২০২৪ সালের শেষ ছয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১.৩৪ লাখ কোটি টাকা

২০২৪ সালের শেষ ছয় মাসে দেশে খেলাপি ঋণ ১.৩৪ লাখ কোটি টাকা বেড়ে ডিসেম্বর মাসে মোট ৩.৪৫ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য উপস্থাপন করার সময় গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, আগস্ট মাসে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণ সামনে আসছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বুধবার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, নতুন পরিসংখ্যানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের ২০.২ শতাংশ।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল থাকা অবস্থায় ২০২৪ সালের জুন মাসের শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২.১১ লাখ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১২.৫৬ শতাংশ ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে খেলাপি ঋণ ছিল ১.৪৫ লাখ কোটি টাকা, যা তখনকার মোট ব্যাংক ঋণের ৯ শতাংশ ছিল।
ব্যাংকারদের মতে, মন্দ ঋণের বৃদ্ধি শেখ হাসিনার ১৫ বছরের বেশি শাসনামলের পর শুরু হয়েছে, যেখানে 'উইন্ডো ড্রেসিং'-এর মত প্রচলিত কৌশল ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যান গোপন করতে সাহায্য করেছিল। [উইন্ডো ড্রেসিং-এর মাধ্যমে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো দেখানোর চেষ্টা করে, যদিও বাস্তবে তা সঠিক নয়।]
সংবাদ সম্মেলনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আরও জানান, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির মূল কারণ হলো মন্দ ঋণের প্রতিবেদন তৈরিতে দীর্ঘকাল ধরে যে স্বচ্ছতার অভাব ছিল, সেটি শেষ হওয়া এবং ঋণ শ্রেণীবিভাগ নীতিতে সাম্প্রতিক পরিবর্তন।
পূর্বে, ঋণগুলো ২৭০ দিন পর বকেয়া হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হতো। কিন্তু এখন সময়সীমা ১৮০ দিনে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। গভর্নর আরও বলেন, ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে ঋণগুলো মাত্র ৯০ দিনের মধ্যে অকার্যকর হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হবে।
গভর্নর বলেন, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের অন্তত ৪২ শতাংশ অকার্যকর হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ ছিল। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ১৫ শতাংশ অকার্যকর ছিল। তিনি সতর্ক করে বলেন, এই নতুন কঠোর নীতির ফলে আগামী মাসগুলোতে খেলাপি ঋণ আরও বাড়তে পারে।
এ মাসের শুরুর দিকে, বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি-জুন মাসের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। মুদ্রানীতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ জুন মাসের মধ্যে মোট বকেয়া ঋণের ৩০ শতাংশের বেশি হয়ে যেতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পেছনে যেসব কারণ রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে কাঠামোগত দুর্বলতা, নিয়মকানুনের ফাঁক এবং অর্থপাচার ও অবৈধ মূলধন পাচারের মতো শোষণমূলক প্রথা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বেশ কয়েকটি ব্যাংক ভয়াবহ তারল্য সংকটে পড়েছে, যা খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, টাকা জমার হার কমে আসা এবং দুর্বল ঋণ পুনরুদ্ধারের কারণে আরও খারাপ হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বেশ কয়েকটি বড় ঋণ পরিদর্শন বিভাগের মাধ্যমে অকার্যকর হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ হয়েছে। এছাড়া, কিছু ঋণ আবারও খেলাপি হয়েছে কারণ পুনঃনির্ধারিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা হয়নি।
গত ছয় মাসে, ব্যাংকগুলোতে নতুন ঋণ বিতরণ এবং ঋণ নবায়নের পরিমাণ কমে গেছে। আর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। এছাড়া, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট সময়ের ঋণের জন্য অতিরিক্ত সময়সীমা কমিয়ে দেওয়ার কারণে অনেক ঋণ খেলাপি হয়েছে।
বিশ্লেষকরা খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির জন্য আন্তর্জাতিক মান পুনরায় চালু করাকেও দায়ী করছেন, যা ২০২০ সালে মহামারি চলাকালে স্থগিত করা হয়েছিল। এই কঠোর পদক্ষেপগুলো এই খাতের আর্থিক অবস্থাকে হতাশাজনকভাবে উপস্থাপন করলেও, আরও সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে সাহায্য করছে।
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি নিয়ে ব্যাংকাররা যা বলছেন
মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, বেশ কিছু কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ ব্যাংকগুলো অনেক গ্রাহকের ঋণ নিয়মিত দেখিয়েছিল, যেগুলো প্রকৃত অর্থে খেলাপি ছিল। এখন সেসব ঋণ নতুন করে খেলাপি হচ্ছে।
তিনি বলেন, 'এছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ ক্লাসিফিকেশন প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী করার কারণেও কিছু ঋণ খেলাপি হচ্ছে।'
মাহবুবুর বলেন, 'জুলাই ও আগস্ট মাসে ছাত্র বিক্ষোভ এবং ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে অনেক ঋণগ্রহীতা তাদের ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। এটিও খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে।'
তিনি বলেন, এসএমই খাতের অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যার কারণে অনেক গ্রাহক খেলাপি হয়েছেন। এছাড়া গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ পর্যাপ্ত না থাকায় অনেক কারখানা যথাযথ উৎপাদন করতে পারেননি। একইসঙ্গে গার্মেন্ট কারখানাগুলোর শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনকেও খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে দেখছেন তিনি।
বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ বিভাগের কর্মকর্তারা টিবিএসকে জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর এস আলম ও বেক্সিমকো গ্রুপের মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়িয়ে এসেছে। এছাড়া বেশ কিছু বড় বড় গ্রুপের ঋণে অনিয়মের তথ্য এসেছে। এসব গ্রুপের বেশি কিছু ঋণ ইতোমধ্যে খেলাপি হয়েছে।
একটি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণের চিত্র বের হয়ে আসা উচিত। পুরোপুরি চিত্র বেরিয়ে আসলে তখন সংস্কারের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।
তিনি বলেন, 'দ্রুত সময়ে পরবর্তী নির্বাচন হয়ে গেলে, খেলাপি ঋণের তথ্য পুরোপুরি বের হবে না। পরে নতুন সরকার বড় ঋণ খেলাপিদের সাথে সমঝোতা করে এসব ঋণ পুনরায় নিয়মিত করে নেবে।'