দ্রুত ফলনশীল বিনা-১১ চাষে বোরোর আগে হবে আরেকটি ফসল

সারাদেশেই আমন মৌসুমের ধান যখন শীষ বের হওয়া ও ফুল হওয়ার পর্যায়ে রয়েছে তখন ময়মনসিংহের সদর উপজেলার বেশ কয়েকজন কৃষক পাকা ধান কাটছেন। স্বল্প জীবনকালের নতুন জাত বিনা ধান-১১ চাষ করে ২৫-৩০ দিন আগেই কৃষকরা ধান ঘরে তুলতে শুরু করেছে। এর মাধ্যমে বোরো মৌসুমের আগে পতিত জমিতে আরও একটি ফসল চাষের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার কৃষক মো. আবু সায়ীদ ৩৩ শতাংশ জমিতে বিনা ধান-১১ চাষ করেছেন। গত রোববার সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, কাটার উপযোগী পাকা ধানগুলো বাতাসে দোল খাচ্ছে। এই কৃষক দু'একদিনের মধ্যেই ধান কাটবে বলে জানান প্রতিবেদককে।
অথচ পাশের জমিতে অন্য এক কৃষক ব্রি-৫১ ধানের চাষ করছেন, কেউ আবার স্থানীয় জাতের ধান লাগিয়েছেন। কিন্তু সেগুলোতে এখন পর্যন্ত দু-একটি ধানে মাত্র ফুল ফুটতে শুরু হয়েছে। ধানের শীষ গঠন হওয়া থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ পাকা পর্যন্ত আরও প্রায় ২৫ দিনের মত সময় লাগবে।
মো. আবু সায়ীদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "দ্রুত ধান পাকার কারণে জমিতে এখন সরিষার চাষ করব। সরিষার চাষ শেষে বোরো ধানের মৌসুম শুরু হবে। কিন্তু যাদের ধান আরো এক মাস পর পাকবে তাদের বোরোর আগ পর্যন্ত জমি পতিত রাখতে হবে।"
পাশের জমিতে ব্রি-৫১ ধান চাষ করেছেন, মো. রুবেল। তিনি বলেন, "আমার জমিতে ধানের শীষ বের হতে এবং ফলন আসতে আরও ২৫-২৬ দিন সময় লাগবে। সে সময় আর সরিষা লাগানোর সুযোগ থাকবে না। বোরো মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।"
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) কর্মকর্তারা জানান, আমন মৌসুমে চাষ উপযোগী বন্যা সহিষ্ণু বিনা ধান-১১ এর জীবনকাল ১১০-১১৫ দিন। যেখানে আমন মৌসুমের সাধারণ ধানের জীবনকাল ১৩০-১৩৫ দিন। জীবনকাল ছোট হওয়ার কারণে এই জাতের ব্যবহারকারীরা আমন ও বোরো মৌসুমের মাঝখানে আরও একটি ফসলের চাষ করতে পারছেন। কিন্তু সাধারণ জাতের ধানের চাষাবাদ যারা করছেন তারা আমন ও বোরোর মাঝামাঝি সময়ে জমি পতিত রাখেন।
বিনার বিজ্ঞানীরা ভিয়েতনাম থেকে একটি জাত নিয়ে আসেন। পরে সেটি গবেষণার মাধ্যমে স্থানীয় আবহাওয়ায় চাষ উপযোগী করতে কাজ শুরু করেন। জাতটির জীবনকাল কমিয়ে এনে ২০১৪ সালে সাধারণ কৃষকদের জন্য অবমুক্ত করার অনুমতি পায় বিনা। তবে প্রায় ৭ বছর আগে জাতটির উদ্ভাবন হলেও বিনা ধান-১১ মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণে বছর দুয়েক হলো কাজ শুরু করেছে উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠান।
বিজ্ঞানীরা জানান, একেকটি জাত উদ্ভাবন থেকে মাঠ পর্যায়ে নিয়ে আসতে অন্তত ৮-১০ বছর পর্যন্ত সময় লাগে।
বছর দুয়েক ধরে জাতটি ছড়িয়ে দিতে বিনা ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) একসঙ্গে কাজ করছে। তবে এই জাতটির চাহিদা তৈরি হলেও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) খুব বেশি বীজের যোগান দিতে পারছে না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এ বছর তারা বেশ কয়েকটি জেলার এক হাজার কৃষককে চাষাবাদের জন্য বিনামূল্যে বীজ সরবরাহ করেছে।
বিনার মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "আমরা এই জাতটির সম্প্রসারণে কাজ করছি। স্বল্প সময়কালের এই জাতটি চাষ করলে কৃষক উপকৃত হচ্ছে, কারণ তারা বোরো মৌসুমের আগে আরও একটি ফসল করার সুযোগ পাচ্ছেন।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, দেশে প্রতি বছর বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা ও বন্যায় প্রায় ২.০ মিলিয়ন হেক্টর জমির ধান আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। জলবায়ু পবিবর্তনের প্রভাবে এই ক্ষতির পরিমাণ প্রতিনিয়তই বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে জলবায়ু সহিষ্ণু জাতের গুরুত্বও প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তারা আরও জানান, বাংলাদেশে আমন মৌসুমের শুরুর দিকে বন্যার প্রবণতা থাকে। যে কারণে অনেকেই আমনের আবাদই করতে পারে না। বিশেষ করে যেসব এলাকায় নীচু জমি ও চরাঞ্চল রয়েছে। ২০-২৫ দিনের জলমগ্নতা সহ্য করতে পারে বিনা ধান-১১। ধানের গাছ কোনো কারণে পানিতে ডুবে পাতা পঁচে গেলেও তা পুনরায় জন্মায়। এর জন্য নতুন করে রোপন করার প্রয়োজন পরে না।
ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, "বিনা ধান-১১ হাই ইল্ডিং ভ্যারাইটি। ফলে কৃষকরা নিজেরাই পরবর্তী চাষের জন্য নিজেরাই বীজ সংরক্ষণ করতে পারে। অন্য জাতের তুলনায় এটি চাষে খরচও কম। দুই ফসলি থেকে তিন ফসলে রূপান্তরের কারণে কৃষকের আয়ও বৃদ্ধি পায়।"
সদর উপজেলার কয়েকটি জমিতে দেখা গেছে, পাকা ধানের কিছু অংশ চিটা হয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা জানান, ৫-৬ শতাংশ ধান চিটা হয়েছে। তবে ফলন বেশ ভালো হয়েছে বলে কৃষকরা খুশি।
ধানের চিটা হওয়ার বিষয়ে ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, "বিনা ধান-১১ এর বীজতলায় চারা রাখতে হয় ২০-২২ দিন। এই চারাগুলো একটু বেশি সময় রাখার কারণে কিছুটা চিটা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে কৃষকদের সচেতন করতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি আমরা।"
বিনা ধান-১১ চাষ করা আরেকজন কৃষক নূরুল ইসলাম বলেন, "সরিষা করলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। সরিষার অনেক পাতা, ডাল জমিতে পরলে তা জৈবসার হিসেবে কাজ করে। একই সঙ্গে মাটির অনেক উপাদান সরিষা ব্যবহার করে না। যে কারণে সরিষা পরবর্তী ফসলে জমিতে সার বাবদ খরচ কম লাগে।"