বিশেষায়িত টেক্সটাইল খাতে সরকারি সহায়তা বৃদ্ধির সুপারিশ

রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের উভেন পোশাকের এক-তৃতীয়াংশ কাঁচামালের যোগানদাতা দেশের স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে হুমকির মধ্যে পড়েছে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে সরকারি সংস্থা- রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)।
তারল্য সংকট ও ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বিশেষায়িত টেক্সটাইল মিলগুলো সুতা থেকে কাপড় বা উভেন ফেব্রিক প্রস্তুত করতে পারছে না জানিয়ে; এখাতের সক্ষমতা বাড়াতে সরকারকে বিশেষ সহায়তা দিতে সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের অন্যতম অংশ উভেন পোশাকের কাঁচামাল বা ফেব্রিক যোগান দেওয়া ছাড়াও সরাসরি ফেব্রিক রপ্তানিও করে থাকে স্পেশালাইজড টেক্সটাইলখাত। গত অর্থবছরে এখাতের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৩১ মিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল ১১৬ মিলিয়ন ডলার।
এছাড়া ২০২১ অর্থবছরে উভেন গার্মেন্টস রপ্তানি করে আয় হয়েছে ১৪,৪৯৬ মিলিয়ন ডলার; যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৩৭ শতাংশ। রপ্তানিকৃত বস্ত্রের এক-তৃতীয়াংশ বা ৪,৮৩২ মিলিয়ন ডলারের কাঁচামাল দেশের বিশেষায়িত টেক্সটাইল খাত থেকে আসে। বাকিটা দেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়েছে।
'প্রধান প্রধান পণ্যসমূহের রপ্তানি হ্রাসের কারণ এবং বাধা দূর করার জন্য সুপারিশ বাস্তবায়ন' শিরোনামে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দেওয়া প্রতিবেদনে স্পেশালাইজড টেক্সটাইল খাতে বিশেষ সহায়তা দেওয়ার সুপারিশের পাশাপাশি প্লাস্টিক, ফার্ণিচার, জীবন্ত ও হিমায়িত মৎস্য, শাক-সবজি ও ফলমূল রপ্তানি বাড়াতে নগদ প্রণোদনা বাড়ানোর বিভিন্ন নীতি-সহায়তা দেওয়ার সুপারিশ করেছে ইপিবি।
প্রতিবেদনটি তৈরির আগে রপ্তানিমুখী খাতগুলোর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান এ এইচ এম আহসান।
ইতঃপূর্বে করোনা মহামারির মধ্যে শ্রমিকদের বেতন দিতে সরকারের দেওয়া সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা তহবিল সহযোগিতার সিংহভাগই পেয়েছে তৈরি পোশাক কারখানাগুলো।
এছাড়া, সরকারের ৪০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঋণ পেয়েছে তৈরি পোশাক খাত। সে তুলনায় বিশেষায়িত টেক্সটাইল এবং অ্যাপারেল এক্সেসরিজ শিল্পের বড় অংশই কোনো প্রকার প্রণোদনা সহায়তা পায়নি।
এব্যাপারে, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলস অ্যান্ড পাওয়ার লুম ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ শামিম রেজা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, অধিকাংশ বিশেষায়িত টেক্সটাইল মিলের এখন রুগ্ন দশা। ঋণ খেলাপির কারণে এখাতের একটি বড় অংশ সরকারের প্রণোদনা সহায়তাও পাচ্ছে না।
এরফলে যে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে; তাতে করে অনেক কারখানাকে উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়েছে। তার ওপর সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বাজারে ইয়ার্ন বা সুতার অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধিও দুর্দশার বোঝা বাড়িয়ে তুলেছে, যোগ করেন তিনি।
এছাড়া, গার্মেন্টস কারখানাগুলো বন্ড সুবিধায় আমদানি করা ফ্যাব্রিক স্থানীয় বাজারে বিক্রি করায় দেশের বিশেষায়িত টেক্সটাইল মিলগুলো তাদের উৎপাদিত ফ্যাব্রিক দেশের বাজারে বিক্রি করতে পারছে না, বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
গার্মেন্টস কারখানাগুলোর এই অসাধু চর্চা বন্ধে তারা বারবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) অনুরোধ করেছেন বলেও জানান শামিম রেজা।
এব্যাপারে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ- এর প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম টিবিএস'কে বলেন, "আমরা ভারত থেকে কেজিপ্রতি ৩.২২ ডলারে ইয়ার্ন আমদানি করি। কিন্তু, স্থানীয় স্পিনিং মিলগুলো আমাদের কাছে সাড়ে ৪ ডলারের কম দামে ইয়ার্ন বিক্রিই করতে চায় না।"
এত বেশি মূল্যে কেনা সুতা দিয়ে ফ্যাব্রিক প্রস্তুত করে বিশেষায়িত টেক্সটাইল কারখানাগুলো উচ্চমূল্যে বিক্রি করতেও পারে না- জানিয়ে হাতেম বলেন, "চীন থেকে আরও কম দামে ফ্যাব্রিক আমদানি করা যায়। তাই ইয়ার্নের মূল্যবৃদ্ধি শুধু নিটওয়্যার রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত করছে না বরং বিশেষায়িত টেক্সটাইল মিলগুলোর অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলেছে।"
ইপিবি-ও বলেছে, বন্ড সুবিধার আওতায় কাপড় আমদানির কারণেও স্পেশালাইজড টেক্সটাইল সেক্টরের পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। তাছাড়া তারল্য সংকট ও মেশিনারিজের দাম বৃদ্ধি এবং ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোরে ফ্যাক্টরি স্থাপনের বাধ্যবাধকতাসহ বিভিন্ন কারণে এ সেক্টরটি প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে হুমকির মুখে পড়েছে।
দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন কাঁচামাল সরবরাহ অব্যাহত রাখার স্বার্থে এবং ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে এখাতের সক্ষমতা বাড়াতে সরকারকে বিশেষ সহায়তা দেওয়ার সুপারিশ করেছে ইপিবি।
বড় অঙ্কের নগদ প্রণোদনার সুপারিশ:
সরকারি সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৯৫ শতাংশ অর্জিত হয় আটটি খাত থেকে। যার মধ্যে তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য এবং হিমায়িত খাদ্য অন্যতম। এসবখাতের রপ্তানি আয় হ্রাস পেলে তা মোট রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
কোভিড পরিস্থিতিতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আগের অর্থবছরের দূর্বল ভিত্তি সত্ত্বেও গত অর্থবছর জীবন্ত মাছ, চিংড়ি, কার্বস, শাক-সবজি, সিমেন্ট, পেপার ও পেপার প্রোডাক্টস ও টেরিটাওয়েল রপ্তানি কমেছে।
ইপিবি বলেছে, কোভিড পরিস্থিতিতে নিটওয়্যার রপ্তানি বাড়লেও, উভেন পোশাকের রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে। কোভিডের কারণে উভেন আইটেম- ফরমাল শার্ট, ট্রাউজার, জিন্স প্যান্ট ইত্যাদির চাহিদা কমে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয় ইউনিয়নের বাজারে খুচরা বিক্রি হ্রাস আর ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর 'গো স্লো' নীতির কারণে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
সুতার দাম বাড়ায় নিটওয়্যার রপ্তানি হুমকির মধ্যে পড়তে পারে আশঙ্কা করে সংস্থাটি বলেছে, 'প্রধান আইটেম নিটপণ্যের রপ্তানি স্থিতিশীল হলেও- সাপ্লাই চেইন ও সুতার দাম বৃদ্ধি, কন্টেইনারের ভাড়া দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এ পণ্যটির রপ্তানি হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।'
গত অর্থবছর তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ১২ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হলেও লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় ৮ শতাংশ পিঁছিয়ে ছিল রপ্তানি আয়ের পরিমাণ।
ইপিবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্লাস্টিক বর্জ্য বা পেট ফ্লেক্স রপ্তানি মূল্য হ্রাস, জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি, ট্রান্সশিপমেন্ট পয়েন্টে পোর্ট স্থবিরতার কারণে বিশ্ববাজারে মূল্য প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না খাতটি।
এ পণ্যটিতে প্রায় শতভাগ মূল্য সংযোজন হয় এবং বহু লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। তাই পেট ফ্লেক্স এর রপ্তানি প্রণোদনার হার ২০ শতাংশে উন্নীত করার সুপারিশ করেছে ইপিবি। এখাতের রপ্তানিকারকরা বর্তমানে ১০ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা পাচ্ছেন।
প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানিকারকরা বলছেন, আগে ভারত ও চীনে রপ্তানি হলেও যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ভিয়েতনাম, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক, রাশিয়া, পোল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে পেট ফ্লেক্সের নতুন বাজার সৃষ্টি হয়েছে। এসব দেশ থেকে অর্ডার আসাও শুরু হয়েছে, তবে মূল্য হ্রাস পেয়েছে।
চিংড়ি রপ্তানিতে দ্বিগুণ প্রণোদনার প্রস্তাব:
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয় ইউনিয়ন ও এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কোভিড পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পরও বাংলাদেশের হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ এবং চিংড়ি রপ্তানি পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি।
কোভিডের কারণে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতিতে বিলাসী খাদ্যের চাহিদা হ্রাস ও অর্ডার বাতিল হওয়ায় এসব পণ্য রপ্তানি এখনও নেতিবাচক অবস্থায় রয়েছে বলে মনে করছে ইপিবি।
হিমায়িত ও জীবন্ত মাছসহ চিংড়ি রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনা বিদ্যমান ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করার প্রস্তাব করে সংস্থাটি বলেছে, মধ্যমেয়াদে চিংড়ি উৎপাদনে কৃষকদের ঋণ সহায়তা বাড়ানো ও সেমি ইনটেনসিভ খামার স্থাপনে সরকারি সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে ভেনামি প্রজাতির চিংড়ি চাষের অনুমতি দিতে সুপারিশ করেছে ইপিবি।
কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানি সম্পর্কে ইপিবি বলেছে, বাংলাদেশ হতে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, হংকং এ রপ্তানির ক্ষেত্রে তুলনামুলকভাবে খরচ বেশি। এসব দেশ থেকে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে পুনঃরপ্তানি হয়ে থাকে। অন্যদিকে, চীনে এ পণ্যটি রপ্তানি নিষিদ্ধ ছিল। কার্গো ফ্লাইট ও প্যাসেঞ্জার ফ্লাইট না থাকা এবং মূলধনের অভাবে খাতটি ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।
সংস্থাটি বলছে, 'মোট রপ্তানির তুলনায় এখাতের অবদান বড় না হলেও করোনার কারণে খাতটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রপ্তানিতে ব্যাপক চাহিদা থাকায় প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রেখে কাঁকড়া ও কুঁচে চাষের উদ্যোগ নেওয়া ও প্রক্রিয়াকরণ কারখানা গড়ে তুলতে সরকারের সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। এছাড়া, নিরবচ্ছিন্ন রপ্তানির স্বার্থে কার্গো ফ্লাইট চালু রাখা ও উদ্যোক্তাদের ঋণ সহায়তা দেওয়া জরুরি।'
বিমান ভাড়া বৃদ্ধিতে ব্যাহত হচ্ছে শাকসবজি রপ্তানি প্রবৃদ্ধি:
বিপুল সম্ভাবনা সত্ত্বেও বাংলাদেশ শাকসবজি ও ফলমূল রপ্তানি না বাড়ার কারণ সম্পর্কে ইপিবি বলেছে, বিমানে পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি ও বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকায় প্যাকিং হাউজ না থাকার কারণে রপ্তানি বাড়ছে না।
এছাড়া, পান ও সবজির স্যালমোলিনা ও হেভি মেটাল পরীক্ষার জন্য এক্রিডিটেড ল্যাবের অভাব এবং কোভিডের সময় টেস্টিংয়ের খরচ বৃদ্ধিও রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাবের বড় কারণ।
রপ্তানিকারকদের তথ্য মতে, বাংলাদেশের শাকসবজির অন্যতম বাজার সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্য। একমাত্র সৌদি আরবে পান রপ্তানি চালু আছে। তেজগাঁওয়ে মনোনিত একটি ল্যাব ছাড়া; অন্য কোন ল্যাব রিপোর্ট দেশটি গ্রহণ করে না। আলু সম্ভাবনাময় পণ্য হলেও দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপ ও রাশিয়ায় রপ্তানি বন্ধ আছে।
সবজি ও ফলমূল রপ্তানি বাড়াতে বিমানবন্দর এলাকাসহ রপ্তানির উদ্দেশ্যে উৎপাদন এলাকাভিত্তিক প্যাকিং হাউজ গড়ে তোলা, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শাকসবজি রপ্তানির ক্ষেত্রে বিমানে পরিবহন করা এবং স্যালমোলিনা ও হেভি মেটাল পরীক্ষার জন্য এক্রিডেটেড ল্যাব স্থাপনের সুপারিশ করেছে ইপিবি।
ফার্নিচার শিল্পের প্রয়োজন 'সহনশীল' আমদানি শুল্ক সহায়তা:
আমদানি করা কাঁচামালের উপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপের কারণে বাংলাদেশের ফার্ণিচার পণ্য আন্তর্জাতিক মূল্য প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না বলে মনে করে ইপিবি।
সংস্থাটি বলেছে, 'ডিউটি ড্র-ব্যাক সুবিধা পাওয়া অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের ফার্ণিচার শিল্পগুলো শতভাগ রপ্তানিমুখী প্ল্যান্ট স্থাপনে সক্ষমতা অর্জন করেনি। তাই বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা পাওয়া অনিশ্চিত।'
ফার্ণিচার রপ্তানি বাড়াতে আমদানি পর্যায়ে কাঁচামালের উপর শুল্ক সহনশীল রাখার পরামর্শ দিয়েছে ইপিবি।