ার পূর্বাভাস, আগাম সতর্কতা এবং কৃষি-পরামর্শ পরিষেবা পান। আর বিমা দাবি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রেও তাদের কোনো দাবি উত্থাপন করতে হয় না। বরং পুরো প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হয়।
জলবায়ুর খারাপ অবস্থা নির্দিষ্ট সুচকে পৌঁছালেই একজন কৃষক বিমা কোম্পানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ দাবির অধিকারী হন। যেমন একটি পলিসির শর্তানুযায়ী, তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে টানা ৭২ ঘন্টা থাকলে এবং আর্দ্রতা ৮৫ শতাংশের বেশি হলে তারা ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারেন।
ইউসুফ আলী জানান, "আসলে আবহাওয়ার এই অবস্থা তৈরি হলে তা আলুর ফলনের জন্য ক্ষতিকর। এজন্যই আমি বীমা দাবি পেয়েছি।"
সুরক্ষা প্রকল্পে মূল তহবিল প্রদানকারী বাংলাদেশে অবস্থিত সুইজারল্যান্ডের (সুইস) দূতাবাস, আর যৌথ-অর্থায়ন ও বাস্তবায়নে রয়েছে সিনজেনটা ফাউন্ডেশন ফর সাস্টেইনেবল এগ্রিকালচার। প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা করছে- সুইসকন্টাক্ট। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজনশীলতা তৈরির লক্ষ্যে ঝুঁকি প্রশমনের সচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে এটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।
বর্তমানে দেশের ১৬টি জেলার ৬৪টি উপজেলায় এই বিমা প্রকল্প চলছে।
তবে মাঠপর্যায়ে বিমা কোম্পানিগুলোর পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় বিমাপণ্য বিতরণ ও পরিচালনায় কৌশলগত ও বন্টন অংশীদার হিসেবে কাজ করছে: ব্র্যাক, সিনজেনটা বাংলাদেশ লিমিটেড, ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো), গ্রাম উন্নয়ন কর্ম, জেবিকে এন্টারপ্রাইজ এবং ইজাব এগ্রো লিমিটেড।
ব্র্যাকের এগ্রিকালচারাল ইন্সুরেন্স, মাইক্রোফিন্যান্স- এর টিম লিডার আলী তারেক পারভেজ বলেন, "আমরা মূলত মাইক্রোফিন্যান্স নিয়ে কাজ করি। এ কারণে যারা আমাদের থেকে কৃষিঋণ নেয়, তাদের কাছে আমরা ইনস্যুরেন্স পণ্যগুলো অফার করি।"
সুরক্ষা প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মোঃ আমিনুল মোভেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা ফসলের বিমা চালু করার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছি, যা কৃষকদের মধ্যে পর্যায়ক্রমে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।"
জানা গেছে, এখন পর্যন্ত কৃষকরা সবচেয়ে বেশি বিমা করেছেন আলুর জন্য। চার বছরে -আলুতে বিমা করা হয়েছে ৯২ হাজার ৬১৬টি, আমন ধানে বিমা হয়েছে ৭৭ হাজার ৫৯৩টি, বোরো ধানে ৪২ হাজার ১৭৪টি, ভুট্টায় ২ হাজার ৩৪৭টি এবং শিমে বিমা হয়েছে ১০৭টি।
গ্রিন ডেল্টার হেড অব ইমপ্যাক্ট বিজনেস অ্যান্ড ইভিপি'র প্রধান শুভাশিস বড়ুয়া জানান, তারা মূলত ২০১৩ সাল থেকেই কৃষকদের শস্য বিমা করানোর চেষ্টা করছেন। ২০১৫ সালে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের সদস্য সংস্থা- আইএফসির সহযোগিতায় একটি পাইলট প্রকল্পও হয়।
তিনি বলেন, "এরপর থেকেই আমরা বাণিজ্যিকভাবে শস্যবিমার প্রোডাক্ট চালু করেছি। সবশেষ আমরা সিনজেনটা ফাউন্ডেশনের সঙ্গে কাজ করছি। সিনজেনটা ফাউন্ডেশন এবং এর বাইরে আমাদের দুই লাখের বেশি কৃষিবিমার গ্রাহক রয়েছে।"
বিনামূল্যে কৃষি পারামর্শ:
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আরেক কৃষক রিক্তা রানি। তিনি গত তিন বছর ধরে এসব ফসল চাষের সময় বিমা করছেন।
এবছর তিনি ১৫ শতক আলুর ক্ষেত, ৫ শতক ভুট্টা ও ৫ শতকে বোরো ধান চাষের উপর বিমা পলিসি (পণ্য) কিনেছেন।
রিক্তা রানি টিবিএসকে বলেন, "বিমা করলে প্রতি রবিবার আমরা একটি করে ফোন পাই। ফোন করে পরবর্তী এক সপ্তাহ কোন ফসলের কীভাবে যত্ন নেওয়া দরকার, কি কি সার বা কীটনাশক দিতে হবে, আবহাওয়া কেমন থাকবে— সব বলে দেওয়া হয়। সেই অনুযায়ী আমরা ফসলের মাঠে দরকারি ব্যবস্থা নেই।"
গত জানুয়ারিতে হঠাৎ করেই দুদিনের মত বৃষ্টি ছিল সেকথা উল্লেখ করে রিক্তা বলেন, আগেই তাদের বৃষ্টির পূর্বাভাস জানিয়ে আলুর ক্ষেতে যাতে পানি না জমে সেজন্য ক্ষেতের মধ্যে নালা তৈরি করতে বলা হয়েছিল।
"এ পরামর্শে আমাদের খুব উপকার হয়। আলুর কোনও ক্ষতি হয়নি।"
সিনজেনটা ফাউন্ডেশন বলছে, তাদের একটি হটলাইন নাম্বার রয়েছে। সেখান থেকে প্রতি সপ্তাহে ফোন করে বিভিন্ন কৃষি পরামর্শ দেওয়া হয়। কেউ সেই নাম্বারে কল করলে কেটে দিয়ে হটলাইন থেকেই কলব্যাক করে আবহাওয়া উপযোগী কৃষি ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়।
আমিনুল মোভেন জানান, অনেকে বিমা করছেন শুধুমাত্র এই ফোন সার্ভিস পাওয়ার জন্য। এতে ফসল উৎপাদনে তাদের দারুণ উপকার হচ্ছে।
কৃষি পরামর্শের জন্য আবহাওয়া বিভাগ এবং স্যাটেলাইট থেকেও আবহাওয়ার তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
যেভাবে কৃষি বিমাপণ্য তৈরি হয়:
প্রতিবছর ছত্রাক সংক্রমণজনিত লেটব্লাইট রোগে আলুর ফলনের বড় ক্ষতি হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, লেটব্লাইটে আক্রান্ত হলে আলুর ফলন ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। বাতাসে অধিক আদ্রতা, কুয়াশা এবং তাপমাত্রার তারতম্যের জন্য এ রোগ দেখা দেয়। এই ঝুঁকি মোকাবিলায় আবহাওয়া সূচক ভিত্তিক শস্যবিমা পণ্য (পলিসি) তৈরি করা হয়েছে।
আলু বীজ বপনের সময়কালকে বিবেচনায় নিয়ে 'আগাম বিমা' নামের একটি পণ্য তৈরি করা হয়েছে, যেটি ৩২ দিন মেয়াদে হয়ে থাকে। ৩৩ শতাংশ জমিতে আলু চাষের সম্ভাব্য ব্যয় হিসাব করা হয়েছে ২০ হাজার টাকা। এই বিমা করতে গেলে কৃষককে ১.৫ শতাংশ হারে অর্থাৎ ৩৩ শতাংশ জমির জন্য প্রিমিয়াম দিতে হবে ৩০০ টাকা।
এবারে কৃষক এই বিমা সুবিধা নেওয়ার পর ৩২ দিনের মধ্যে টানা ৩ দিন / ৭ দিন / ১৫ দিন সূর্যের আলো যদি কুয়াশা বা অন্য কোনো কারণে ৩ ঘন্টা বা তার চেয়েও কম থাকে- তবে ৭.৫ শতাংশ হারে ১,৫০০ টাকা বিমা দাবি পাবেন।
আবার ধানের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত বা অতিরিক্ত তাপমাত্রার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে কৃষি বিমা পণ্য। নির্ধারিত সীমার বেশি বৃষ্টিপাত হলে বা উচ্চ তাপমাত্রা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য থাকলে তখন গ্রহীতারা বিমা দাবি পেয়ে যাবেন। বিভিন্ন পলিসির ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন মেয়াদ নির্ধারণ করা আছে।
বিমা দাবি স্বয়ংক্রিয়ভাবে যেভাবে নিষ্পন্ন হয়:
কারণ কৃষি বিমা পণ্যগুলোর সবই হচ্ছে আবহাওয়া সূচকের উপর নির্ভরশীল। সবটাই রেকর্ড থাকে। গত চার বছরে প্রায় ৪০ হাজার কৃষক বিমা দাবি পেয়েছেন। বিমা দাবি পরিশোধের পরিমাণও ২০ লাখ টাকার বেশি।
গ্রিন ডেল্টার শুভাশিস বড়ুয়া বলেন, "শস্যবিমার আসল সুবিধাই এখানে। এখানে সবকিছু ফিক্সড। আবহাওয়ার তথ্যই সব বলে দেয়। যখন প্রাকৃতিক কারণে ফসলের ক্ষতি হয়- আমরা তখনকার আবহাওয়ার তথ্যানুসারে বিমা দাবি পরিশোধ করে দেই।