তিন বলে তিন: গর্ব হয় যে প্রথম হ্যাটট্রিকটা আমার

বোলারের কাছে তার প্রতিটা উইকেটই সাত রাজার ধন। সেটা যদি হয় টানা তিন বলে তিন উইকেট? হ্যাঁ এটা হ্যাটট্রিক; বোলারদের জন্য রাজ্য জয়ের সমান। বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে এই রাজ্য জয় করে দেখিয়েছিলেন অলোক কাপালি। পেশোয়ার টেস্টে টানা তিন বলে পাকিস্তানের তিনজন ব্যাটসম্যানকে সাজঘর দেখিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে হ্যাটট্রিক শব্দটা যোগ করেন এই লেগ স্পিনার।
ঘটনা সেই ২০০৩ সালের। কিন্তু অলোকের স্মৃতিতে তা এখনও সতেজ, যেন সেই সেদিনের কথা। মধুর সেই স্মৃতি মনে পড়লেই একবার তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন বাংলাদেশের হয়ে ১৭ টেস্ট, ৬৯ ওয়ানডে ও ৭টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলা ডানহাতি এই অলরাউন্ডার। হ্যাটট্রিক মানেই বোলারের পরম আনন্দ। এমন একটি কীর্তি দেশের হয়ে প্রথম করায় অলোকের গর্বের শেষ নেই।
টেস্ট এবং ওয়ানডে মিলিয়ে বাংলাদেশের সাতজন বোলার হ্যাটট্রিক করেছেন। হ্যাটট্রিকের নায়কদের নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের নিয়মিত আয়োজনে আজ থাকছেন অলোক কাপালি। টানা তিন বলে তিন উইকেট নিলে কেমন অনুভূতি কাজ করে, বিদেশ বিভুঁইয়ে হ্যাটট্রিক করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল, এখনও কীভাবে মনে পড়ে; এসব নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশের এই ক্রিকেটার। তার মুখেই শো যাক সে গল্প।
অলোক কাপালি: ওই সময়ে অবশ্যই এটা অনেক বড় ছিল। কারণ প্রথমত এটা বাংলাদেশের জন্য প্রথম হ্যাটট্রিক ছিল। দারুণ এক মুহূর্ত। তবে হ্যাটট্রিকের চেয়েও বড় মনে হয়েছিল টেস্ট খেলুড়ে কোনো দলের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসেই আমাদের লিড নেওয়া। ওই ম্যাচটাতে আমরা ওদের ২৯৫ রানে অলআউট করি। আমরা প্রথম ইনিংসে আমরা করি ৩৬১ (৬৬ রানের লিড) রান।
ওই ম্যাচে আমরা দারুণ বোলিং করে লিড নিই। ভালো লেগেছিল এই ভেবে যে আমার হ্যাটট্রিকের জন্য আমরা এগিয়ে ছিলাম। জেতার মতো একটা অবস্থায় চলে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল আমরা ইতিবাচক কিছু একটা নিয়ে আসব। এই কারণে হ্যাটট্রিকটা আমার কাছে সত্যিই অনেক স্পেশাল।
সুজন ভাই আমাকে বোলিংয়ে এনে একটা ব্রেক থ্রু দিতে বলছিলেন। সুজন ভাই বলছিলেন, 'একটা ব্রেক থ্রু হলে ভালো হয়। চেষ্টা কর ভালো জায়গায় বোলিং করার।' তো আমি আসলে চেষ্টা করেছি প্রথম ওভার থেকেই। একদিকে মোহাম্মদ ইউসুফ ছিল, অন্যদিকে সাব্বির। তখন রফিক ভাই অনেকক্ষণ ধরে বোলিং করছিলেন। আমাকে আনা হয় ব্রেক থ্রুর জন্য।
আমার লক্ষ্যই ছিল স্টাম্পে বোলিং করার। আমার লক্ষ্য ছিল, মোহাম্মদ ইউসুফকে আমি সিঙ্গেল দিব। আর অন্য প্রান্তে আক্রমণ করব। অমনই হয়েছিল। ইউসুফকে সিঙ্গেল দিয়ে সাব্বিরকে আক্রমণ করি। ব্রেক থ্রুর কথা মাথায় রেখে কেবল স্টাম্পেই বোলিং করেছি। মনে হয়েছে স্টাম্পে বোলিং করলে সুযোগ থাকবে। কারণ টেল এন্ডারদের ডিফেন্স অত শক্তিশালী নয়।
স্টাম্প টু স্টাম্প বোলিং করায় পরিকল্পনা মতো হয়েছে। হ্যাটট্রিকের পর সবাই প্রচন্ড খুশি হয়েছিল। সবাই দৌড়ে এসে বলছিল তোর হ্যাটট্রিক হয়ে গেছে। এমন একটা ব্যাপার অবশ্যই আমার জন্য অনেক বড় ছিল। একই সঙ্গে দলের জন্যও।
আরও হ্যাটট্রিক আছে বাংলাদেশের। কিন্তু সবকিছুরই একটা শুরু হয়। ভালো লাগে, গর্ব হয় যে প্রথম হ্যাটট্রিকটা আমার। সারাজীবনই এই ভালো লাগা কাজ করবে। যখনই মনে পড়ে ভালো লাগে।
আগের ওভারের শেষ দুই বলে উইকেট নিই। মোহাম্মদ ইউসুফ তখন সেট ছিল। মনে হচ্ছিল ও স্ট্রাইকে থাকলে পারব না। ওর সময়ে বারবার ফিল্ডিং পরিবর্তন করছিলাম আমরা। আমি চাচ্ছিলাম অন্য কেউ যেন স্ট্রাইকে থাকে। চিন্তা করছিলাম উমর গুলকে যদি পাই, এটা সুযোগ থাকবে প্রথম বলে উইকেট নেওয়ার।
আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে টেল এন্ডারের কেউ থাকলে প্রথম বলেই নিতে পারব। তো ভাগ্য আসলে সহায় ছিল সেসময়। ভাগ্যের সহায়তায় আমি উমর গুলকেই পাই। সবাই যেভাবে আক্রমণ করেছিলাম আমরা আর ওই বলটা স্টাম্পে করার লক্ষ্য ছিল। স্টাম্পে করার কারণেই তাকে এলবিডব্লিউ করা গিয়েছিল। উমর গুলকে দেখে মনে হচ্ছিল হয়ে যাবে। মনে হচ্ছিল স্টাম্পে রাখলে আমার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকবে হ্যাটট্রিক হওয়ার।
হ্যাটট্রিকটা আসলে অনেক সময় সেঞ্চুরির চেয়েও বড় মনে হয়। হ্যাটট্রিক সব সময় হয় না। দুই বলে দুই উইকেট নেওয়ার পর ভালো বোলিং করেও হ্যাটট্রিক হয় না। ব্যাটসম্যান ভালোভাবে সামলে নেন। তো আমি মনে করি ভাগ্যটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। হ্যাটট্রিক, সেঞ্চুরি, ডাবল সেঞ্চুরি; এসব বড় জিনিস। এসব করতে ভাগ্যকে সঙ্গে পেতে হয়। হ্যাটট্রিক অনেক বড় সাফল্য। সারাজীবন মনে রাখার মতো ব্যাপার।
আরও ভালো লাগার ব্যাপার যে, আমাদের দেশের পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছে যে প্রথম হ্যাটট্রিক কে করেছে। ওখানে আমার নাম। এটা আমার এক ছোট ভাই ফোন করে জানায় আমাকে। এটা শোনার পর সেই কীর্তিটা আরও বড় মনে হচ্ছিল নিজের কাছে। এমন খবর শুনলে খুবই ভালো লাগে।
যখন হ্যাটট্রিক হতে দেখতাম, তখন মনে হতো যদি আমি করতে পারতাম। যদি সুযোগ পাই সর্বোচ্চ চেষ্টা করব, এভাবে ভাবতাম। আর যখন করতে পারলাম, তখন খুব বেশি এক্সাইটেড ছিলাম। কিন্তু উদযাপনটা ভালোভাবে করতে পারিনি। আমাদের দ্রুত ৫টি উইকেট চলে যাওয়ায় ওইদিনই আমাকে ব্যাটিংয়ে নামতে হয়। দেখা আর করার মধ্যে পার্থক্য অনেক। এটা আসলে বলে বোঝানো কঠিন।
হ্যাটট্রিক তো আরও হয়েছে। কিন্তু প্রথম হ্যাটট্রিক হিসেবে আমারটাই থাকবে। আরও কয়েকটা হয়েছে, কিন্তু শুরুতে আমার নাম। এটা দারুণ ব্যাপার। হ্যাটট্রিক সময়ই বোলারদের কাছে বিশেষ কিছু। সেটাও আবার পাকিস্তানের বিপক্ষে দলেরে মতো করায় দারুণ অনুভূতি কাজ করছিল। কারণ তখন বিশ্বের অন্যতম সেরা দল ছিল পাকিস্তান। শোয়েব আখতার, ইনজামাম, ইউসুফদের মতো ক্রিকেটাররা তখন পাকিস্তান দলে খেলেন। ওদের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করা অনেক বড় ব্যাপার ছিল।
ওই সফরে আমরা ভালো খেলেছিলাম। হ্যাটট্রিক তো ভালোভাবেই মনে আছে। পাশাপাশি মনে আছে আমার একটি ক্যাচ আউটের কথা। মুলতান টেস্টে আমার ক্যাচটা ছিল না। কিন্তু রশিদ লতিফ বলেন আউট। আম্পায়ার আউট দিলে আমাকে হাঁটতেই হবে। যদিও ওই ঘটনায় উনি নিষিদ্ধ হয়েছিলেন।
আমার ক্যারিয়ারের সেরা সাফল্য হ্যাটট্রিকটাই। যদিও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অপরাজিত ৮৯ রানের ইনিংসটাকে আমি এগিয়ে রাখি। কদিন আগে আমাকে একজন প্রশ্ন করেছিলেন, কোনটা সেরা। তখন আমি এই ইনিংসটার কথা বলি। কারণ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলা ইনিংসটা আমার ক্যারিয়ারের প্রথম হাফ সেঞ্চুরি ছিল, অপরাজিত ছিলাম। এটা এক নম্বরে। হ্যাটট্রিককে আমি দুই নম্বরে রাখব। তিন নম্বরে ভারতের বিপক্ষে সেঞ্চুরিটা।