কর ও জরিমানা কমাতে অন্তর্বর্তী সরকারের বড় উদ্যোগে স্বস্তি পাবেন ব্যবসায়ীরা

বাংলাদেশে উচ্চ পরিচালন ব্যয়ে চাপের মুখে থাকা ব্যবসায়ীরা শিগগিরই বড় ধরনের স্বস্তি পেতে পারেন। কারণ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমদানিতে ভুল ঘোষণার (মিস-ডিক্লেয়ারেশন) জরিমানা কমানো এবং কর-সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সুদের সীমা নির্ধারণের পরিকল্পনা করছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এসব উদ্যোগ ঘোষণা করা হতে পারে বলে জানা গেছে। এর লক্ষ্য হলো ব্যবসার ওপর চাপ কমানো এবং 'ব্যবসার পরিবেশ সহজীকরণ' (ইজ অব ডুয়িং বিজনেস) সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান উন্নত করা।
বর্তমানে আমদানিতে ভুল ঘোষণার কারণে করের পরিমাণের সর্বোচ্চ ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানা দিতে হয়। এ ছাড়া কর-সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি মামলায় সুদের চাপও ব্যবসায়ীদের জন্য বড় আর্থিক বোঝা হয়ে ওঠে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের মতে, প্রস্তাবিত পরিবর্তনের আওতায় মিস-ডিক্লেয়ারেশনের জরিমানা অর্ধেকে কমিয়ে আনা হবে এবং কর মামলায় সুদ আরোপের মেয়াদ সর্বোচ্চ দুই বছরে সীমিত করা হবে।
আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে আমদানি ঘোষণাপত্রে ছোটখাটো ভুলের জন্য জরিমানা কমানো এবং আমদানি নীতি আদেশ (আইপিও) লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ন্যূনতম জরিমানার নিয়ম শিথিল করা। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো, এসব সংস্কারের মাধ্যমে কাস্টমস কর্মকর্তাদের পণ্যের মূল্য নির্ধারণে নিজস্ব বিবেচনার ক্ষমতা সীমিত করে আমদানিকারকের ঘোষিত মূল্যকেই অগ্রাধিকার দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে—যা দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ী মহলের দাবি ছিল।
এনবিআরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস)-কে জানান, বাজেট ভাষণে অর্থ উপদেষ্টা এসব উদ্যোগের ঘোষণা দিতে পারেন। এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান সম্প্রতি এক প্রাক-বাজেট আলোচনায় বলেন, আসন্ন বাজেটে রাজস্ব আয় বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যবসার পথে থাকা অ-শুল্ক বাধা দূর করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে।
ব্যবসার জন্য স্বস্তিদায়ক পরিবর্তন
কর বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ী নেতারা প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। কর বিশেষজ্ঞ ও স্নেহাশিস মাহমুদ অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা অংশীদার স্নেহাশিস বড়ুয়া টিবিএস-কে বলেন, 'যদি এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়, তাহলে সহজে ব্যবসা করার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান উন্নত হবে। কর-বহির্ভূত বাধা যত সহজ হবে, ব্যবসা ও বিনিয়োগে আগ্রহ ততই বাড়বে।'
প্রস্তাবিত সংস্কারে আমদানিকৃত পণ্যের ভুল ঘোষণার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ জরিমানা ৪০০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০০ শতাংশে নামানো হবে। একই সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে চলা কর মামলায় পুরো সময়ের (যা ১০ বছরও চলতে পারে) জন্য সুদ আরোপের পরিবর্তে সেটি সর্বোচ্চ দুই বছরে সীমিত করা হবে। এটি ব্যবসায়ীদের জন্য বড় স্বস্তি, কারণ অনেক ক্ষেত্রেই সুদের অঙ্ক এত বেশি হয়ে যায় যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বকেয়া পরিশোধে স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করতে হয়।
এ মুহূর্তে আমদানির প্রাথমিক বিবরণীর তালিকা (আইজিএম)-এ যেকোনো ভুলের জন্য—যা গন্তব্য বন্দরে বাহক কর্তৃক কাস্টমসে জমা দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ নথি—প্রযোজ্য আমদানি করের অন্তত ৫০ শতাংশ জরিমানা দিতে হয়। বাজেটে এই নিয়ম বাতিল করা হতে পারে, ফলে কমিশনাররা ছোটখাটো ভুলের ক্ষেত্রে নামমাত্র জরিমানা নির্ধারণের সুযোগ পাবেন। একইভাবে, আমদানি নীতি আদেশ (আইপিও) লঙ্ঘনের জন্য আমদানি করের সমপরিমাণ ন্যূনতম জরিমানার বিধানও বাতিল হতে পারে, যাতে কমিশনাররা নিজের বিবেচনায় তুলনামূলক কম জরিমানা আরোপ করতে পারেন।
জাহাজ কোম্পানিগুলোর কার্গো ঘোষণায় ভুলের জন্য বর্তমানে প্রযোজ্য ন্যূনতম ৫০ হাজার টাকার জরিমানা বাতিল করা হতে পারে। এর বদলে, কমিশনারদের সামান্য 'টোকেন' জরিমানা আরোপের সুযোগ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি, বই ও ম্যাগাজিনের মতো পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত আমদানির সীমা, যা বর্তমানে ২ হাজার টাকা, তা বাড়িয়ে ৪ হাজার টাকা করা হতে পারে।
এনবিআরের এক কর্মকর্তা জানান, এসব সংস্কারের ফলে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা উল্লেখযোগ্য স্বস্তি পাবেন। এতে বাণিজ্য প্রক্রিয়া সহজ হবে এবং কর-সংক্রান্ত বিধি মানার প্রবণতা বাড়বে।
শিল্প নেতাদের প্রশংসা ও নিয়ন্ত্রণ শিথিলের দাবি
ব্যবসায়ী নেতারা প্রস্তাবিত সংস্কারগুলোকে নীতিগতভাবে ইতিবাচক বলে স্বীকার করলেও মনে করছেন, কার্যকর বাস্তবায়নের ওপরই নির্ভর করবে এর প্রকৃত সুফল। ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি)-এর সভাপতি ও ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাভেদ আখতার বলেন, 'এগুলো প্রগতিশীল পদক্ষেপ এবং এগুলো ব্যবসার উপর চাপ কমাতে সাহায্য করবে।' তিনি আরও বলেন, নিয়ন্ত্রকদের শুধু তদারকির ভূমিকা না রেখে ব্যবসা-বান্ধব সহায়ক হিসেবেও কাজ করা উচিত।
তিনি আরও একটি মুক্ত ও সহজ নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর আহ্বান জানান, যেখানে খাতভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ কমবে, অপ্রয়োজনীয় প্রজ্ঞাপন এবং 'নন-অবজেকশন সার্টিফিকেট' নেওয়ার বাধ্যবাধকতা হ্রাস পাবে। জাভেদ আখতার স্ব-প্রত্যয়ন ব্যবস্থা, তৃতীয় পক্ষের পেশাদার সার্টিফিকেশন, প্রক্রিয়ার ডিজিটাল রূপান্তর এবং প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ কমানোর ওপর জোর দেন।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)-এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম আমদানি ঘোষণায় ভুলের জন্য জরিমানা কমানোর উদ্যোগকে স্বাগত জানান। তবে তিনি বলেন, সর্বোচ্চ ২০০ শতাংশ জরিমানা এখনও অত্যধিক, বিশেষত বন্ড সুবিধাপ্রাপ্ত রপ্তানিকারকদের জন্য। তিনি উল্লেখ করেন, অনেক সময় এইচএস কোডে সামান্য ভুল হয় বা কাস্টমস কর্মকর্তাদের ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে 'মিথ্যা ঘোষণা' হিসেবে বিবেচনা করা হয়—এমনকি যদি কাঁচামালটি প্রকৃতপক্ষে রপ্তানির উদ্দেশ্যেও আমদানি করা হয়ে থাকে। হাতেম বলেন, প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করতে একটি কার্যকর ব্যবস্থা থাকা জরুরি, কারণ অনেক সময় প্রতারণামূলকভাবে ঘোষণা দেওয়া ব্যবসার বদলে বৈধ ব্যবসারাই বেশি জরিমানার মুখে পড়ে।
ঝুঁকি ও স্বস্তির ভারসাম্য
এনবিআরের কর্মকর্তারাও প্রস্তাবিত করছাড় ও সংস্কারগুলোর প্রশংসা করেছেন। তবে তারা সতর্ক করেছেন, এসব পদক্ষেপ অসাধু ব্যবসায়ীদের দ্বারা অপব্যবহারের ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। এনবিআরের একজন ভ্যাট কমিশনার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কর মামলার সুদ সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত সীমিত রাখার ফলে কিছু ব্যবসা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলা দীর্ঘায়িত করে কর পরিশোধ বিলম্বিত করতে পারে।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, ব্যবসাগুলো সরকারকে রাজস্ব না দিয়ে সেই অর্থ ব্যবসা বা ব্যাংকে বিনিয়োগ করতে পারে। পরে আদালতে হেরে গেলেও, তারা দুই বছরের সুদ পরিশোধ করেই দায়মুক্তি পাবে। এতে সরকার 'অর্থের সময়মূল্য (টাইম ভ্যালু অব মানি)' অনুযায়ী প্রকৃত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে। কমিশনার জানান, এই সুদের বিধান চালু হয়েছিল কর ফাঁকি দিয়ে কর পরিশোধে বিলম্ব রোধের জন্য। এখন এমন একটি কার্যকর ব্যবস্থা প্রয়োজন, যা আসল ফাঁকিবাজদের চিহ্নিত করে তাদের যথাযথভাবে শাস্তির আওতায় আনবে।