অস্থিতিশীলতার মধ্যেও চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে বৈদেশিক ঘাটতি ৮৯% কমেছে

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে দেশের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্য হিসেবে পরিচিত ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) ঘাটতি প্রায় ৮৯ শতাংশ কমেছে।
আগস্টের রাজনৈতিক অস্থিরতা, পরবর্তীতে বন্যা এবং বিভিন্ন দাবিতে চলমান আন্দোলনের কারণে সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা সত্ত্বেও এই উন্নতি এসেছে।
তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর মাসে মোট বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৮৪ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩.৪৫ বিলিয়ন ডলার। এতে প্রায় ৩.০৭ বিলিয়ন ডলারের উন্নতি প্রতিফলিত হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এই অর্থবছরের প্রথম তিন মাস বাংলাদেশ জন্য খুব বেশি স্বস্তিজনক ছিল না। তারপরে নানান দাবি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন হয়েছে।"
তিনি বলেন, "এসবের মধ্যেও আমরা ট্রেড ব্যালেন্স, কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স এবং ফাইনান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সে আগের তুলনায় অনেক উন্নতি করেছি। এটি সামগ্রিকভাবে দেশের ফরেক্স রিজার্ভ ও এক্সচেঞ্জ রেটের ওপর চাপ কিছুটা কমিয়েছে।"
তবে ইতিবাচক সূচক সত্ত্বেও, অর্থনীতিবিদ জাহিদ একটি উদ্বেগজনক বিষয় তুলে ধরেছেন। এটি হলো "এরর অ্যান্ড এমিশন" (ত্রুটি এবং বাতিল) বিভাগে ১৬৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এটি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর মাসে ৭৫১ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২.০১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
তিনি উল্লেখ করেছেন, যদি এই পরিমাণ কম হতো তবে মোটেই কোন ব্যালান্স অব পেমেন্ট ঘাটতি থাকতো না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও জানিয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ঘাটতির মূল কারণ হলো "এরর অ্যান্ড এমিশন"-এর নেগেটিভ বা নেতিবাচক ভারসাম্য।
জাহিদ ব্যাখ্যা করেছেন, নেগেটিভ "এরর অ্যান্ড এমিশন" হলো অনথিভুক্ত আউটফ্লো অর্থাৎ রিজার্ভ থেকে ডলার খরচ হয়েছে, কিন্তু সঠিকভাবে হিসাব করা হয়নি।
তিনি বলেন, "আগে নেগেটিভ ব্যালেন্স বেড়ে গেলে আমরা ভাবতাম দেশ থেকে টাকা পাচার বেড়েছে। তবে, আমরা এখন হুন্ডি মার্কেটে তেমন ডিমান্ড দেখছি না। এছাড়া, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এখন টাকা পাচার বেড়ে যাওয়ারও কথা না। ফলে এই পরিমাণ কেন এত বড় হচ্ছে, তা আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে।"
অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে হিসাবের অমিল এই সমস্যার কারণ হতে পারে, যেখানে কিছু আউটফ্লো সঠিকভাবে ধরা পড়ছে না এবং কিছু ইনফ্লো বেশি হিসাব করা হচ্ছে।
যে কারণই হোক, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এই বিষয়টি সমাধান করতে হবে বলেন তিনি।
দেশের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্য আগামী ছয় মাসে আরও আরো ভালোর দিকে যাওয়ার আশা প্রকাশ করে জাহিদ বলেন, "যদি সম্প্রতি ভারসাম্য উন্নত না হত, তবে সরকারকে আরও কঠোর আমদানি বিধিনিষেধ আরোপ করতে হত। তবে সৌভাগ্যবশত, তেমনটা করতে হয়নি।"
তিনি আরও বলেন, জুলাই-আগস্টে দেশের ম্যাক্রোঅর্থনীতি বড় ধরনের অস্থিতিশীলতার মুখে পড়লেও, আগামী ছয় মাসে একই ধরনের অস্থিতিশীলতার সম্ভাবনা কম।
বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে ১০%
গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময় শেষে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি ১০.২২ শতাংশ কমেছে, কারণ রপ্তানির প্রবৃদ্ধি আমদানির তুলনায় বেশি ছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে ডিসেম্বর শেষে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৯.৬৪ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১০.৮৮ বিলিয়ন ডলার। দেশের রপ্তানি বেড়েছে ১১ শতাংশ, যেখানে লতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে আমদানি বেড়েছে মাত্র ৩.৫ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ তার বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে সক্ষম হয়েছে, কারণ রপ্তানি আয় প্রায় ২.২২ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। অন্যদিকে আমদানি বেড়েছে মাত্র ১.০৯ বিলিয়ন ডলার।
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন উল্লেখ করেছেন, বাণিজ্য ঘাটতির সংকোচন সাধারণত ইতিবাচক হলেও, এটি সবসময় অর্থনীতির জন্য ভালো হয় না।
তিনি বলেন, "আমদানি বৃদ্ধির মূল কারণ ছিল খাদ্যপণ্য ও রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামালের আমদানি বৃদ্ধি। তবে, বিনিয়োগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি ক্রমাগত কমেছে। বিনিয়োগ ছাড়া কর্মসংস্থান বাড়ে না, যা অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক সংকেত।"
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর মাসে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি ৩০ শতাংশ কমে গিয়ে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। । এছাড়া চিনি, সার ও পেট্রোলিয়ামের আমদানি খরচও আগের অর্থবছরের তুলনায় কমেছে।
চলতি হিসাব উদ্বৃত্তে পরিণত
রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে দেশের দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে অন্যতম উপাদান কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স বা চলতি হিসাব উদ্বৃত্তে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর শেষে চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ৩৩ মিলিয়ন ডলার, যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে এটি ছিল ৩.৪৭ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি।
তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩.৭৮ বিলিয়ন ডলারে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১০.৮ বিলিয়ন ডলার। এতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২.৯৮ বিলিয়ন ডলার বা ২৭.৫৯ শতাংশ।
জাহিদ এই উন্নতির জন্য রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি এবং বাণিজ্য ঘাটতি কমাকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, এটি অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।
তিনি আরও বলেন, "সার্ভিস ও ইনকাম অ্যাকাউন্টে ডেফিসিট (পরিষেবা এবং আয় হিসাবের ঘাটতি) কিছুটা বেড়েছে যার মূল কারণ ট্রান্সপোর্টেশন পেমেন্ট (পরিবহণ খরচ) বেড়ে যাওয়া।"
কয়েকটি ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূলধন পাচার কমে যাওয়া এবং আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বিনিময় হারের ব্যবধান কমার ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে।
আর্থিক হিসাব উদ্বৃত্ত ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল
বিলম্বিত রপ্তানি আয় এবং বিভিন্ন দাতা সংস্থার সহায়তার কারণে চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লেনদেনের অন্যতম প্রধান অংশ আর্থিক হিসাব উদ্বৃত্ত হয়েছে ১.৩৮ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগের অর্থবছরের একই সময়ে এই উদ্বৃত্ত ছিল ৬০৪ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, চলতি অর্থবছরে উদ্বৃত্ত প্রায় ৭৭৫ মিলিয়ন ডলার বেড়েছে।
তবে, এই উন্নতির মাঝেও প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহ কমে গেছে। আগের অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে যেখানে এফডিআই ছিল ৭৪৪ মিলিয়ন ডলার, সেখানে চলতি অর্থবছরে তা মাত্র ২১৩ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
অন্যদিকে নেট ট্রেড ক্রেডিট ডেফিসিট বা বাণিজ্যিক ঋণ ঘাটতি [ যেটি রপ্তানি বিলের বিলম্বিত পেমেন্টের পরিমাণ বোঝায়] অনেক কমে এসেছে। এটি আগের অর্থ বছরের ২.০৩ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে চলতি অর্থবছরে ১৪৫ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অর্থাৎ, রপ্তানিকারকরা আগের চেয়ে দ্রুত রপ্তানি বিল সংগ্রহ করছেন।
তবে, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণও চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার নীতির পরিবর্তনের ফলে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের মূলধন প্রবাহ কমে গেছে। তবে, নতুন বিদেশি বিনিয়োগের গতি এখনও ধীর।
বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের ঘোষিত এফডিআই-এর বেশিরভাগই পুনঃবিনিয়োগিত মুনাফা, নতুন মূলধন প্রবাহ নয়। "এর মানে, আগের বিনিয়োগ থেকে যে মুনাফা আসছে, তা নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ না হয়ে তরল সম্পদ হিসেবে রাখা হচ্ছে। ফলে এটি বিনিয়োগ হিসেবে দেখালেও নতুন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তৈরি করছে না।"
বাণিজ্য ঋণ ঘাটতি কমার বিষয়ে তিনি বলেন, "আগে রপ্তানিকারকরা ডলারের দর আরও বাড়বে বলে বৈদেশিক আয় দেশে আনতে দেরি করতেন। কিন্তু 'ক্রলিং পেগ' বিনিময় হার চালু ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক পদক্ষেপের ফলে মুদ্রা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা কমেছে। এর ফলে রপ্তানি আয় দ্রুত দেশে আসছে।"