২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাবদ ৮,০০০ কোটি টাকা বেশি চায় কৃষি মন্ত্রণালয়

আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে কৃষি ভর্তুকি বাবদ ২৫ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়—যা চলতি অর্থবছরে পাওয়া ভর্তুকির চেয়ে ৮ হাজার কোটি টাকা বেশি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বাজেট ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় কৃষি মন্ত্রণালয় এ প্রস্তাব করেছে। তবে অর্থ বিভাগ চলতি অর্থবছরের মতো ভর্তুকির পরিমাণ ১৭ হাজার কোটি টাকাই রাখার পক্ষে মত দিয়েছে বলে বিষয়টি সম্পর্কে অবগত কর্মকর্তারা জানান।
কৃষি সচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) টিবিএসকে বলেন, সার্বিক বিবেচনায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির প্রস্তাব করা হয়েছে। 'কৃষি মন্ত্রণালয় আশা করছে, সরকার যথাযথ পর্যালোচনা করে বাজেটে বরাদ্দ রাখবে।'
কৃষি ভর্তুকির বড় অংশ যায় সারে। কৃষির আধুনিকায়নের লক্ষ্যে যন্ত্রপাতি কেনা, কৃষি পুনর্বাসন ও গবেষণাতেও ভর্তুকি দেয় সরকার। এর বাইরে ভূমিহীন, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের সরাসরি কিছু ভর্তূকি দেওয়া হয়ে থাকে।
ভর্তূকি বৃদ্ধির কারণ হিসেবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, 'ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে কৃষি খাতের ভর্তুকিও বাড়ছে। কারণ ভর্তুকির বড় অংশ ব্যয় হয় সারের পেছনে। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম বেড়েছে। বেড়েছে পরিবহন খরচ।
'আবার ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে। এতে সার আমদানি বাবদ বেশি খরচ হচ্ছে। অপরদিকে আগামী বছর সারের চাহিদাও কিছুটা বাড়বে বলে ধরা হচ্ছে। সামগ্রিক বিবেচনায় বাড়তি ভর্তুকি চাওয়া হয়েছে।'
ওই কর্মকর্তা জানান, চলতি অর্থবছরে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির চাহিদা পাওয়া গেছে। অর্থবছর শেষে এই পরিমাণ আরও বাড়বে।
তিনি জানান, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মূল বাজেটে কৃষি ভর্তুকি রাখা হয়েছিলো ১৭ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটে ২৫ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা করা হয়।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, 'তবে এই ভর্তুকির সব অর্থ পরিশোধ হয়নি—যে কারণে বর্তমাণে ভর্তুকি বাবদ বড় অঙ্কের বকেয়া সৃষ্টি হয়েছে। বেসরকারি খাতের আমদানিকারকরা এখন অর্থ না পেয়ে সুদ দাবি করছে।
'মন্ত্রণালয়ও তাদের সুদ দেওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে। পাশাপাশি বলছে, সরকারের পেমেন্ট ব্যবস্থার উন্নতি না হলে আগামীতে সার সরবরাহ করা সম্ভব হবে না।'
তিনি বলেন, অর্থ বিভাগ বন্ড ইস্যু করে ভর্তুকি বাবদ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা কৃষি মন্ত্রণালয়কে দিয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় সেগুলো যেসব ব্যাংকের মাধ্যমে ঠিকাদাররা সার আমদানির এলসি খুলেছিল, তাদেরকে দিয়েছে।
কিন্তু ব্যাংকগুলো এখন আর বন্ড নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
সারে ভর্তুকি
সরকার সর্বশেষ ২০২৩ সালের ১১ এপ্রিল সারের দাম বাড়ায়। সে সময় সব ধরনের সারের দাম কেজিতে ৫ টাকা বাড়ানো হয়েছিল। তারপর থেকে কৃষক পর্যায়ে ইউরিয়া সারের দাম প্রতি কেজি ২৭ টাকা, ডিএপি ২১ টাকা, টিএসপি ২৭ টাকা এবং এমওপি ২০ টাকা।
সেই সময় কৃষি মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে ঘোষণা দিয়েছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম প্রতি কেজি ইউরিয়া ৪৮ টাকা, ডিএপি ৭০ টাকা, টিএসপি ৫০ টাকা এবং এমওপি ৬০ টাকা। কেজিতে ৫ টাকা দাম বাড়ানোর পরও সরকারকে ইউরিয়া সারে কেজিতে ২১ টাকা, ডিএপিতে ৪৯ টাকা, টিএসপিতে ২৩ টাকা এবং এমওপিতে ৪০ টাকা ভর্তুকি দিতে হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে সারের চাহিদা ৬৯ লাখ টন। চাহিদার ৮০ শতাংশ সার আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়।
৫ মার্চ অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সর্বশেষ সভায় প্রতি টন ইউরিয়া সার ৪২২ ডলারে কেনার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। ১ ডলারের (১২২ টাকা) বিনিময় হারের ভিত্তিতে প্রতি কেজি সারের ক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ৫১.৪৮ টাকা। পরিবহন খরচ, মজুতের ক্ষতি ও ডিলার কমিশন যোগ করে চূড়ান্ত মূল্য নির্ধারিত হয়।
কর্মকর্তারা জানান, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সারের দাম বাড়াবে না। অর্থাৎ তাদের ভর্তুকি বৃদ্ধি করতে হতে পারে।
ভর্তুকি-নির্ভরতা
অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, সামগ্রিকভাবে ভর্তুকি থেকে বের হয়ে আসার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। '২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে ভর্তুকি থেকে বের হতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'যদিও এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও তিন বছর গ্রেস পিরিয়ড থাকবে; কিন্তু সরকার এখন থেকেই ভর্তুকি ব্যবস্থাপনা করছে। তবে কৃষি খাতে সরকার ভর্তুকি অব্যাহত রাখবে। তবে সেক্ষেত্রে ধরন পাল্টাতে পারে।'
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষি খাতে ভর্তুকি দরকার।
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'কৃষিজাত পণ্যের ওপর ধনী-গরিব সবাই নির্ভরশীল। তবে রাজস্ব সংগ্রহ পরিস্থিতি এবং এলডিসি থেকে উত্তরণ প্রেক্ষিত বিবেচনায় বাংলাদেশকে ভর্তুকি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কিন্তু কৃষির ভর্তুকি থেকে সরে আসা যাবে না।
'সেজন্য সরকারকে দেখতে হবে কোথায় কোথায় ভর্তুকি কমানো যায়, অপচয় রোধ করা যায়। এবং প্রকৃত কৃষকের কাছে যাতে সুবিধা পৌঁছানো যায় সেই উদ্যোগ নিতে হবে; যাতে কৃষি উৎপাদনশীলতার কোনো ক্ষতি না হয়।