ছয় মাসে অর্ধেকে নেমে এসেছে এলসি খোলার পরিমাণ

দেশের রিজার্ভকে সংরক্ষণে পণ্য আমদানিতে নানা শর্তারোপের কারণে এপ্রিল থেকে টানা কমতে কমতে ছয় মাসে অর্ধেকে নেমে এসেছে এলসি খোলার পরিমাণ।
চলতি বছরের মার্চে এলসি খোলা হয়েছে ৯.৮০ বিলিয়ন ডলারের। এপ্রিলে খোলা হয়েছে ৮.৪২ বিলিয়ন ডলারের এলসি। এরপর থেকে তা কমছেই।
সেপ্টেম্বরে এলসি খোলা হয়েছে ৬.৫১ বিলিয়ন ডলারের। অক্টোবরে এসে বড় ধরনের পতন হয়েছে। এ মাসে এলসি খোলা হয়েছে ৪.৭২ বিলিয়ন ডলারের।
যা গত বছরের একই সময়ে এলসি খোলা হয়েছিল ৭.৪২ বিলিয়ন ডলারে।
সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে এলসি ওপেনিং কমেছে ২.৭ বিলিয়ন বা ৩৬.৩৮%।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, ব্যাংকগুলোর ডলার সংকট থাকলেও বেশি দামে প্রবাসী রেমিট্যান্সে কিনে আমদানি দায় পরিশোধ করতো; কিন্তু এখন একক রেট হওয়ায় সেই সুযোগও বন্ধ হয়ে গেছে। যার ফলে অধিকাংশ ব্যাংকের আমদানির পরিমাণ কমে এসেছে।
এছাড়া অধিকাংশ ব্যাংকের ডলার সংকটে থাকায় আমাদানি এলসি খোলায় মনোযোগ কম বলে উল্লেখ করেন তারা।
এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার সংকট কাটাতে নানাভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করেছে। গত এপ্রিল থেকে আমদানিতে শুরু করেছে এলসি মার্জিন।
তবে নিত্য প্রয়োজনীয় আমদানি দায় মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন থেকে কমে ৩৪.২৪ বিলিয়নে চলে এসেছে।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের ট্রেজারি হেড বলেন, গত জুনের শুরুতে বড় ব্যবসায়িরা আমদানির জন্য এলসি খুলতে পারলেও ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো এলসি খুলতে সমস্যায় পড়েছে। এখন বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোও আমদানি এলসি খুলতে সমস্যায় পড়ছেন।
প্রথম প্রজন্মের একটি বেসরকারি একটি ব্যাংকের এমডি নাম নাম প্রকাশ না করা শর্তে টিবিএসকে বলেন, "দেশের রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কমার কারণে অধিকাংশ ব্যাংকের ডলার সংকটে রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২০টি ব্যাংকের ফরেন কারেন্সির নেট ওপেন পজিশন নেগেটিভ। তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার ব্যাংকে এলসি খোলার তুলনায় ডলার কিভাবে সংরক্ষণ করবো সেটা ভাবছি।"
দেশে গত অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১৫% রেমিট্যান্স কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রেমিট্যান্সের গতি কিছুটা বাড়লে গেল (সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে) রেমিট্যান্সের ব্যপক পতন হয়েছে।
গত সোমবার এমডিদের নিয়ে এক বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, "পণ্যের দর বেশি বা কম দেখিয়ে বছরের পর বছর এলসি ওপেনিং হচ্ছে।"
তিনি বলেন, কমলা, আপেল, খেজুর ও গাড়ি আমদানিতে দাম কম দেখিয়ে আন্ডার ইনভয়েসিং হচ্ছে। এর ফলে দেশে কর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়া এলসি মূল্য পরিশোধে বিদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে ডলার সংগ্রহ করছে যার ফলে দেশ রেমিট্যান্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, "এমন কাজ যারা করেছে তারা কোনভাবে দায় এড়াতে পারেনা। এলসি খোলায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
এর আগে গত ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রধান কর্মকর্তা মো. মাসুদ বিশ্বাস বলেন, "ডলার সংকটের এই সময়ে কিছু কিছু আমদানি পণ্যে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত ওভার ইনভয়েসিং হয়েছে। আর গাড়ি আমদানিতে (১৫০-৮০০) শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক থাকায় গাড়ি আমদানিকারকরা এর সুযোগ বেশি নিতে পারে। যে কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলার আসছে কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, "বাংলাদেশ ব্যাংক যে সময়ে আমদানিতে শর্তারোপ করেছে তা আরও আগে উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল। বিদায়ী বছরের আমাদের এযাবৎকালে সর্বোচ্চ বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে। এ সময়ে অনেক অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও ইনডেপ্থ দেখা উচিত যে আমদানি পণ্য আসছে তা কাজে লাকছে কিনা। মেশিন আমদানি করেছে তা কোন কাজে আমদানি করছে, নাকি মেশিং এর নামে ওভার ইনভয়েসিং করে টাকা পাচার হচ্ছে- এখনই সময় এগুলো দেখার।"
সালেহউদ্দিন বলেন, "গত বছরে প্রায় ৩৫% আমদানি বেড়েছে কিন্তু এর ফলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রডাক্টটিভিটি বেড়ে গেছে এমন তো লক্ষণ দেখছি না। এর মাধ্যমে অনেক টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। উৎপাদন বাড়াতে হলে সে সংশ্লিষ্ট আমদানি বাড়াতে হবে, না হলে মুল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে।"
এদিকে আমদানি কমলেও ডলারের সংকট কাটছে না। গত অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৭.৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। চলতি অর্থবছরে ডলার বিক্রির ক্ষেত্রে কিছুটা কার্পন্য করলেও সরকারি আমদানি ব্যয় মাটাতে ডলার বিক্রি বেড়েই যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের (জুলাই-১৬ নভেম্বর পর্যন্ত) ডলার বিক্রি হয়েছে ৫.৮৭ বিলিয়ন ডলার।
গত বছরের আগস্টে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। ১৬ নভেম্বর এসে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৪.২৪ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক বুধবার সরকারি আমদানি বাবদ প্রতি ডলার ৯৭ টাকায় বিক্রি করছে।
তবে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স কিনছে সর্বোচ্চ ১০৭ টাকায়। রপ্তানি বিল নগদায়ন হচ্ছে ১০০ টাকায়। এছাড়া ব্যাংক টু ব্যাংক ডলারের দাম ছিল প্রায় ১০৩ টাকা ৫০ পয়সা।