গাজায় গণহত্যার দায়ে ইসরায়েলকে ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ করতে উয়েফার প্রতি বিশেষজ্ঞদের আহ্বান

ইউরোপের ফুটবল নিয়ন্ত্রক সংস্থা উয়েফাকে (ইউনিয়ন অব ইউরোপিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনস) ইসরায়েল ও তাদের ক্লাবগুলোকে সব ধরনের প্রতিযোগিতা থেকে নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন ৩০-এর বেশি আইন বিশেষজ্ঞ।
বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর) উয়েফার প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দার সেফেরিনকে পাঠানো খোলা চিঠিতে তারা উল্লেখ করেছেন, গাজায় চলমান নৃশংসতার কারণে ইসরায়েলকে নিষিদ্ধ করা এখন 'অপরিহার্য'। চিঠিতে জাতিসংঘের তদন্তকারীদের প্রতিবেদনও উদ্ধৃত করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে—ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালাচ্ছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, 'আন্তর্জাতিক আইন রক্ষায় উয়েফাকে আইনি ও নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং অবিলম্বে ইসরায়েলকে ফুটবল থেকে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করার দাবি করা হয়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে অন্তত ৪২১ জন ফিলিস্তিনি ফুটবলার নিহত হয়েছে, এবং ফুটবল অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, এই হামলা এক প্রজন্মের ক্রীড়াবিদকে নিশ্চিহ্ন করেছে এবং ফিলিস্তিনি খেলাধুলার ভিত্তি ধ্বংস হয়েছে।'
চিঠিতে অভিযোগ করা হয়েছে, 'ইসরায়েল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (আইএফএ) মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি এবং দমননীতির অংশ হিসেবে কাজ করেছে। আইএফএ-র উয়েফা প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ গ্রহণযোগ্য নয়।'
চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশনের নির্বাহী পরিচালক এলিসা ফন ইয়োয়েডেন-ফর্গি, জাতিসংঘের সাবেক বিশেষজ্ঞ এবং আন্তর্জাতিক আইনের গবেষকরা। তারা বলেছেন, 'উয়েফা যেন আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের মতো গুরুতর অপরাধকে খেলাধুলার আড়ালে ঢাকতে সাহায্য না করে। এর মধ্যে গণহত্যাও অন্তর্ভুক্ত।'

গাজায় হামলার কারণে নিহতের সংখ্যা ৬৬ হাজার ছাড়িয়েছে। পুরো উপত্যকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মানবিক সহায়তার ওপর অবরোধের কারণে মারাত্মক খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। আগস্টে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষকে দুর্ভিক্ষের মুখে ফেলেছে।
জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা ক্রেইগ মোখিবার বলেন, গণহত্যা চালানো দেশকে ক্রীড়ায় অংশ নিতে দেওয়া তার 'স্বাভাবিকীকরণ' এবং দায়সাপেক্ষ। তিনি উল্লেখ করেন, দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাপারথেইডের সময় বিশ্ব একজোট হয়ে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক বয়কট ব্যবহার করেছিল। ফিফা ১৯৬১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে খেলা থেকে নিষিদ্ধ করেছিল, আর ২০২২ সালে রাশিয়াকেও ইউক্রেন আক্রমণের কারণে দ্রুত নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
ইসরায়েলের ক্লাব ও জাতীয় দল অবৈধ এলাকায় থাকলেও ফিফা ও উয়েফার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক খেলায় অংশ নিচ্ছে। ইসরায়েল ১৯৯৪ সালে উয়েফাতে যোগ দিয়েছিল। গাজায় হামলা চলার পরও ইসরায়েলের জাতীয় দল ইউরোপের বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে খেলছে, এবং ক্লাবগুলো উয়েফার টুর্নামেন্টে অংশ নিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ম্যাকাবি তেল আবিব এ বছর ইউরোপা লিগে খেলেছে।
বিশ্ব ফুটবলে ইসরায়েলকে আলাদা করার দাবি সম্প্রতি তীব্র হয়েছে। গ্লাসগো, প্যারিস, রোম ও বিলবাও-তে ফুটবল ভক্তরা গাজার প্রতি সমর্থন জানিয়ে ফিলিস্তিনি পতাকা উত্তোলন করেছেন। আগস্টে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের ফুটবল কিং সুলেমান আল-ওবেইদকে হত্যার পরও সহিংসতা বন্ধের আহ্বান আসে। উয়েফা তার ছবি পোস্ট করে শ্রদ্ধা জানায়, কিন্তু লিভারপুল তারকা মোহাম্মদ সালাহ উয়েফার কঠোর সমালোচনা করেন, কারণ তারা হত্যাকারীর কথা উল্লেখ করেনি।
উয়েফা সাময়িকভাবে ইসরায়েলকে নিষিদ্ধ করার ভোট নিতে যাচ্ছিল, তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা অস্ত্রবিরতি প্রস্তাবের কারণে তা স্থগিত হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের পরিকল্পনা উয়েফাকে ইসরায়েলকে নিষিদ্ধ করার দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে না। 'শান্তি আসতে হলে ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা অপরিহার্য।'

বুধবার অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ফিফা ও উয়েফার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, তারা যেন ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতা থেকে নিষিদ্ধ করে। সংস্থার প্রধান আগনেস কালামার্ড বলেন, 'ইসরায়েল গাজায় ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালাচ্ছে এবং অবৈধ বসতি সম্প্রসারণ করছে, অথচ তার জাতীয় দল নরওয়ে ও ইতালির বিপক্ষে ওয়ার্ল্ড কাপ বাছাইপর্বের প্রস্তুতি নিচ্ছে।'
'গেম ওভার ইসরায়েল' ক্যাম্পেইনের পরিচালক আশিষ প্রাশার বলেছেন, 'ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হিসেবে বিশ্বজনীন সম্প্রদায় গঠনে গুরুত্বপূর্ণ। গণহত্যাকারীদের জন্য সংস্কৃতিকে জাতিসংঘের আসনের চেয়ে বেশি মূল্যবান করা যায় না। আমাদেরকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যের সময়ের মতো ইসরায়েলকে ক্রীড়া থেকে বয়কট করতে হবে।'
গাজায় গণহত্যার প্রমাণ তুলে ধরে 'গেম ওভার ইসরায়েল' মিডিয়ায় প্রচারণা চালাচ্ছে এবং ফুটবলে বয়কট আহ্বান জানাচ্ছে। গত মাসে তারা নিউ ইয়র্ক সিটির টাইমস স্কোয়ারে একটি বিলবোর্ড স্পনসর করেছিল, যেখানে লেখা ছিল, 'ইসরায়েল গণহত্যা করছে। সকার ফেডারেশনগুলো: ইসরায়েলকে বয়কট করো।'
ইসরায়েলের প্রধান মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগামী বছরের বিশ্বকাপ সহ-আয়োজক। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ফিফার সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবে বলে আশাবাদী নন। প্রাশার বলেন, 'নির্দিষ্ট দেশগুলো যদি ইসরায়েলকে বয়কটের ঘোষণা দেয়, তবেই ফিফাকে বাধ্য করা সম্ভব।'
বৃহস্পতিবার ইনফান্তিনো বলেছেন, 'ফিফা ভূরাজনৈতিক সমস্যা সমাধান করতে পারে না। তবে এটি বিশ্বের ফুটবল সম্প্রসারিত করতে পারে এবং মানবিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষামূলক মূল্যবোধের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সংহতি বাড়াতে পারে।'
জাতিসংঘের সাবেক বিশেষজ্ঞ মোখিবার বলেন, 'ফুটবলে মানুষকে ভালো মূল্যবোধের জন্য একত্রিত করা উচিত, কোনো দেশের গণহত্যার পাশে দাঁড়ানোর জন্য নয়। ইতিহাস দেখলেই বোঝা যায়, ফুটবলে বয়কট ও নিষেধাজ্ঞা সবসময় প্রয়োগ করা হয়েছে।'
আশিষ প্রাশার আরও বলেন, 'জিয়ান্নি ইনফান্তিনো গণহত্যাকে স্বাভাবিক করছেন। প্রশ্ন হলো, তারা কি নাৎসি জার্মানিকে অনুমতি দিতো, যখন তারা গণহত্যা করছিল?'