চুরি করা দামি শিল্পকর্ম কোথায় যায়?

২০১৯ সালের নভেম্বরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির ইতিহাসে সবচেয়ে কুখ্যাত চুরির ঘটনা ঘটে। দুঃসাহসী চোরেরা ড্রেসডেন রাজপ্রাসাদের সম্পদপূর্ণ গ্রিন ভল্ট থেকে সরিয়ে ফেলে বহুমূল্য রত্নখচিত সব অলঙ্কার। জার্মানির জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ ছিল এসব অলঙ্কার। তাই জনমনে ব্যাপক অসন্তোষ জন্ম দেয় এই ঘটনা।
তবে চুরির রহস্যটি প্রায় সমাধান করে ফেলেছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। গত ১৭ নভেম্বর দেওয়া এক ঘোষণায় পুলিশ জানায়, তারা বার্লিনের অপরাধী চক্রের সদস্য সন্দেহভাজন তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশ অবশ্য চুরি যাওয়া হিরা, পান্না আর চুনি খচিত তলোয়ার, জুতার আভরণ এবং মাথার চুলে দেওয়ার গহনা- কী করা হয়েছে সে সম্পর্কে কোনো হদিশ দিতে পারেনি।
এককালে স্যাক্সনি রাজপরিবারের মালিকানায় ছিল এসব। তাই প্রশ্ন উঠছে সেগুলোর গন্তব্য নিয়ে। চোরের দল কী এগুলো বিক্রি করে অর্থে রূপান্তর করেছে?
চুরি যাওয়া শিল্পকর্মের রেকর্ড রাখা প্রতিষ্ঠান লন্ডনের আর্ট লস রেজিস্টার। এব্যাপারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডাটাবেজ তাদের কাছেই রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বিশেষজ্ঞ এমিলি এডিনঘাউস চোরেরা ড্রেসডেনে চুরির মালামাল সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় বিক্রি করতে পারেনি বলেই মনে করছেন।
তিনি জানান, গত এক বছর ধরে বিশ্বব্যাপী চুরি যাওয়া নানা শিল্পকর্মের রেকর্ড আমরা রেখেছি। কিন্তু, সেগুলোর সন্ধান লাভ করা সহজ কাজ নয়। আর্ট লস রেজিস্টারে বর্তমানে ৭ লাখ চুরি যাওয়া শিল্প নিদর্শনের নাম রয়েছে; যার মধ্যে নাৎসিদের লুট করা শিল্প কর্ম থেকে বহুমূল্য গহনা, ঘড়ি এবং অন্যান্য অনেক জিনিস আছে।
এমিলি বলেন, 'ওই তালিকা অনুসারে আমরা নিদর্শনগুলো কোনো নিলামে বা গহনা মেলায় বিক্রি হচ্ছে কিনা তা খোঁজ-খবর রাখার চেষ্টা করি।'
গহনা এবং ঘড়ির ক্ষেত্রে তার প্রতিষ্ঠান বন্ধকী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখে। তারা সেকেন্ডহ্যান্ড কোনো প্রাচীন গহনা পাচ্ছেন কিনা সেটাই জানার চেষ্টা করা হয় এর মাধ্যমে।
''আমরা পুলিশের মতো অনুসন্ধানকারী নই। সার্বক্ষণিক অনুসন্ধান চালানো তাদেরই দায়িত্ব। তবে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করি। ড্রেসডেনের শিল্পকর্মও সেই হিসেবে আমাদের তালিকায় আছে। কিন্তু, আমাদের আগে পুলিশই তার সন্ধান পাবে। অমূল্য এসব নিদর্শন নিকট ভবিষ্যতে বাজারে সহজে লেনদেন করা হবে, বলে আমি মনে করি না,'' তিনি যোগ করেন।

তাহলে কী হিরা এবং বহুমূল্য ধাতু খুলে বিক্রি করা হয়েছে?
ড্রেসডেনে চুরি যাওয়া অলঙ্কার ও অন্যান্য সেটগুলোর অধিকাংশ ১৭ শতকের। বিক্রির সুবিদার্থে চোরেরা এর বিভিন্ন অংশ খুলে বিক্রি করতে পারে। কিন্তু, সেটা করাটাও যতই সহজ মনে হোক, ব্যাপারটা ততো সরল নয়।
এডিনঘাউস জানান, সেক্ষেত্রে চোরদের রত্নগুলোকে ভাঙতে হবে বা তাদের আকার এমনভাবে পরিবর্তন করতে হবে, যাতে অনুসন্ধানী চোখ তাদের চিনতে না পারে।
ড্রেসডেনে চুরি যাওয়া রত্নের খোঁজে জার্মান পুলিশ সাড়া পৃথিবীর শিল্প সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের সতর্ক করে রাখার কারণেই এই অবস্থা। পাশাপাশি গহনার আভরণে থাকা স্বর্ণ ও অন্যান্য ধাতু গলিয়েও বিক্রি করা যেতে পারে। কিন্তু, এমন করলে অন্যান্য দামি উপাদান নষ্ট হয়ে যাবে।
তাছাড়া, আসল শিল্পকর্মের যে মৌলিক মূল্য আছে- তা শুধুমাত্র এর পরিচয়ের মাধ্যমেই পাওয়া যায়। বৈধ বাজারে প্রাচীন শিল্প বিনিময়ের কালে পণ্যের সাথে বিশেষজ্ঞদের সনদ থাকে, যেখানে নিদর্শনের বয়স এবং তার উৎস উল্লেখ করা হয়। এডিনঘাউস বলেন, 'কিন্তু, চোরেরা যদি রত্নগুলো খুলে বিক্রি করে, তাহলে ঐতিহাসিক মূল্য একদমই পাবে না।'
বহুমূল্য শিল্পকর্ম লেনদেন করা এজন্যই জটিল এক প্রক্রিয়া। শৌখিন কোনো ধনীও বেশি দামে ঐতিহাসিক মূল্যহীন কোনো রত্ন কিনবেন না। হিরা ও অন্যান্য রত্ন যারা কাটিংয়ের কাজ করেন তাদের কাছে নিয়ে গেলেও ঝুঁকি কম নয়। তারা চোরদের সহযোগী না হলে রত্নটি দেখা মাত্রই এর উৎস সম্পর্কে সন্দেহ করবেন, এবং চাইলে স্থানীয় পুলিশকে খবরও দিতে পারেন।
সবমিলিয়ে বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, ড্রেসডেনের গহনাগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তদন্তকারীরা কোনো এক সময় উদ্ধার করতে পারবেন।
- সূত্র: ডয়েচে ভেলে