বোরোর ফলন ভালো হওয়ায় কমছে চালের দাম, তবে ধানের মূল্য নিয়ে শঙ্কায় কৃষকরা

বোরো মৌসুমের ধান কাটা চলছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলনও হয়েছে ভালো। নতুন চাল বাজারে আসায় কমতে শুরু করেছে চালের দাম। তবে ধানের দাম কমে যাওয়ায় শঙ্কা প্রকাশ করেছেন কৃষকরা। ধান কাটা পুরোদমে শুরু হলে দাম আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
সপ্তাহের ব্যবধানে মিল ও পাইকারি পর্যায়ে চালের দাম কেজিতে ২-৫ টাকা কমেছে। খুচরা বাজারে এখনও এই দাম কমার প্রভাব পড়েনি। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, পুরোদমে বাজারে বোরো চাল এলে দাম আরও কমে আসবে।
রাজধানীর পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি ব্রি-২৮ বিক্রি হচ্ছে ৫৮-৬০ টাকায়, গুটি স্বর্ণা ৫৩-৫৪ টাকা এবং প্রতি কেজি পাইজাম ৫৫-৫৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সপ্তাহখানেক আগে এসব চাল পাইকারি পর্যায়ে কেজিতে আরও ৩-৪ টাকা বেশি দামে বিক্রি হয়েছে। এছাড়া মিনিকেট মান ভেদে ৮০-৮২ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ছিল ৮৮-৯০ টাকা।
গত অক্টোবর থেকেই বাড়তে শুরু করে চালের দাম। আমনের চাল বাজারে আসার পরও দাম কমেনি।
কারওয়ানবাজারের বিক্রেতা মো. শাওন টিবিএসকে বলেন, 'নতুন চাল আসায় মিলগেটে দাম কমে এসেছে। গত কয়েকদিনে চিকন চালের দাম কেজিতে ৮-১০ টাকা কমেছে। বোরো চাল পুরোদমে উঠলে দাম আরও কমে আসবে।'
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, এ বছর ৫০.৪৬ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ করেছেন কৃষকরা। এর মধ্যে ১২.১৩ লাখ হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে। এতে ফলন হয়েছে ৫৩.১৬ লাখ টন। এবারের বোরো মৌসুমে সারা দেশে ২.২৬ কোটি টন চাল উৎপাদন হতে পারে।
নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার টিবিএসকে বলেন, 'জিরাশাইল-কাটারীভোগ এসব চালের দাম কেজিতে ৮-১০ টাকা কমে এসেছে। মোটা চাল কেজিতে ২-৩ টাকা কমেছে। কৃষকদের থেকে এখন ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা মণ দরে চাল কিনছেন ব্যবসায়ীরা।'
তবে কৃষকরা বলেন, মৌসুমের শুরুতে যে দামে ধান বিক্রি হয়েছে, এখন দাম প্রতি মণে তারচেয়ে ২০০-২৫০ টাকা কমে গেছে। আগের বছরের চেয়ে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ধামের দাম কমে যাওয়াটা তাদের জন্য হতাশাজনক।
কৃষকরা কেন আশঙ্কায়?
এ বছর বোরো মৌসুমে প্রতি কেজি ধান ৩৬ টাকায় সংগ্রহ করবে সরকার—যা আগের বছরের চেয়ে ৪ টাকা বেশি। সেই হিসাবে, প্রতি মণ ধানের দাম পড়ছে ১ হাজার ৪০০ টাকা। খোলাবাজারে ভেজা ধান ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা এবং শুকনো ধান ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে।
কৃষকরা বলছেন, সরকারি গুদামের চাহিদা অনুযায়ী ধান প্রস্তুত করতে গেলে প্রতি মণে আরও ৫-৭ কেজি কমে যায়। এছাড়া সরকারি গুদামে ধান বিক্রিতে বাড়তি পরিবহন খরচ, বিক্রয়ে অনিশ্চয়তা এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ নানা প্রক্রিয়াগত জটিলতায় পড়তে হয়। এ কারণে খোলাবাজারেই ধান বিক্রি করছেন অনেকে।
সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার মনুয়া গ্রামের কৃষক আনিসুল হক চৌধুরী বলেন, 'একজন কৃষক দেড় মণ ধান বিক্রি করতে পারবেন। মাত্র দেড় টনের জন্য বাড়ি থেকে উপজেলা সদরে ধান নিয়ে বিক্রি করে গাড়ি ভাড়া, নৌকা ভাড়া ও শ্রমিকের খরচ দিয়ে লাভ থাকবে না। আরও নানান জটিলতা রয়েছে। এ কারণে খোলা বাজারে বিক্রি করে দিয়েছি।'
সুনামগঞ্জের ধান চাল ক্রয় কমিটির সদস্য সচিব জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হুমায়ুন কবির বলেন, মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান সংগ্রহ করার সুযোগ নেই।
'কারণ স্থানীয়ভাবে ধান ক্রয় করে মজুত করা ও উপজেলা সদরের খাদ্য গুদামে আনার জন্য পরিবহন ব্যবস্থা নেই আমাদের,' বলেন তিনি।
নওগাঁর সদর উপজেলায় বর্তমানে শুভলতা ধান প্রতি মণ ১ হাজার ১০০ টাকা এবং জিরাশাইল ১ হাজার ২৫০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কয়েকদিনের ব্যবধানে প্রতি মণে ২০০-২৫০ টাকা কমেছে দাম।
ভীমপুর গ্রামের কৃষক গোলাম মোস্তফা বলেন, 'দুই দিন আগেও ধানের দাম একটু বেশি ছিল। কিন্তু হঠাৎ কমে গেছে। ধানের দাম এত কম থাকলে চাষিরা লোকসানে পড়বেন।'
তিনি জানান, ধান কাটার শুরুতে প্রতি মণ শুভলতা জাতের মণ ছিল ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৩৫০ টাকা করে। 'সরকারিভাবে তদারকি না করলে কৃষকরা নিঃস্ব হয়ে যাবেন।'
তিনি আরও বলেন, গত বছরের এই সময়ে কোনো জাতের ধানই ১ হাজার ২০০ টাকা মণের নিচে বিক্রি হয়নি। 'এ বছর উৎপাদন খরচ আরও বেড়েছে। শ্রমিক পাওয়া যায় না। কিন্তু ফলন ভালো হলেও এই দামে লোকসান গুনতে হবে।'
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রিবিজনেস অ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম টিবিএসকে বলেন, 'কৃষক বিক্রি করতে গেলে দাম কমে যাওয়া এবং কৃষকের হাত থেকে পণ্য ব্যবসায়ীদের হাতে গেলে দাম বেড়ে যাওয়া—এটা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। প্রতিটি পণ্যের ক্ষেত্রেই আমরা এটা দেখি। ফলন ভালো হলেও কৃষক লোকসানে থাকেন।'
'এরজন্য আসলে একক কোনো সমাধান নেই। কৃষকের হারভেস্ট করার পর তাৎক্ষণিক টাকার প্রয়োজন হয়, এ কারণে তিনি কম দামে বিক্রি করে দেন। তার সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকে না। যদি সংরক্ষণের সুবিধা এবং এর জন্য ঋণ ব্যবস্থা চালু করা যায়, তাহলে একটা সমাধান আসবে। তবে এর জন্য বড় অঙ্কের বাজেট প্রয়োজন হবে,' বলেন তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. ওবায়দুর রহমান মন্ডল বলেন, 'এবার আবহাওয়া ভালো ছিল, এ কারণে ফলনও ভালো হয়েছে। কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে এবার সরকারিভাবে কেজিতে ৪ টাকা বেশি দাম দিয়ে ধান সংগ্রহ করা হবে। তবুও কিছু সমস্যা থেকে যায়। তবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে কাজ করে যেতে হবে। '
[প্রতিবেদনটি তৈরি করতে সহযোগিতা করেছেন টিবিএসের বগুড়া প্রতিনিধি খোরশেদ আলম, সিলেট প্রতিনিধি দেবাশীষ দেবু এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি আজিজুল সঞ্চয়]