জরিপ বলছে, উন্নয়ন কাজে দুর্বল জবাবদিহিতাই মূল চ্যালেঞ্জ
উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবকে মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ৮০ শতাংশের বেশি প্রকল্প কর্মকর্তা। এমন চিত্র উঠে এসেছে সরকারের এক জরিপের ফলাফলে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) পরিচালিত এই জরিপ গবেষণায় দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অন্যান্য সমস্যা যেমন যথাযথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষার অভাব, ত্রুটিপূর্ণ নকশার মতো বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। যেকারণে বার বার বাড়ছে ব্যয় ও বাস্তবায়নের মেয়াদ; ফলে প্রকল্পের কাঙ্ক্ষিত সুবিধা হ্রাস পাচ্ছে।
'প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির দিকে বিশেষ দৃষ্টি রেখে বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিকূলতা ও বিভিন্ন বিষয়াদি' শীর্ষক এই জরিপ গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের তিন-চতুর্থাংশ মনে করেন, ৪০ শতাংশ প্রকল্পেই এ ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
এছাড়া, এতে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের ৭৫ শতাংশ সরকারি কর্মকর্তারা যথাযথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সাথে আলোচনা ছাড়াই প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে যুক্ত ৮৫ শতাংশ সরকারি কর্মকর্তার মতে, সফলভাবে প্রকল্প সম্পন্ন করার জন্য অত্যাবশ্যক হলো- পূর্ত কাজের প্রকৌশলগত নকশা। অথচ অধিকাংশ পূর্ত কাজেরই যথাযথ প্রকৌশল চিত্র (ড্রইং) থাকে না, ফলে ৬১-১০০ শতাংশ প্রকল্পের নকশা পরিবর্তন করতে হয়।
জরিপের আওতায় ছিল, ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারের ৪৩ মন্ত্রণালয়ের অধীন ১ হাজার ৫৫৭ উন্নয়ন প্রকল্প; এর মাধ্যমে প্রকল্পের তিনটি পর্যায়: প্রকল্প প্রণয়ন ও অনুমোদন, বাস্তবায়ন এবং বাস্তবায়ন পরবর্তী পর্যায়ে প্রকল্প বিলম্বিত হওয়ার কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়। প্রকল্পগুলোর বিস্তৃত তদারকি প্রতিবেদন এবং গত চার অর্থবছরে সম্পন্ন হওয়া প্রকল্পগুলোর পর্যালোচনা প্রতিবেদনও খতিয়ে দেখেছে মূল্যায়ন বিভাগ।
জরিপের ফলাফল নতুন কিছু না বললেও, এবারই প্রথম সরকারি কর্মকর্তারা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবকে স্বীকার করলেন। কাজের মান পরীক্ষায় যথাযথ ল্যাবরেটরি ও যন্ত্রপাতির অভাব; প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দক্ষতার অভাব এবং খোদ আইএমইডির নিজস্ব সক্ষমতার সীমাবদ্ধতাও প্রকল্পগুলোর অনুপযুক্ত বাস্তবায়নের পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে।
আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'জবাবহিদিতা নিশ্চিত করতে হবে শুরু থেকেই। কেবল বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে বা ধাপে এসে জবাবদিহিতা চাইলে হবে না'।
জবাবদিহির অভাবই প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরির নেপথ্যে ভূমিকা উল্লেখ করে পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক সচিব মো. মামুন-আল-রশিদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বাস্তবায়নে বিলম্ব হওয়ার প্রতিটি কারণ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু, এখন তা হচ্ছে না।
এদিকে গবেষণা প্রতিবেদনে- পদ্মা বহুমুখী সেতু, পদ্মা সেতু রেল-সংযোগ এবং ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিটের মতো উচ্চ অগ্রাধিকারের প্রকল্পকে দুর্বল ও মন্থর বাস্তবায়ন হারকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে আইএমইডি।
এতে বলা হয়েছে, 'নির্ধারিত সময় ও বাজেটে অধিকাংশ প্রকল্প বাস্তবায়নে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ, এতে ব্যয় বাড়ছে এবং প্রকল্পের প্রত্যাশিত সুফল সীমিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে বহুল প্রচারিত ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন হারকে উল্লেখ করা যেতে পারে।
২০২০-২১ অর্থবছরের ১ হাজার ৫৫৭ প্রকল্প বিশ্লেষণের পর আইএমইডি বলছে, এরমধ্যে ৩০ শতাংশ প্রকল্পই ছিল স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের– যারা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) সর্ববৃহৎ দুই ব্যবহারকারী।
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ যেখানে বেসরকারি বিনিয়োগ নিম্ন, সেখানে সরকারি বিনিয়োগ কেন গুরুত্বপূর্ণ তা ব্যাখ্যা করে আইএমইডি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, এরপরও বড় সংখ্যক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধিতে জর্জরিত। এতে সরকারি কোষাগার, অর্থনীতির সার্বিক প্রবৃদ্ধি এবং জনকল্যাণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চাপ সৃষ্টি হয়।
'এজন্য সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির প্রধান কারণগুলোকে চিহ্নিত করা এবং সরকারি কাজে এধরনের ভ্রান্ত পরিচালনা রোধে দরকারি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি'- বলেছে প্রতিবেদনটি; আগামী মাসে সরকারের এক উচ্চ-পর্যায়ের বৈঠকে এটি নিয়ে আলোচনা হবে।
বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়
ভূমি অধিগ্রহণ, অপর্যাপ্ত সক্ষমতা, অদক্ষতা, দুর্বল টেকসইতা ও এক্সিট প্ল্যান এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের মতো দীর্ঘদিন ধরে চলমান অন্যান্য বিষয়গুলোকেও গবেষণাটি চিহ্নিত করেছে।
বিশেষত, ৭২ শতাংশ কর্মকর্তা দুর্বল প্রকল্প নথিকে একটি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। ৮২ শতাংশ প্রকল্প কর্মীদের মধ্যে দক্ষতার অভাবের কথা উল্লেখ করেন। ৭৪ শতাংশ কর্মকর্তা মনে করেন, প্রকল্প কাজ ও ক্রয় পরিকল্পনা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না, এতে যেমন বাস্তবায়নে দেরি হয়, তার সাথে বাড়ে ব্যয়।
জরিপের ফলাফল ইঙ্গিত দেয় যে, সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন এবং নকশায় ত্রুটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোয় থাকা বৃহত্তর প্রতিবন্ধকতাগুলোরই অংশ।
আইএমইডি বলেছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এগুলো যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে নিয়ে সময়নিষ্ঠ ও ব্যয়-সাশ্রয়ী টেকসই সমাধান খুঁজে বের করতে কাজ করতে হবে।
সচিবকে জবাবদিহির আওতায় আনুন
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের অসামঞ্জস্যগুলো দূর করতে স্বচ্ছতার পাশাপাশি জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'জবাবদিহি সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নিশ্চিত করতে হবে। সচিব হলেন কোনো মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ নির্বাহী, তাকেই প্রথম জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত'।
জাহিদ হোসেন বলেন, জবাবদিহি নিশ্চিত হলে সচিব কোনো প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পাঠানোর আগে আরো বেশি সতর্ক থাকবেন। প্রকল্পের সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন হয়েছে কিনা, নির্মাণ কাজের নকশা যথাযথভাবে হয়েছে কিনা, ক্রয় ও কর্মপরিকল্পনা সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা এবং ভূমি অধিগ্রহণে কোনো জটিলতা আছে কিনা– এসব বিষয়ে আরো ভালোভাবে বিবেচনা করবেন তারা।
'মন্ত্রিসভায় যখন কোনো মন্ত্রীকে জবাবদিহি করতে হবে, তখন তিনি ব্যয় বা মেয়াদ বাড়ছে কিনা সেটা নিয়ে সচিবের সাথে আলোচনা করবেন' যোগ করেন তিনি।
জাহিদ হোসেনের মতে, এই জরিপে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়নি, যেটা এই অধ্যয়নের একটি সীমাবদ্ধতা।
অন্যান্য চ্যালেঞ্জ
জরিপে চিহ্নিত অন্যান্য চ্যালেঞ্জের মধ্যে ত্রুটিপূর্ণ নকশা, রাজনৈতিক বিবেচনায় গৃহীত প্রকল্প এবং পরিকল্পনা কমিশনের শিথিল তদারকিকে উল্লেখ করেছে আইএমইডি।
তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পের সম্পূর্ণ সুফল প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে একটি টেকসইতার পরিকল্পনা থাকা আবশ্যক। কিন্তু, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি)-তে এ ধরনের পরিকল্পনা অনুপস্থিত বলে মত দিয়েছেন তিন-চতুর্থাংশ অংশগ্রহণকারী।
এটি আরো বলছে, মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো প্রায়ই মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো (এমটিবিএফ) এর বাইরে প্রকল্প গ্রহণ করে। এতে প্রকল্পগুলো তহবিল সংকটে পড়ে এবং আরো বেশি বিলম্বিত হয়।
৭৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারী একমত যে, প্রকল্পগুলো এমটিবিএফ সীমা অনুসরণ করে না।
প্রকল্পের ক্ষেত্রে ইউটিলিটি পরিষেবা প্রদানকারীদের সমন্বয়হীনতার বিষয়ে প্রতিবেদনে দোহাজারী-কক্সবাজার রেল প্রকল্পের কথা উল্লেখ করা হয়। ২০১০ সালে এটির বাস্তবায়ন শুরু হলেও, বিদ্যুতের খুঁটি সরাতে সময় লেগেছে ১০ বছর।
৮০ শতাংশ কর্মকর্তা মনে করেন,বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।
এছাড়া, ৯০ শতাংশ একমত যে, নিয়োগ সমস্যা এবং প্রকল্প পরিচালক ও কর্মকর্তাদের ঘন ঘন বদলি বাস্তবায়নকে দীর্ঘায়িত করে।
