আমদানি করা দামি গর্জন কাঠ এখন জ্বালানি হিসেবে নিলামে তোলা হবে

মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন বন্দর থেকে ২০১২ সালে সমুদ্রপথে গর্জন কাঠ আমদানি করে ঢাকার আমদানিকারক গোমতি টিম্বার কমপ্লেক্স। ৫ হাজার ৩৪১ মেট্রিক টন ওজনের ১৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা মূল্যের কাঠের এই চালান বন্দর থেকে খালাস না নেওয়ায় ৭ বছরে আটবার নিলামে তোলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস।
আমদানিকারকের রিট মামলা, রায়ের পরও খালাস না নেওয়া, নিলামে কাস্টমসের কাঙ্ক্ষিত মূল্য না পাওয়া এবং পরবর্তীতে পণ্য ছাড়ে উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের (প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টিন স্টেশনের) অনুমতি না পাওয়ায় খালাস দিতে পারেনি কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
পরবর্তীতে প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টিন স্টেশন জ্বালানি হিসেবে কাঠগুলো নিলামের অনুমতি দেয়। ততদিনে পচে নষ্ট হয়ে গেছে এই কাঠ। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নভেম্বরে গর্জন কাঠের এই বিশাল চালান জ্বালানি কাঠ হিসেবে নিলামে তুলছে।
গর্জন কাঠ বাংলাদেশে দরজা, চৌকাঠ এবং অন্যান্য ফার্নিচার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর এবং টেকনাফের স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে এই কাঠ আমদানি করে থাকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
শুধু এই গর্জন কাঠই নয়, নানা আমলাতিন্ত্রক জটিলতা, পণ্য খালাসে একাধিক সংস্থার অনুমতি, রিট মামলার কবলে পড়ে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রায় ৭ হাজার কন্টেইনার পণ্য নিলামের অপেক্ষায় আছে। এছাড়া কারনেট ডি প্যাসেজ সুবিধায় দেশে আসা ১১০টি বিলাসবহুল গাড়িও বন্দরে পড়ে আছে ১০ বছর ধরে। চারবার নিলামের পরও আইনী জটিলতায় বিক্রি না হওয়ায় অধিকাংশ গাড়ি রাস্তায় চলাচলের উপযোগিতা হারিয়েছে। ৩ ও ৪ নভেম্বর অনলাইন নিলামে এসব গাড়ি বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে কাস্টম কর্তৃপক্ষ।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে কাস্টমসের পুরোনো নিলাম শেডে নষ্ট হয়ে যাওয়া ১৪৬টি গাড়ি সহ বিপুল পরিমাণ পণ্য দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এসব পণ্য দ্রুত নিলামে তুলে জায়গা খালি করতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের নতুন নিলাম শেডে পড়ে থাকা কাঠগুলোও নিলামে তোলা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে গর্জন কাঠের নিলাম সংক্রান্ত নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১২ সালের ২ ডিসেম্বর দাখিল হওয়া কাঠের চালানের একটি বিল অব এন্ট্রিতে উল্লেখ আছে, প্রতি মেট্রিক টন কাঠের শুল্ক সহ মূল্য ২৭ হাজার ১৪৮ টাকা। সেই হিসেবে ৫ হাজার ৩৪১ মেট্রিক টন কাঠের মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১৪ কোটি ৪৯ লাখ ৯৭ হাজার টাকা।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্যমতে, ২০১৩ সালে কাঠগুলো নিলামে তুললে আমদানিকারক হাইকোর্টে রিট আবেদন করে। হাইকোর্ট আদেশের এক মাসের মধ্যে পণ্য চালানটি কাস্টম ডিউটি এবং সকল প্রকার চার্জ পরিশোধ করে আমদানিকারকের অনুকূলে খালাসের নির্দেশনা দেয়। রায় আমদানিকারকের পক্ষে গেলেও পরবর্তীতে পণ্য চালানটি আমদানিকারক আর খালাস নেয়নি।
এরপর ২০১৮ সালে দুই বার এবং ২০১৯ সালে ৫ বার সহ মোট ৮ বার নিলামে উঠে। নিলামে কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ায় পণ্য ছাড় দিতে পারেনি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। ২০১৯ সালে কাঠের সর্বশেষ নিলামে ৫২ লাখ ৯৭ হাজার টাকায় কাঠগুলোর সর্বোচ্চ দরদাতা নির্বাচিত হয় চট্টগ্রামের মধ্যম গোসাইলডাঙ্গা এলাকার নুরুল আমিন নামে এক ব্যক্তি।
কিন্তু চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টিন স্টেশনের উক্ত কাঠ নষ্ট এবং পোকামাকড় ও রোগজীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হওয়ায় ব্যবহার যোগ্য নয় । তাই ছাড়পত্র প্রদানের সুযোগ নেই বলে কাস্টমকে অবহিত করে। এরপর পণ্য ছাড় করতে না পেরে বিডারকে পে-অর্ডারের টাকা ফেরত দেয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
বিডার নুরুল আমিনের প্রতিনিধি মোহাম্মদ ইয়াকুব চৌধুরী বলেন, "নিলামের পণ্য পাওয়ার পরও একাধিক সংস্থার অনাপত্তির কারণে পণ্যগুলো আমরা নিতে পারিনি। বর্তমানে কাঠ পচে মাটি হয়ে গেছে। বর্তমানে কাঠগুলো জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহারের উপযোগী নয়। নিলামে দরদাতা পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ"।
পণ্যগুলো পুনরায় নিলামে তুলতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ খামারবাড়ি ঢাকার উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইংয়ের পরিচালকের কাছে একাধিকার চিঠি দেয়। প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টিন স্টেশন জানায়, এই কাঠসমূহ ছাড়যোগ্য নয় বিধায় ধ্বংসযোগ্য। তবে জ্বালানি কাঠ হিসেবে ব্যবহার করে কাঠসমূহ ধ্বংস করা যেতে পারে বলে তারা মতামত প্রদান করে। এরপর কাঠগুলো জ্বালানি কাঠ হিসেবে নিলামে তোলার প্রক্রিয়া শুরু করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের নিলাম শাখার ডেপুটি কমিশনার আলী রেজা হায়দার টিবিএসকে বলেন, "কাঠগুলো চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের নিলাম শাখায় বিশাল জায়গা দখল করে আছে। নভেম্বরের মধ্যে কাঠগুলোর জন্য বিশেষ নিলামের আয়োজন করা হবে। এতে সরকারের রাজস্ব আয়ের পাশাপাশি কাস্টমসের জায়গাটিও খালি হবে"।
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টিন স্টেশনের উপ-পরিচালক নাছির উদ্দিন বলেন, "সরেজমিন গিয়ে দেখতে পাই কাঠগুলো হাত দিয়ে ধরলে গুঁড়ো হয়ে যায়। তাই কাঠ হিসেবে খালাসের অনুমতি দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে সেগুলোকে জ্বালানি কাঠ হিসেবে নিলামের অনুমতি দেওয়া হয়"।
গত সোমবার নিলাম শাখায় দেখা যায়, খোলা জায়গায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে কাঠগুলো। কাঠের উপর গজানো লতা-গুল্ম সরাচ্ছে কিছু শ্রমিক। অধিকাংশ কাঠ গুঁড়ো হয়ে মাটির সাথে মিশে গেছে। হাত দিয়ে স্পর্শ করলে গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ছে কাঠের অংশ।
আমদানিকারক গোমতি টিম্বারের পক্ষে পণ্য চালানটি খালাসের দায়িত্বে ছিলো চট্টগ্রামের সিএন্ডএফ এজেন্টস এম এ আহাদ এন্ড কোং। প্রতিষ্ঠানটির প্রোপ্রাইটর মো. হাসান মানিক বলেন, "ব্যাংকের এলসি সংক্রান্ত জটিলতায় আমদানিকারক পণ্যগুলো খালাস নেয়নি বলে আমরা জানতে পেরেছি। আমদানিকারক এর বেশি তথ্য আমাদের জানায়নি"।
গোমতি টিম্বারের চেয়ারম্যান মাশুরুল হোসাইন খানের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, "এলসি ছাড়াই মিয়ানমার থেকে কাঠগুলো পাঠিয়েছে সিঙ্গাপুরের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ফরেস্ট পিটিই লিমিটেড। এ পণ্য আমাদের নয়"।
তাহলে পণ্য পেতে হাইকোর্টে কেন রিট পিটিশন দাখিল করা হলো এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "রিট আবেদনও আমি করিনি। প্রতিবেদকের কাছে এ সংক্রান্ত ডকুমেন্ট আছে বলার পর তিনি কোন মন্তব্য করেননি। এই কাঠগুলো অন্য প্রতিষ্ঠানের আনা বলে তিনি দাবি করেন"।