রমজানে ভোক্তাদের স্বস্তির মূল্য দিচ্ছেন কৃষকরা?

রমজানে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন দেশের ভোক্তারা। ইফতারের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য হিসেবে পরিচিত যেমন—আলু, পেঁয়াজ, টমেটো ও কাঁচা মরিচের দাম কমে যাওয়ায় কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে বাজারে।
তবে বাজারে স্বস্তি মিললেও মাঠে কৃষকদের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। মাসের পর মাস কষ্ট করে ফসল ফলানো কৃষকেরা এখন দেখছেন—তাদের পণ্য বিক্রি হচ্ছে উৎপাদন খরচের চেয়েও কম দামে।
উদাহরণ হিসেবে আলুর কথাই বলা যেতে পারে। কৃষকদের ভাষ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে প্রতিকেজি আলু উৎপাদনে তাদের খরচ পড়েছে ১৮ থেকে ২০ টাকা। অথচ স্থানীয় বাজারে সেই আলুই বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১০ থেকে ১২ টাকায়—যা দিয়ে উৎপাদন খরচই উঠে আসছে না, আর লাভ তো দূরের কথা।
পেঁয়াজ চাষীদের অবস্থাও প্রায় একই রকম। প্রতিকেজি পেঁয়াজ উৎপাদনে যেখানে খরচ পড়ছে ৩৮ থেকে ৪১ টাকা, সেখানে অনেক কৃষককে বিক্রি করতে হচ্ছে ২২ থেকে ২৫ টাকা কেজি।
"আমরা সারা বছর ন্যায্যমূল্যের আশায় বসে থাকি। কিন্তু এ বছর পরিস্থিতি ভয়াবহ। প্রতি কেজিতে আমাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে," বললেন বগুড়ার কৃষক নাফিসুল ইসলাম।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনা এবং পণ্য সংরক্ষণ করে রাখার জন্য যথাযথ স্টোরেজ সুবিধার অভাবে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
'এটি একটি পরিচিত চক্র' উল্লেখ করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, "যখন উৎপাদন বেশি হয়, তখন মাঠপর্যায়ে দাম পড়ে যায়। ভোক্তারা স্বল্পমেয়াদে উপকৃত হলেও কৃষকেরা ক্ষতির মুখে পড়েন।"
তিনি আরও বলেন, "এই পরিস্থিতি যদি চলতেই থাকে, তাহলে পরবর্তী মৌসুমে কৃষকদের মধ্যে উৎপাদনের আগ্রহ কমে যাবে।"
আলু: বেশি উৎপাদনে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী, ৯০ শতাংশ জমির আলু তুলেছেন কৃষকরা। এরই মধ্যে আলুর উৎপাদন হয়েছে ১.১৫ কোটি টন, যা বিগত যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। চলতি বছর ৫.২৪ লাখ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১৩ শতাংশ বেশি। গত বছরের তুলনায় এ বছর আলু আবাদের জমি বেড়েছে ১৫ শতাংশ। কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবার প্রায় ১.২৫ টন আলু উৎপাদন হতে পারে।
যদিও দেশে আলুর চাহিদা রয়েছে প্রায় ৯০ লাখ টন। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হওয়ায় লোকসান গুনছেন কৃষকরা। গত বছর আলুর ভরা মৌসুমেই বেশি দামে আলু বিক্রি করেছিলেন কৃষকরা। এরপর মে মাসে তা ৫০ টাকা অতিক্রম করে। নভেম্বরে দাঁড়ায় প্রতিকেজি ৮০ টাকা, যা বিগত যেকোনো সময়ের চেয়ে সর্বোচ্চে উঠেছিল। ফলে দাম বেশি থাকায় কৃষকরা আলু উৎপাদন বাড়িয়েছিলেন।
বাজারে সরবরাহ বেশি থাকায় আলুর দামে পতন হয়েছে বলে জানান চাষী কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএসএ) সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু।
টিবিএসকে তিনি বলেন, "আমাদের হিসেব অনুযায়ী, গত বছর ৭৫-৮০ লাখ টনের মতো আলু উৎপাদন হয়েছিল। তবে এবার আগের বছরের চেয়ে অনেক বেশি আলু উৎপাদন হয়েছে। গত বছর আলুর দাম বিগত যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ছিল। ফলে কৃষকরা প্রচুর জমিতে আলু চাষ করেছেন। এর পাশাপাশি আবহাওয়া ভালো থাকায় উৎপাদন ভালো হয়েছে।"
তিনি বলেন, "গত বছর কৃষকরা আলু বিক্রি করেছিলেন প্রতিকেজি ২৫-৩৭ টাকা পর্যন্ত। লাভ হওয়ায় এবার কৃষকরা অনেক বেশি পরিমাণ জমিতে আলু করেছেন।"
কৃষক নাফিসুল ইসলাম জানান, সম্প্রতি কোল্ড স্টোরেজের ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় আরেক দফা আর্থিক চাপে পড়েছেন কৃষকরা। "গত বছর প্রতি বস্তা আলু ৩৩০ টাকায় স্টোরেজ সংরক্ষণ করেছিলাম, এবার তা বেড়ে ৪০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে," বলেন তিনি।
কোল্ড স্টোরেজের ভাড়া বৃদ্ধির প্রসঙ্গে মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, "কোল্ড স্টোরেজে যা ভাড়া বেড়েছে তাতে প্রতিকেজি আলুতে ১ টাকা ২৫ পয়সা বাড়বে।"
দেশের কোল্ড স্টোরেজগুলোতে সক্ষমতা রয়েছে প্রায় ৪৫ লাখ টন। গত বছর ২৫ লাখ টন আলু এসব কোল্ড স্টোরেজে রেখেছিলেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। তবে এবার কোল্ড স্টোরেজ মালিকরা বলছেন, উৎপাদন বেশি হওয়ায় এবার সক্ষমতার পুরোটাই পূরণ হতে পারে। ইতোমধ্যে কোল্ড স্টোরেজগুলোতে চাপ বাড়ছে বলে জানান তারা।
টমেটো, কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজচাষীরাও সংকটে
টমেটোচাষীরাও একই ধরনের সমস্যার কথা জানালেন; পাশাপাশি বিপাকে রয়েছেন কাঁচা মরিচ ও মিষ্টি কুমড়া চাষীরাও। ইফতারের প্লেটে রঙ ও স্বাদ যোগ করা এসব সবজি এখন চাষীরা এখন লোকসানের মুখে দাঁড়িয়ে।
নিয়মিত বিভিন্ন কৃষিপণ্যের যৌক্তিক পাইকারিমূল্য ও পাইকারি বাজারের প্রকৃত মূল্যের তথ্য সংগ্রহ করে থাকে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। তাদের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিকেজি টমেটো পাইকারি পর্যায়ে যৌক্তিক মূল্য হওয়া প্রয়োজন ২৬ টাকা। তবে বর্তমানে পাইকারিতে তা বিক্রি হচ্ছে ৮-১৬ টাকায়। কাঁচামরিচের যৌক্তিক পাইকারি মূল্য ৪৫ টাকা হলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়। এছাড়া, মিষ্টিকুমড়ার যৌক্তিক মূল্য ২৪ টাকা, কিন্তু ৮-২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
গত বছর পেঁয়াজের বাজারও অস্থিতিশীল ছিল। অধিকাংশ সময়জুড়ে পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকার ওপরে থাকায় গতবারের চেয়ে এবার ৮ শতাংশ বেশি জমিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে। ফলে দাম পড়েছে পেঁয়াজেরও।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, চলতি বছর ২.৮০ লাখ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করেছেন কৃষকরা। কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবার পেঁয়াজের উৎপাদন প্রায় ৪০ লাখ টন ছাড়িয়ে যেতে পারে—যা বিগত যেকোনো সময়ের চেয়ে সর্বোচ্চ।
পাবনার সাথিঁয়া উপজেলার বাঐটোলা গ্রামের কৃষক রহমান প্রামাণিক এবছর ১১ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছেন। বর্তমানে পেঁয়াজ উৎপাদনে শীর্ষ জেলা পাবনায় কৃষক পর্যায়ে প্রতিমণ পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯০০-১,০৫০ টাকায়। টিবিএসকে তিনি বলেন, "আমি পেঁয়াজ তুলিনি এখনও। আরেকটু অপেক্ষা করছি, যদি দাম বাড়ে।"
"এখন যে দামে বিক্রি হচ্ছে, তাতে অনেক লোকসান হবে। এমনিতে ফলন কম এবার। সম্প্রতি বৃষ্টির কারণে পেঁয়াজ আগা মরা রোগে আক্রান্ত হওয়ায় ফলন কম হয়েছে," বলেন তিনি।
একই চিত্র টমেটো, কাঁচামরিচ ও বিভিন্ন সবজির ক্ষেত্রেও। প্রতিকেজি টমেটো উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয় প্রায় ১০ টাকা। তবে কৃষক পর্যায়ে গত এক মাস ধরে তা বিক্রি হচ্ছে ৩-৫ টাকায়।
খুলনার দাকোপ উপজেলার তিলডাঙ্গা গ্রামের কৃষক শিল্পী সরদার টিবিএসকে বলেন, "পাইকারি বাজারে ৪ কেজি ১০ টাকা দিতে চায়। কিন্তু আমার বাজারে নিতে কেজিতে ৩ টাকা খরচ আছে। কীভাবে বিক্রি করবো? একারণে গাছেই টমেটো পচে যাচ্ছে; বিক্রি করছি না।"
'কৃষকদের প্রয়োজন প্রশিক্ষণ ও তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্তের সুযোগ'
কৃষকদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন জানিয়ে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, "কৃষকদের দাম নিশ্চিত করতে গিয়ে যেন ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত না হন, আবার ভোক্তার স্বার্থ দেখতে গিয়ে যেন কৃষকও ক্ষতিগ্রস্ত না হয়—এমন ব্যালেন্স সিস্টেমে আমাদের যেতে হবে। কৃষকদের সঠিক তথ্য সরবরাহ করতে হবে।"
খাদ্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি কৃষকদের বিষয়ও বিবেচনায় নিতে হবে জানিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "আমাদের দেশে একটি বড় সমস্যা হলো যেই বছর দাম বেশি থাকে, তার পরের বছর কৃষকরা সেই ফসল বেশি পরিমাণে আবাদ করেন। যার প্রভাবে তারা দাম পান না। এক্ষেত্রে কৃষককে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।"
সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানির ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, "সরবরাহ আধিক্য বা স্বল্পতার কারণে যেন বাজার অস্থিতিশীল না হয়, সেজন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনাকে উন্নত করতে হবে। আমাদের দেশে কৃষির সাথে শিল্পের সংযোগ খুবই দুর্বল। প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে এটা শক্তিশালী করতে হবে।"
এছাড়া রপ্তানির দিকে নজর দেওয়া জরুরি। উন্নত বিশ্বে কৃষিপণ্য রপ্তানির যে গাইডলাইন রয়েছে, সেগুলো মেনে উৎপাদনে জোর দিতে হবে। তাহলে বাজারে স্থিতিশীলতা রাখা সম্ভব হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে আমদানি ব্যবস্থাপনা আরও শক্তিশালী করতে হবে জানিয়ে অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, "মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির হার কমেছে ,তবে সাধারণ মূল্যস্ফীতি আগের জায়গায় ফিরে আসতে আরও অনেক সময় লাগবে। যেসব পণ্য আমদানির সাথে সম্পর্কিত, সেসব পণ্যের দাম কিন্তু কমেনি। আন্তর্জাতিক বাজারে নজর রাখতে হবে। যখন দাম কম থাকে সে সময়ে আমদানির পলিসি নিতে হবে।"