ভাসানীর মজলুম দর্শন: কীর্তন, সংস্কৃতি ও স্বাধীনতার বীজ
১৯৫৭ সাল। রাত নামে। কিন্তু আকাশ থেকে মেঘের অশ্রু ঝরে না। কেবল ঝরে শূন্যতা। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী হাঁটছেন। পায়ের নিচে মাটি ভিজে যাচ্ছে, কিন্তু কাদা জমছে না। কাদা জমছে ইতিহাসের স্তরে স্তরে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় পাশে সতর্কভাবে চলছেন, তিনি কথা বলছেন না। কেবল বাতাস গায়ে মাখিয়ে নিচ্ছেন। রাতের বাতাস, যা ১৯৫৭ সালের পুরোনো খবর বহন করছে, কিন্তু তার ভেতরেই লুকিয়ে আছে একাত্তর সালের আগুনের প্রথম স্ফুলিঙ্গ।
সময় যেন একটি জানালা; মওলানা এই জানালার কাঁচের ওপার থেকে ভবিষ্যৎ দেখছেন, আর তারাশঙ্কর দেখছেন অস্তিত্বের ধুলো।
মওলানা থেমে গেলেন। তাঁর আঙুলটি উঠলো, আকাশের দিকে নয়, মাটির দিকে। আঙুলটি দীর্ঘ, যেন একটি গাছের শেকড়। সেই শেকড়টি একটি গ্রাম দেখাল। কিন্তু গ্রামে বাড়ি নেই, আছে কেবল ছায়া। ছায়ার ভেতরে কেবলই শূন্যতা। এই ছায়াগুলো যেন সদ্য চলে যাওয়া মানুষের শূন্যস্থান, যেখানে এখনও উদ্বাস্তুদের শরীরের উষ্ণতা লেগে আছে। মওলানা বললেন, "এইখানে, এইখানে রাতে সুর আসত। প্রতি রাতেই সুর নামত।"
সুরটি কী? তিনি ব্যাখ্যা করলেন না। তিনি শুধু চোখ বন্ধ করে নিলেন।
সুরটি ছিল কমলা রঙের। সুরের সঙ্গে তাল ছিল না, ছিল নৃত্য। খোল বাজত, কিন্তু তার শব্দে কোনো অভিযোগ ছিল না। করতাল হাসত, হাসিটি ছিল কাঁচের চুড়ির মতো স্বচ্ছ। হিন্দু পরিবারগুলো হাসত, তাদের হাসি ছিল জলভরা পুকুরের স্থিরতা। আলো ছিল না, কিন্তু ছিল দীপ্তি। সেই দীপ্তি, যা দুটি জলের ধারাকে এক করে দেয়, আর সেই ধারার নাম 'কীর্তন'। মওলানা কীর্তনের নাম বললেন, কিন্তু শব্দটি উচ্চারণ করলেন ফিসফিস করে, যেন শব্দটি একটি ভাঙা কাঁচের টুকরো। তিনি নিজে একজন মওলানা। তিনি শোনেন অস্তিত্বের আওয়াজ, কিন্তু দেখেন অন্য চোখে। তিনি দেখলেন, সুর চলে গেছে। কমলা রংটি শুকিয়ে ধূসর হয়েছে। দীপ্তি ম্লান হয়ে এখন কেবল ছায়া।
মওলানা মাথা নাড়লেন। মাথা নাড়ানোটি যেন একটি পুরাতন নদীর স্রোত। "গ্রামগুলো মরে গেছে," তিনি তারাশঙ্করকে বললেন। "প্রাণ নেই।"
প্রাণহীন একটি গ্রামের অর্থ কী? এর অর্থ হলো, মাটির গভীরে শেকড় শুকিয়ে যাওয়া। শেকড় শুকিয়ে গেলে গাছটিকে যতই সবুজ রং দেওয়া হোক না কেন, তার ভেতরে কেবল ফাঁপা কাঠ। একটি সুর যখন চলে যায়, তখন কেবল একটি সুর হারায় না; হারায় দুটি ভিন্ন বিশ্বাসের, দুটি ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেকার নীরব ভাষা। মওলানা দেখলেন, একটি সম্প্রদায় চলে গেছে। কিন্তু তাদের শূন্যতা পূরণ করেছে একটি সবুজ বিষ। সেই বিষ হলো সাম্প্রদায়িক বিভেদ, যা পাকিস্তান নামের এক ভুল স্বপ্ন বুনেছিল। এই স্বপ্ন ছিল কাঁচের মতো ভঙ্গুর, কিন্তু তার ধার ছিল খুব বেশি। মওলানা দেখলেন, কীর্তনের সুর না থাকা মানেই সাংস্কৃতিক রক্তক্ষরণ। এই রক্তক্ষরণ সরাসরি রাজনৈতিক দুর্বলতা। ঐক্য ভেঙে গেছে। শোষণ এখন আরও সহজ। শোষক জানে, মানুষের কাঁধে কাঁধ মেলা বন্ধ হলে তার কাজ সহজ হয়ে যায়। তিনি দেখলেন, পশ্চিমের শাসক শ্রেণি কেবল অর্থনীতি নয়, তারা বাংলার আত্মা চুরি করতে এসেছিল।
বাতাসে একটি ছেঁড়া কাগজ ওড়ে। সেটি কোনো রাজনৈতিক ইশতেহার নয়। সেটি হলো একটি মানুষের হাসি। হাসিটি ভাসানীর।
ভাসানীর চোখ দুটি তখন দিগন্তের ওপারে দেখল। তিনি দেখছেন রক্ত। তিনি দেখছেন একটি নতুন মানচিত্র, যা জলের রঙে আঁকা। সময় একটি নদী। কিন্তু নদীর নিচের বালিতে আগুন ঘুমিয়ে আছে। মওলানা বললেন, "পূর্ব বাংলা একদিন মুক্ত হবেই। বারো বছরের মধ্যে এই দেয়াল ভাঙবে।"
এই কথাটি তিনি বাতাসের খোলা খামে লিখে দিলেন। এবং, তারাশঙ্করের চোখের গভীরে। এই ভবিষ্যদ্বাণী কোনো দৈববাণী ছিল না; এটি ছিল তৎকালীন শোষণের চুলচেরা বিশ্লেষণ। তিনি দেখলেন, ব্রিটিশ খেদানোর পর পাকিস্তান হলো একটি চোর। যে এক হাতে অস্ত্র ধরে আছে, অন্য হাতে ধরে আছে অর্থনৈতিক ছুরি। তিনি জানতেন, যখন শাসক গোষ্ঠী জনগণের মুখের ভাষা কেড়ে নেয়, তাদের অর্থনৈতিক রক্ত শুষে নেয়, তখন সেই সম্পর্ক কেবল একটি আলগা ফসকা গেরোর দড়ির মতো ঝুলে থাকে। দড়িটি ছিঁড়তে হবেই। সেই দড়ি ছেঁড়ার প্রথম টানেই জন্ম নেবে স্বাধীনতা।
কাগমারী সম্মেলন ছিল সেই দড়ি ছেঁড়ার প্রথম স্বপ্ন-রঙের মঞ্চ। সম্মেলনটি একটি সবুজ ময়দান ছিল। কিন্তু ময়দানের উপর উড়ছিল প্রতিবাদের লাল পতাকা। মওলানা একটি শব্দ ব্যবহার করলেন। শীতল তবে, ধারালো শব্দ। 'আসসালামু আলাইকুম'।
এটি কেবল সালাম নয়। এটি হলো বিদায়। শাসকের হাত ধরে থাকার বিদায়। তিনি জানেন, এই বিদায়ের ভাষা কেবল রাইফেল বা কামান নয়, এটি হলো জনগণের দীর্ঘশ্বাস। এটি সেই মজলুমের দীর্ঘশ্বাস, যারা কীর্তন হারিয়েছে, হারিয়েছে সহজিয়া জীবনবোধের শিকড় এবং এখন স্বাধীনতা খুঁজছে। মওলানা যেন সেই মুহূর্তেই বাংলার মানুষকে একটি ঘুমন্ত ড্রাগনের সাথে পরিচিত করালেন—ড্রাগনটি হলো মুক্তি আকাঙ্ক্ষার দৈত্য।
মওলানা মজলুমের নেতা। তিনি দেখেন, শোষণের কেবল-ই এক বর্ণের মুখ নেই। মুখটি সাদা চামড়ার হতে পারে, খাকি পোশাকের হতে পারে, অথবা সোনালী বর্ণের হতে পারে। শোষক মূলত শোষকই। ব্রিটিশ ছিল, এখন পাকিস্তান। ভবিষ্যতে অন্য কেউ আসতে পারে। মওলানা তাঁর মজলুম দর্শনের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন এই চেতনার উপর। তাই তাঁর আদর্শ লেনিন, মাও এবং ইসলামের প্রগতিশীল চেতনাকে মেশাতে দ্বিধা করেনি। কারণ সকল আদর্শই, যদি তা সততার সঙ্গে প্রযুক্ত হয়, তবে শোষিতের মুক্তি চায়।
কীর্তন এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন—এই দুটি ভাবনা তাঁর কাছে একই গাছের দুটি ডাল। একটি হলো সাংস্কৃতিক শেকড়, অন্যটি হলো রাজনৈতিক ফল। শেকড় দুর্বল হলে ফল টক হবে, বিষাক্ত হবে। কীর্তন চলে যাওয়ায় শেকড় দুর্বল হয়েছে। এই দুর্বলতাকে শক্তি দিতে হলে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেই হবে। স্বাধীনতাই পারবে সেই পুরোনো সুর ফিরিয়ে আনতে, অথবা একটি নতুন সুর তৈরি করতে, যেখানে শঙ্খ এবং আজান একসঙ্গে মিশে গিয়ে এক নতুন ঐক্যের মন্ত্র তৈরি করবে।
মওলানা ভাসানী চোখ বন্ধ করলেন। তিনি দেখলেন একটি সাদা ঘোড়া দৌড়ে যাচ্ছে। ঘোড়াটির নাম 'বিপ্লব'। বিপ্লবের গায়ে রক্ত নেই, আছে কেবল ঘাম এবং সদ্য কাটা ধানের গন্ধ। এই বিপ্লব আকাঙ্ক্ষা কোনো রাজপ্রাসাদ থেকে আসেনি। এসেছে একটি ধানক্ষেতের আলপথ থেকে। এই বিপ্লব হলো মজলুমের ঐক্য। এই বিপ্লব হলো সেই সুর, যা একসময় গ্রাম থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। এই বিপ্লব হলো সেই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা, যখন এই জনপদের জনগোষ্ঠী তার নিজের পায়ের নিচে মাটি অনুভব করবে।
ভাসানীর সাথে হাঁটতে হাঁটতে তারাশঙ্কর তাকিয়ে রইলেন। তিনি জানলেন, এই মানুষটি কেবল একজন রাজনীতিবিদ নন। ইনি হলেন এ জনপদের মাটির অবচেতন মনের কণ্ঠস্বর। এই কণ্ঠস্বর ভবিষ্যতেও বাঁচবে, যতদিন না সকল শোষণ দূর হয়। যখন তিনি ফিরে গেলেন, তখন তাঁর পকেটে কোনো ইশতেহার ছিল না। ছিল কেবল একটি সুরের অনুরণন। সেই কীর্তনের সুর, যা মওলানা ভাসানীর স্বপ্ন ছিল। সেই সুর, যা স্বাধীনতা ছাড়া বাঁচতে পারে না।
একাত্তর থেকে জুলাই অভ্যুত্থান জনতার এক অনন্ত সংগ্রাম - এ যেন এক সুরের হাহাকার।
লেখক: নৃবিজ্ঞানী, দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক, চলচ্চিত্রকার।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।
