উন্নয়ন অগ্রাধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় জাইকার দুটি প্রকল্প প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন
জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে প্রস্তাবিত দুটি প্রকল্প আদৌ প্রয়োজন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা। সংস্থাগুলো বলছে, আগের ঋণের টাকাই যেখানে পুরোপুরি কাজে লাগানো যায়নি, সেখানে নতুন এই ঋণগুলো হবে আরও ব্যয়বহুল। তাদের অভিযোগ, প্রকৃত চাহিদা যাচাই না করেই তৈরি করা এই প্রস্তাবগুলো অনেকটা 'সরবরাহ-কেন্দ্রিক', যা বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রাধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা বলেন, জাইকা দুটি প্রকল্পেই সুদের হার প্রস্তাব করেছে ২.৩৫ শতাংশ, এর মধ্যে পরামর্শ পরিষেবার জন্য ০.৮০ শতাংশ। গত জুনে জাপানের ঋণের সুদহার ছিল ২ শতাংশ। এই প্রস্তাব অনুমোদিত হলে বিশ্বব্যাংক বা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সমতুল্য ঋণের তুলনায় জাইকার এই ঋণ বেশি ব্যয়বহুল হবে।
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, সম্প্রতি তিন প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে জাইকার একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে। এ সফরের পর গত ১৬ অক্টোবর ইআরডির অতিরিক্ত সচিব ও উইং চিফ (আমেরিকা ও জাপান) মো. মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে জাইকার ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের অগ্রগতি পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
টিবিএসের হাতে আসা সভার কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, ইআরডি ও বিদ্যুৎ বিভাগ দুটি প্রকল্পের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে। প্রকল্প দুটি হলো, ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন প্রজেক্ট (এফডিআইপিপি) ফেজ-২ ও পাওয়ার গ্রিড স্ট্যাবিলাইজেশন প্রজেক্ট।
ইআরডি সূত্র জানায়, এফডিআইপিপির প্রথম পর্যায়ের ২৪০ কোটি টাকা এখনও অব্যবহৃত রয়ে গেছে। তারপরও নতুন করে প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে আবার ৬০ হাজার ৫৩ মিলিয়ন জাপানি ইয়েনের (প্রায় ৪ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা) ঋণ দিতে চায় জাইকা। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) অধীনে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। ইআরডি কর্মকর্তারা বলছেন, অব্যবহৃত অর্থ আগে কাজে লাগানো উচিত।
এদিকে সভায় উপস্থিত বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা পাওয়ার গ্রিড স্ট্যাবিলাইজেশন প্রজেক্ট নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। তাদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত আলোচনা, দেশের প্রকৃত চাহিদা বা কোনো বিশদ সমীক্ষা ছাড়াই এই প্রকল্পটি এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে জাইকার ঢাকা কার্যালয় বলে, প্রকল্প প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলোচনা চলছে। তারা এ বিষয়ে বিস্তারিত মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
এফডিআইপিপি ফেজ-২
ইআরডি সূত্রমতে, এফডিআইপিপি ফেজ-২ প্রকল্পের আওতায় নারায়ণগঞ্জে বাংলাদেশ স্পেশাল ইকোনমিক জোনের (বিএসইজেড) সম্প্রসারণ, বিডার কেন্দ্রীয় বিনিয়োগ লাইসেন্সিং প্ল্যাটফর্ম বাংলাবিজ-কে শক্তিশালী করা ও প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআইমুখী শিল্পের জন্য দুই ধাপের ঋণ (টিএসএল) দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রথম পর্যায়ে স্পেশাল ইকোনমিক জোনের ৪৮০ একর জমির অফ-সাইট উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। বরত্মানে সেখানে আটটি কোম্পানি কার্যক্রম চালালেও মাত্র একটি প্রতিষ্ঠান টিএসএল সুবিধা ব্যবহার করেছে। এছাড়া একটি কাস্টমস ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, যার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দ্বিতীয় পর্যায়ের তহবিল থেকে কেনার পরিকল্পনা রয়েছে।
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, প্রথম পর্যায়ের অর্থের প্রায় ২৪০ কোটি টাকা এখনও অব্যবহৃত রয়েছে। এ কারণে সভায় মত দেওয়া হয়, এই অব্যবহৃত অর্থ দিয়েই কাস্টমস ভবনের যন্ত্রপাতি কেনা গেলে প্রকল্পের ঋণের কার্যকর ব্যবহারের নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে।
এছাড়া বিনিয়োগ সেবা একত্রীকরণের লক্ষ্যে ২০২৫ সালে বিডার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম বাংলাবিজ পুরোপুরি চালু থাকা সত্ত্বেও এর জন্য নতুন করে ঋণ নেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে সভায় প্রশ্ন উঠেছে।
এফডিআইভিত্তিক শিল্পগুলোর প্রকৃত ঋণচাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা—যা টিএসলের যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে পারে— এখনও যাচাই করা বাকি। বেসরকারি খাতের চাহিদার প্রমাণ থাকা সাপেক্ষে প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান ইআরডির কর্মকর্তারা।
সভায় সিদ্ধান্ত হয়, দ্বিতীয় পর্যায়ের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে বেজা প্রথম পর্যায়ের একটি পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন সম্পন্ন করবে। পাশাপাশি প্রথম পর্যায়ের অব্যবহৃত ঋণ ব্যবহার করে কাস্টমস ভবনের যন্ত্রপাতি কেনা সম্ভব কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে।
বিডা ও বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন টিবিএসকে বলেন, 'এফডিআইপিপির প্রথম পর্যায়ের দিকে ফোকাস করে আমরা কাজ করব। প্রথম পর্যায়ের কাজে আমাদের প্রত্যাশিত অগ্রগতি হয়নি। প্রথম পর্যায়ের লক্ষ্য হলো সাপোর্ট সিস্টেম তৈরি করা। আর দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ চলবে তার গতিতে; সেটা বন্ধ থাকবে না।'
বেজা সূত্রে জানা গেছে, স্পেশাল ইকোনমিক জোনের প্রথম ৫০০ একর জমিতে প্রথম পর্যায়ের কাজ ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত চলতে পারে। বেজার এক কর্মকর্তা বলেন, যেহেতু দুটি পর্যায়ের উদ্দেশ্য ভিন্ন, তাই এগুলো স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত হলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
পাওয়ার গ্রিড প্রকল্প
সভায় বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিনিধিরা জানান, তারা পাওয়ার গ্রিড স্ট্যাবিলাইজেশন প্রজেক্ট নিয়ে সন্দিহান এবং ঋণ নিয়ে আরও অগ্রসর হওয়ার আগে আরও অভ্যন্তরীণ আলোচনার প্রয়োজন বলে মনে করেন। তারা উল্লেখ করেন, বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে পর্যাপ্ত আলোচনা কিংবা মাঠপর্যায়ের খুব বেশি বিশ্লেষণ সমীক্ষা ছাড়াই এই প্রস্তাবটি এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো জাতীয় গ্রিডকে স্থিতিশীল ও শক্তিশালী করার মাধ্যমে এবং কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের কিছু সরঞ্জাম প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশের বৈদ্যুতিক শক্তির গুণগত মান উন্নত করা।
এ প্রকল্পে কয়েকটি উপ-প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত থাকবে, যার মধ্যে রয়েছে সঞ্চালন নেটওয়ার্ক ও সাবস্টেশনগুলোর মানোন্নয়ন; বিদ্যুৎ সরবরাহ ও চাহিদা ব্যবস্থাপনা উন্নত করা (ন্যাশনাল লোড ডিসপ্যাচ সেন্টারসহ) এবং প্রধানত কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল সরঞ্জামগুলো প্রতিস্থাপন।
সভায় বিদ্যুৎ বিভাগ প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্ত নেয়। জাইকার প্রস্তাবটি এগিয়ে নেওয়া উচিত কি না, তা ইআরডিকে অবহিত করবে বিদ্যুৎ বিভাগ।
প্রস্তাবিত প্রকল্প দুটি নিয়ে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদ্বেগের বিষয়ে লিখিতভাবে জাইকার অবস্থান জানতে চেয়েছিল টিবিএস। জবাবে জাইকার ঢাকা কার্যালয় জানায়, 'যেহেতু আপনার উল্লেখ করা প্রকল্পগুলো নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে, তাই এই মুহূর্তে আমরা নির্দিষ্ট কোনো মন্তব্য করতে পারছি না।'
সুদহার বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে জাপানি সংস্থাটি জানায়, জাপানি ওডিএ ঋণের শর্তাবলি জাইকার ওয়েবসাইটে সবার জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। 'বাংলাদেশের জন্য যে ঋণ দেওয়া হয়, তাতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) জন্য প্রযোজ্য শর্তাবলিই কার্যকর হবে।'
সভায় জাইকার আরেকটি প্রকল্প প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়—চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক উন্নয়ন (ফেজ-২) প্রকল্প। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো জাতীয় মহাসড়ক-১ প্রশস্ত করে মাতারবাড়ী বন্দরগামী পণ্য পরিবহন সহজ করা। প্রকল্পের ঋণের পরিমাণ ডিসেম্বরে চূড়ান্ত হবে এবং ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে ঋণচুক্তি সইয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বন বিভাগ এ প্রকল্পের আওতায় চুনতি অংশে ১০ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট যুক্ত করার প্রস্তাব দেয় এবং হাতির করিডরের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে চুনতি উত্তরাংশে অতিরিক্ত জরিপের অনুরোধ জানায়।
