বেডিং ইন্ডাস্ট্রির সম্ভাবনা বাড়ছে

দীর্ঘ, ক্লান্তিকর দিনের শেষে আরামদায়ক বিছানাই স্বস্তি এনে দিতে পারে। আর গুণগন মানসম্পন্ন পণ্যের খোঁজ পেতে গ্রাহকদেরও এখন আর খুব বেশি ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয়না।
দেশে লেপ, তোশক, বালিশ, বিছানার চাদর, কম্বলসহ বেডিং মেটারিয়ালসের বার্ষিক বাজার অন্তত ৮-১০ হাজার কোটি টাকা। দীর্ঘদিন ধরেই অপ্রাতিষ্ঠানিক ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে এসব পণ্যের ব্যবসা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বড় করপোরেটদের পদচারণা শুরু হয়েছে এ খাতে।
আধুনিক ও মেডিকেল ফোম, ম্যাট্রেস, বালিশ, কম্বল, কমফোর্টার বাজারজাতকরণের মাধ্যমে বাজার দখল নিচ্ছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। কয়েক দশকে দেশে গড়ে উঠেছে অন্তত অর্ধশতাধিক বেডিং সল্যুশন পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। এ খাতে বিনিয়োগ করছে প্রাণ-আরএফএল, সোয়ান, কারমো, বেঙ্গল, এক্সপো গ্রুপ, আখতার, ইউরোএশিয়া, হোমটেক্স, ক্লাসিক্যাল হোম, জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ফেব্রিক্সের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলো।
উদ্যোক্তারা বলছেন, শুধু ম্যাট্রেস ও ফোম উৎপাদনেই অন্তত ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ এসেছে ৩০টির অধিক প্রতিষ্ঠান থেকে। বছরে ২০ শতাংশের বেশি হারে বিনিয়োগ বাড়ছে। যদিও বেডিং সল্যুশনের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত পণ্য বিছানার চাদর।
টেক্সটাইল খাতের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিচ্ছিন্নভাবে বিছানার চাদর উৎপাদনে যুক্ত হওয়ায় এবং ঢাকার ইসলাম ও বাবুবাজারের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের দ্বারা বাজার নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় এখানে বড় বিনিয়োগ নেই। তবে বছরে অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকার কম্বলের বাজারেও বিকল্প পণ্য নিয়ে আসতে শুরু করেছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো।
বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের পদচারণা
২০১৬ সালে বেডিং ইন্ডাস্ট্রিতে নামে দেশের অন্যতম কঙ্গলোমারেট প্রাণ-আরএফ গ্রুপ। এখন ফোম, ম্যাট্রেস, বিভিন্ন ধরনের বালিশ, কমফোর্টার, কাঁথা, বেবিসেট ও মশারি উৎপাদন করছে তারা। প্রথমে সীমিত পরিসরে শুরু করলেও বছরে ২০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি নিয়ে এখন আরও বিনিয়োগের কথা ভাবছে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রাণ-আরএফএলের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, স্বাস্থ্যগত কারণে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হলেও দেশে এখনো জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি ম্যাট্রেস ও ফোমের বাজার। দেশে ৩০টির মতো করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম থাকলেও বছরে মাত্র ৩০০-৩৫০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হয়।
অনানুষ্ঠানিক খাতে বাজার বেশি হওয়ায় ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠানের জন্য বড় সুযোগ রয়েছে বলে মনে করছেন তিনি। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ম্যাট্রেস, ফোম উৎপাদনে গত ১০ বছরে এ খাতে অন্তত ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। প্রাণ-আরএফএল ছাড়াও এক্সপো গ্রুপ, আখতার, ঢাকা ফোম, ন্যাশনাল ফোমের মতো প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেছে সাম্প্রতিক সময়ে। যদিও ব্র্যান্ড মার্কেটের নেতৃত্ব এখনো এপেক্স, সোয়ান, কারমো, বেঙ্গল, ইউরোএশিয়া, হোমটেক্স, ফাইবার টাচ, জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ফেব্রিক্সের হাতেই রয়েছে।
বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ফেদার, ডলি, আই-স্লিপ, মেফেয়ার কে-সহ ছয়/সাতটি কোম্পানি দেশের বাজারে ব্যবসা করছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে বড় ব্র্যান্ডগুলো বছরে অন্তত ৩ লাখ ম্যাট্রেস ও প্রায় ৪ লাখ বালিশ বিক্রি করেন। পাাঁচ বছর আগেও এ সংখ্যা অর্ধেকের কম ছিল ।
ম্যাট্রেসের বাজারের সবচেয়ে বেশি অংশের অংশীদারিত্বে থাকা ইউরোএশিয়ার হেড অব করপোরেট সুব্রত কুমার বলেন, ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো কমদামে পণ্য দিলেও স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায় এখন ভালো মানের পণ্যের বাজার বড় হচ্ছে।
ইউরোএশিয়া উচ্চ মানের পণ্য উৎপাদন শুরু করার পর বিদেশ থেকে আমদানি বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি দেশীয় বাজারও অনেক বড় হয়েছে বলে জানান তিনি।
কম্বলের বাজার এখনো আমদানি নির্ভর
ঢাকার এনেক্স টাওয়ারে ভিক্টরি ফ্যাশন ফর লাইফের স্বত্বাধিকারী এস কে শিপু প্রায় ৫ বছর ধরে চীন থেকে আমদানি করে শীতের কম্বল বিক্রি করছেন। ডিসেম্বরের শুরু থেকে জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত এ কম্বল বিক্রির কর্মযজ্ঞ চলে জানিয়ে এস কে শিপু দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন,
"নভেম্বরেই শীতের কম্বল বিক্রি শুরু হয়। তবে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে বেশি বিক্রি হয়। বছরে প্রায় ৫ কোটি টাকার কম্বল বিক্রি হয়।"
শিপুর মতোই বেচা-বিক্রি এনেক্স টাওয়ারের ৮০টি গুলিস্তানের ট্রেড সেন্টারের ১৬০টি দোকানের। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামেও রযেছে কম্বল বিক্রির এমন শতাধিক পাইকারি দোকান। যাদের কাছ থেকে পণ্য নিয়ে সারাদেশের খুচরা বিক্রেতারা ব্যবসা করেন।
মার্কেট সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বাজারে বছরে ২৫০০-৩০০০ কোটি টাকার কম্বল বিক্রি হয়। এর মধ্যে দেশীয় টেক্সটাইল খাতের কোম্পানিগুলো প্রায় ১০০০ কোটি টাকার কম্বল উৎপাদন করেন। বাকিগুলো কোরিয়া, ভিয়েতনাম, সৌদি আরব, মিশর, তুরস্ক ও চীন থেকে আসে।
বর্তমানে বিশ্বাস গ্রুপ, এবি টেক্সটাইল মিলস বাংলাদেশ, জে.আর টাওয়েলস, সিটকটেক্স, কটন ব্র্যান্ড, ফাবটেক্স এন্টারপ্রাইজ, ফায়ারটেক, জাবের অ্যান্ড জোবায়ের স্বল্প পরিমাণে কম্বল উৎপাদন করছে। তবে প্রাণ-আরএফএল, আখতার, হোমটেক্স, এক্সপো গ্রুপসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কম্বলের বিকল্প কমফোর্টার উৎপাদনে নেমেছে।
মার্কেট সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শহরের শীতের উষ্ণতায় কমফোর্টার যথেষ্ট হওয়ায় কম্বলের এ বিশাল মার্কেটে দেশীয়দের জন্য সুযোগ রয়েছে। ৫ হাজার কোটির বিছানার চাদর পণ্যের ৮০ শতাংশই নন ব্র্যান্ড পণ্য।
দেশে বেডিং সল্যুশন পণ্যের বড় প্রতিষ্ঠান পাকিজা হোম কালেকশনে প্রায় ২০ বছর বিপণন বিভাগে কাজ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক জিএম শ্যামল সাহা। শ্যামল সাহার ভাষায়, দেশের চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ যোগান দেয় রাজধানীর ইসলামপুর ও নরসিংদীর বাবু বাজারের প্রায় ৪০টির মতো অপ্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড। আর ব্র্যান্ডের পণ্যের নেতৃত্ব দিচ্ছে হোমটেক্স, পাকিজা, ক্যাসিক্যাল, জাবের অ্যান্ড জোবায়োরসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
শ্যামল সাহা বলেন, রপ্তানিতে ইনটেনসিভ সুবিধা থাকায় দেশীয় উৎপাদকরা রপ্তানি করছে। বন্ড সুবিধায় আনা কাঁচামালে স্থানীয় বাজারে বিক্রি বন্ধ থাকায় সবাই এগিয়ে আসছে না। ফলে ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান এ খাত নিয়ন্ত্রণ করছে। এর বাইরে চীন ও ভারত থেকে বিপুল পরিমাণে বিছানার চাদরসহ বেডিং সল্যুশন পণ্য দেশে আসছে বলে জানান তিনি।
রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার নীলক্ষেত সিটি কর্পোরেশন মার্কেটে ৩৫ টির মতো দোকান নিয়ে গড়ে উঠেছে বড় বেডিংয়ের বাজার। এখানে পাইকারি এবং খুচরা মূল্যে পণ্য বিক্রি করে ব্যবসায়ীরা। ম্যাট্রেস, বালিশ, বিছানার চাদর, বালিশ কাভার, পর্দা, মশারি ইত্যাদি বিক্রি হয়; যার বড় অংশই নন ব্র্যান্ডেড পণ্য।
ঢাকার সিটি করপোরেশন মার্কেটের মেসার্স বিসমিল্লাহ বেডিং সেন্টারের স্বত্তাধিকারী গাজী মো. হানিফ জানান, আমরা বছরে অর্ধকোটির বেশি মূল্যের পণ্য বিক্রি করি। এর মধ্যে বড় অংশই দেশীয় প্রতিষ্ঠানের। এছাড়া ভারত ও চীন থেকে কিছু কাপড় আসে।
নিউ মার্কেটের মতোই বেডিং সল্যুশনের বাজার গড়ে উঠেছে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, মীরপুরের মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটসহ ঢাকার কয়েকটি স্থানে। ঢাকার বাহিরেও রয়েছে কয়েক হাজার দোকান। বছরে বিক্রি হয় অন্তত ৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য।
বিপুল সম্ভাবনা
দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভবের সঙ্গে মানুষের রুচিবোধের পরিবর্তনে বাড়ছে সৌখিন পণ্যের চাহিদা। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যগত বিষয় চিন্তা করে মান সম্মত পণ্যই বাছাই করছেন ক্রেতারা। আর একারণেই ম্যাট্রেস, ফোমসহ দামি বেডিং সল্যুশনে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বেডিং সল্যুশন ইন্ডাস্ট্রির বড় প্রতিষ্ঠান এক্সপো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার আসাদ উদ্দিন বলেন, নিরুপদ্রব ঘুমের জন্য একটি স্বাস্থ্যসম্মত বিছানা দরকার। এজন্য এসব পণ্য এখন আর বিলাসবহুল দ্রব্য নয়। একারণেই মেডিকেল ম্যাট্রেসের চাহিদা বাড়ছে, বছরে ২০ শতাংশ হারে বাজার বড় হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিআই সহ সভাপতি মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান বলেন, হাই-এন্ডের পণ্য খুব সীমিত সংখ্যক মানুষের চাহিদায় থাকায় দেশের বাজারের জন্য বড় ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেনি।
"তবে এখন দৃশ্য পাল্টাছে। দেশে ব্র্যান্ড তৈরি হচ্ছে, এসব পণ্য কিনতে মানুষও ব্র্যান্ডের দিকে ঝুঁকছে।" যোগ করেন তিনি।