এবার এক অন্যরকম নারী দিবস পালন করলেন ‘তৌহিদী জনতা’

প্রতিবছর ঘুরে ঘুরে ৮ মার্চ আসে। দিনটি 'নারী দিবস'। শহরের নারীদের একটা অংশ দিনটি উপলক্ষে বেগুনি শাড়ি পরে, হাতে ব্যানার-ফেস্টুন-ফুল নিয়ে নারীর অধিকারের দাবি জানান। কর্পোরেট কালচারের অংশ হিসেবে বস নারী সহকর্মীদের হাতে ফুল ও কার্ড তুলে দেন। এবারও হয়তো তাই ঘটেছে।
কিন্তু এর আগেই তৌহিদী জনতা নারী দিবস পালন করে ফেললেন, তাদের মতো করে। তারা শাহবাগ থানা ঘেরাও করে সেই ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে আনলেন, যে কিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্থা করেছে। একজন নারী হেনস্থাকারীর মুক্তির দাবিতে এই তৌহিদী জনতা প্রায় ৮ ঘণ্টা শাহবাগ থানা অবরোধ করে রেখেছিলেন।
ওই শিক্ষার্থী ফেসবুক পোস্টে ঘটনার বিবরণ ও অভিযুক্ত ব্যক্তি আসিফ অর্ণবের ছবি শেয়ার করে লেখেন, 'এই লোকটা আজকে আমাকে শাহবাগ থেকে আসার পথে হ্যারাস করেছে। সে আমাকে হুট করে রাস্তায় দাঁড় করায় দিয়ে বলেছে আমার ড্রেস ঠিক নাই, পর্দা করি নাই ইত্যাদি ইত্যাদি এবং তার আচরণ খুবই অ্যাগ্রেসিভ ছিল।'
মেয়েটি প্রক্টরের কাছে অভিযোগ করেন; লোকটা তার নামে আনা অভিযোগ স্বীকার করার পর তাকে পুলিশের হাতে দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না, অর্ণব লোকটা বীরের বেশে, ধর্মীয় লেবাস পরে জামিন নিয়ে বের হয়ে এলেন।
আমরা যারা নারী দিবস পালন করবো বলে নানা ধরনের 'লুথা' কর্মসূচি হাতে নিয়ে বসে আছি, তাদের নাকের ডগা দিয়ে বের হয়ে এলেন সেই নারী হেনস্থাকারী। অন্যদিকে, চায়ের দোকানে বসে থাকা দুই নারীকে শ্লীলতাহানীর চেষ্টাকারী রিংকু নামের অভিযুক্ত ব্যক্তিরও একটি চুল স্পর্শ করা গেল না। বহাল তবিয়তে আছেএন তিনিও এবং অন্য কিছু তৌহিদী জনতা তার পক্ষেও মশাল মিছিল করেছেন।
এইসব হেনস্থাকারীর সবচেয়ে বড় অর্জন হলো– এরা পথে নামতে পারে, অন্যায়ের পক্ষে নেতৃত্ব দিতে পারে, নারীকে চেপে ধরতে পারে, যুক্তিজ্ঞানকে উড়িয়ে দিতে পারে। আর বিদ্যাবুদ্ধিতে এরা অতি নিম্নমানের হলেও জনতার ওপরে এরা সাংঘাতিক রকমের প্রভাব রাখতে পারে।
অথচ অন্যপক্ষকে দেখুন, ফেসবুক-কেন্দ্রীক লেখালেখি, নিজেদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও ভয়ে ভয়ে আমরা বেঁচে আছি। হাতে গোলাপ নিয়ে একটি ক্লিশে নারী দিবস পালনের অপেক্ষায় আছি। অধিকাংশ মানবাধিকার ও নারী অধিকারকর্মী মুখ লুকিয়ে আছেন বা তৌহিদী জনতার ভয়ে সিঁটিয়ে আছেন।
অথচ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ডান-বামের বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, নারী অধিকার কর্মী, বিভিন্ন নেটওয়ার্ক, উঠতি রাজনীতিবিদগণ কোমর বেঁধে আন্দোলন করেছেন এই তৌহিদী জনতার হাতে হাত রেখে। হয়তো তখন বুঝতে পারেননি এদের মধ্যে অধিকাংশই নারী বিদ্বেষী। আর যখন বুঝতে শুরু করেছেন, ততক্ষণে বল চলে গেছে মাঠের বাইরে। এখন ক্যাচ ধরতে চাইলেও আর পারবেন না।
দেখেন, বেগুনি পোশাক পরে কর্পোরেট ও এনজিও'র ক্রীড়নক হয়ে কতদিন নারী দিবস চালিয়ে যেতে পারেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন ছাত্রী যখন হয়রানির শিকার হওয়ার পর অভিযোগ করেন এবং অভিযোগ করার পর দেখেন অভিযুক্ত বীরের বেশে বের হয়ে আসছেন, তখন তার করার আর কীইবা থাকতে পারে? চারিদিকে আমাদের মতো অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে সোচ্চার, কিন্তু আদতে মেয়েটির পাশে কেউ নেই।
২০২২ সালে নরসিংদী রেলস্টেশনে পোশাক নিয়ে এভাবেই হেনস্থার শিকার হয়েছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী। কিন্তু সেইসময়ও কেউ তার পাশে ছিলেন না, এখনো নেই। এমনকি, নারী হেনস্থাকে কেন্দ্র করে হেনস্থাকারীদের পক্ষেই মন্তব্য করেছিলেন হাইকোর্ট। পোশাকের জন্য নরসিংদী রেলস্টেশনে তরুণীকে হেনস্থার অভিযোগে করা মামলায় আসামির জামিন আবেদনের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশ্যে হাইকোর্ট প্রশ্ন রেখেছেন, 'সভ্য দেশে এমন পোশাক পরে রেলস্টেশনে যাওয়া যায় কি না?' আদালত বলেছেন, 'গুলশান-বনানীর মতো এলাকায়ও কোনো মেয়ে এ ধরনের পোশাক পরে রাস্তায় বের হয় না।' ২০২২ সালে উচ্চ আদালত যে মন্তব্য করেছেন, তা অনেককেই ব্যথিত ও বিস্মিত করেছিল।
'হাইকোর্ট' অবশ্য যে কোনো বিষয়ে মন্তব্য করতে পারেন, তবে সেটা রায়ে উল্লেখ্য না থাকলে কার্যকরী হবে না বা আদেশ বলে গণ্য হবে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে হাইকোর্টের এই মন্তব্যকে কেন্দ্র করে যেকোনো সময়ে, যেকোনো নারী, যে কারো হাতে হেনস্তার শিকার হতে পারেন। মহিলা পরিষদ মন্তব্য করেছিল 'নারীর পোশাক নিয়ে উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতির এই পর্যবেক্ষণ জনপরিসরে নারীর স্বাধীন চলাচল ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবে।'
গত প্রায় ১০/১২ বছর ধরে নারী বিদ্বেষ লক্ষ্য করছি আমরা। নারীকে পেটানো, গালাগালি করা, চুল ধরে টানা, নারীর সাজ-পোশাক নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য করা, এমনকি নারীকে বিবস্ত্র করে সামাজিক মাধ্যমে ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা বারবার ঘটছে। এসব নিয়ে সমাজে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ছিল এবং ক্রমশ তা বাড়ছে।
সবচাইতে বিপদের কথা হলো হয়রানির শিকার হলেও কোনো নারী বিচার চাইতে পারেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্রী পোশাকের কারণে হেনস্থার শিকার হলেন, তাকে বিভিন্ন মাধ্যমে হত্যা ও ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র তাকেই না, তার সাথে সংহতি জানানো অনেক শিক্ষার্থীদেরও সরাসরি হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে।
ভক্তভোগী ছাত্রীর যাবতীয় ব্যক্তিগত তথ্য, মোবাইল নাম্বার, এনআইডি নম্বর, ঠিকানা, পিতামাতার নাম সকল কিছু ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শেষপর্যন্ত বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করে, নিরাপত্তাহীনতার কথা বলে, ম্যানিপুলেট করে ভিক্টিমকে মামলা তুলে নিতে বাধ্য করা হয়েছে।
অপরাধীর বয়ান থেকেই স্পষ্ট যে, এই অপরাধ সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র অনুশোচনাবোধও নেই। এই লোক বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে কাজ করেন। তার চাকরিও থাকছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা কীভাবে এর কাছে নিরাপদ থাকবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা অন্যান্য বিষয়ে আন্দোলন করেন, কিন্তু তাদের সহপাঠীর হয়রানি নিয়ে কিছু বলছেন না কেন? কেন এখনো একটা বড় সমাবেশ, জোরালো কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে দেখলাম না?
এই যে আমরা সবাই চুপ করে আছি, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলছি না– এটাই ফ্যাসিবাদী ভীতিকরণ প্রক্রিয়ার মনস্তত্ব। মব বা কিশোর গ্যাং পাঠিয়ে বাড়িতে হামলা বা নারীকে হেনস্থা করা হবে, তারপর লোক দেখানো গ্রেপ্তার করা হবে। কিছু দুর্বৃত্ত গিয়ে থানা ঘেরাও করে হুমকি দিতে থাকবে। এরপরই অভিযুক্ত অপরাধীকে ছেড়ে দেওয়া হবে। এসব ঘটনা ঘটতে থাকলে মাত্র কয়েকজন কিশোর গ্যাং সদস্যকে ব্যবহার করে অপরাধী চক্র পুরো সমাজকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলতে পারবে এবং করছেও। এরকম কয়েক মাস চললেই তারা যা বলবে জনগণ সেটাই শুনবে, কেউ প্রতিবাদ করবে না। যেমন এখন কেউ করছেন না।
কয়েক বছর আগে ধানমন্ডি লেকের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মাঝবয়সী একজন নারী আমাকে বললেন, 'মাথায় কাপড় দেন নাই কেন? কাপড় দেন।' আমিও প্রায় মধ্যবয়স্ক একজন নারী, কাজ করে খাই। কাজের সুবাদে নানাজনের সাথে চলতে-ফিরতে হয়, গ্রামেগঞ্জে যেতে হয়। এর আগে এই নসিহত আমাকে কেউ করেনি। আচমকা একজন অপিরিচিত নারীর কাছ থেকে এই কথা শুনে আমি দাঁড়ালাম। উনি ওড়না এবং হিজাব পরিহিত।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, 'আপনি কি আমাকে চেনেন? চেনেন না। তাহলে কেন আমাকে মাথায় কাপড় দিতে বললেন?' জবাবে বললেন, 'আপনার ভালার জন্যই কইলাম।' বললাম, 'আপনি যে মাথায় হিজাব পরে, গায়ে ওড়না পেঁচিয়ে রেখেছেন, আমি কি আপনাকে এগুলো ফেলে দিতে বলেছি? আপনার ইচ্ছা আপনি দিয়েছেন। পারলে আরো দুটো দেন। কিন্তু আমাকে বা অন্য কাউকে গায়ে পড়ে এইসব পরামর্শ দেবেন না। আপনার ইচ্ছা হলে আরো বেশি করে মাথা ঢাকা দেন।'
এই সমাজে কিছু মানুষ আছে, যাদের নারীদের উপদেশ দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই উপদেশ দেওয়ার প্রবণতা এখন আর শুধু মুখের কথাতে সীমাবদ্ধ নেই। এ রীতিমতো আক্রমণাত্মাক হয়ে উঠেছে। কয়েক বছর ধরেই দেখছি দেশের বিভিন্ন জায়গায় পোশাকের কারণে নারীর ওপরে হামলা হচ্ছে।
এইতো কিছুদিন আগে (৯ জুন, ২০২২) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটি অল্পবয়সী মেয়ে রিকশায় চড়ে যাওয়ার সময় তার বুকে হাত দিয়ে টেনে তার পরনের জামা ছিঁড়ে দেওয়া হয়। হোন্ডা আরোহী লোকগুলো শুধু জামা ছিঁড়ে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, উল্টো কুৎসিত ভাষায় গালাগালি করেছে মেয়েটিকে। মেয়েটি কেন এই কুর্তি বা কামিজ পরে যাচ্ছে, এইজন্য তারা অশ্র্যাব্য ভাষায় মেয়েটিকে গালিগালাজ করেছে। তখন রাস্তার একজন মানুষও এগিয়ে আসেনি, দাঁড়ায়নি মেয়েটির পাশে।
এই ঘটনাগুলো সমাজে এমনি এমনিই ঘটছে না। একশ্রেণির অসভ্য ইতর লোক নোংরা উদ্দেশ্য নিয়ে এই কাজগুলো করছে। তাদের উদ্দেশ্য নারীকে অপমানিত করে গুহার জীবনে পাঠিয়ে দেওয়া। তাদের এই দুর্বিনীত আচরণ দেখে সমাজের সুস্থ মানুষগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করলেও, অসংখ্য লোক এই আচরণের পক্ষে। পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত এই সংক্রান্ত খবরের নিচে পাঠকের প্রতিক্রিয়ায় সবই নারীর স্বাধীন পোশাক পরার বিপক্ষে।
এই যে সেদিন পারস্পারিক গোলযোগের এক পর্যায়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নারী সদস্যকে কামড়ে দিল, ঢাবি'র ছাত্র। আরেকটি মেয়েকে হেনস্থা করা হলো একই সময়। মিডিয়া যখন এই গোলযোগের লাইভ প্রকাশ করছিল, তখন অসংখ্য মানুষ ছাত্রী দুজনকেই অশ্রাব্য ভাষায় কটুক্তি করছিল।
২০২২ সালে বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও ডিনেটের করা একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, পোশাক বা আচরণ দেখে মুহূর্তে কোন মেয়েকে 'ভাল মেয়ে বা মন্দ মেয়ে' হিসাবে বিচার করার প্রবণতা বাড়ছে। এবং কাউকে 'মন্দ মেয়ে' বলে মনে হলে তাদের ওপর আক্রমণের হারও বেড়ে যাচ্ছে। এই আক্রমণ করাটাকেও অধিকাংশ মানুষ যৌক্তিক বলে মনে করেন।
গবেষণা বলছে, মেয়েরা যখন নিজেদের পছন্দ মতো পোশাক পরে ও স্বাধীনভাবে চলাফেরা করেন, সেই মেয়েদের নানাভাবে হেয় করা হয় ও তাদের প্রতি অপমানজনক আচরণ করা হয়—এমনটিই মনে করেন শতকরা ৮১ জন উত্তরদাতা। এর পাশাপাশি শতকরা ৬৪ জন মানুষ মনে করেন যেসব মেয়ে আচরণ ও পোশাকে সামাজিকতা মানেনা, স্বাধীনভাবে চলতে চান এবং আচরণে নারী-পুরুষ বিভেদ করেন না, তাদের প্রতি অন্য মানুষ কটুক্তি, সমালোচনা, তির্যক মন্তব্য ও অপমানজনক আচরণ করতেই পারেন, এটা কোনো অপরাধ নয়।
একজন নারীর পছন্দের পোশাকের প্রতি অন্য নারীর যে ক্ষোভ–এর সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। এর সাথে সম্পর্ক আছে হীনতা, নীচতা, নিজের পরাধীন জীবন, বন্দীত্ব, যৌন ঈর্ষা ও নিজের স্বামী বা ছেলেকে নিয়ে অনিরাপত্তার বোধ। মাঝেমাঝে আমরা ভাবি, একজন নারী কেন অন্য নারীকে আচার-আচরণ ও পোশাকের জন্য হেয় করেন? এর মূল কারণ হলো সেই নারীর ভেতরে থাকা নারীবিদ্বেষ (ইন্টার্নালাইজড মিসজিনি)।
গবেষণাটি বলছে, আমাদের দেশে ইন্টার্নালাইজড মিসজিনি বাড়ছে। এই বিদ্বেষ থেকেই নারী, নারীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন। নারী দিয়ে নারীকে হেনস্থা করাতে পারলে পুরুষের পক্ষে হেনস্থা করার অধিকার বেড়ে যায়। আমাদের এই সমাজ মনে করে 'মন্দ মেয়ে'র মতো আচরণ সমাজে অনাকাঙ্খিত; কারণ সেটা অন্য ছেলেমেয়েদের নষ্ট করে ফেলে। নারীর প্রতি এই অদ্ভুত অবমাননাকর ধারণা পোষণ করেন শতকরা ৭৯ জন উত্তরদাতা। আর তাই অনলাইনে দেখানো 'মন্দ মেয়ে'র মতো আচরণ যারা করেন, তাদের সেটা থেকে বিরত রাখার জন্য তাকে হেয় করা, তাদের মন্দ বলা ও তাদের প্রতি অপমানজনক আচরণ করা সমাজের জন্য উপকারী বলে মনে করেন শতকরা ৪৪ জন উত্তরদাতা। সাম্প্রতিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা এটাই প্রমাণ করেছে।
'ভাল মেয়ে', 'মন্দ মেয়ে' নিয়ে সমাজে প্রচলিত এই যে স্টেরিওটাইপ বা বহুল প্রচলিত ধারণা, এর আলোকে মনে করা হয় মন্দ মেয়ে, মন্দ ছেলের চাইতেও বেশি বিপজ্জনক—এমনটা মনে করেন শতকরা ৭৪ জন উত্তরদাতা। এখানে নারীকে হেয় করতে গিয়ে পুরুষের মন্দ হওয়াটাকেও একধরনের সমর্থন দেওয়া হয়েছে।
এই সমাজে সেক্সসিজম হচ্ছে নারীকে শায়েস্তা করার একটা হাতিয়ার। সবচাইতে ভয়ংকর দিকটি হচ্ছে বাংলাদেশে পর্ণ মুভির কনটেন্ট ঠিক করে দিচ্ছে যে, এই সমাজে কে 'ভাল মেয়ে', আর কে 'মন্দ মেয়ে'? এই 'ভালো' ও 'মন্দ' মেয়ের সাথে সমাজ কী আচরণ করবে সেটাও তারাই নির্ধারণ করে দিচ্ছে।
অন্যদিকে, সব সরকার মনে করে যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, গণধর্ষণের জন্য আইন আছে। তাহলে আমাদের করণীয় আর কী থাকতে পারে? কিন্তু আমরা দেখছি যৌন নিপীড়ণ ও ধর্ষণের জন্য এই প্রথাগত ও আইনী শাস্তি কোনো কাজেই আসছে না। কারণ লম্বা পথ পার হয়ে, বহু প্রতিকূল পরিস্থিতিকে পাশ কাটিয়ে, রক্ত চোখ উপেক্ষা করে এবং সমাজের কুৎসিত মতামতকে অগ্রাহ্য করে একজন ভিকটিম ও তার পবিবারকে বিচারকের দরজায় পৌঁছাতে হয়, যা অধিকাংশ পরিবার বা ব্যক্তির পক্ষে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব।
একটি কথা বলে রাখা ভালো যে, বাংলাদেশে একশ্রেণির পুরুষ আছেন, কাউকে যৌন হয়রানি করতে তাদের কোনো কারণ বা বয়স লাগে না। এরা এতটাই বিকৃত ও অসভ্য মানসিকতার যে দুই মাসের শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণী, বিবাহিতা নারী, হিজাব পরা বা সালোয়ার কামিজ পরা নারী কাউকেই ছাড় দেননা। এমনকি, নিয়মিত যৌনকর্মীর কাছে গিয়েও আশ মেটেনা এবং সময়-সুযোগ পেলে যৌনকর্মীকেও ধর্ষণ করেন।
কেউ কি বলতে পারেন, কেন মাগুরার ৮ বছরের শিশুটিকে তার বোনের শ্বশুর ধর্ষণ করেছে? ছয় বছরের পূজাকে ধর্ষণ করে চিরতরে অসুস্থ ও পঙ্গু করেছে যে অমানুষটি, সে কীভাবে জেল থেকে ছাড়া পেলো অনায়াসে? কেন ৪/৫ বছরের অসংখ্য শিশুকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়? কেন কুমিল্লার তনুকে হিজাব পরার পরেও ধর্ষণের শিকার হয়ে নিহত হতে হয়েছে। কেন ফেনীর মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাতকে যৌন হয়রানির পর মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পুড়িয়ে মেরেছিল? জানি, এসব কেন-এর কোনো উত্তর নেই। তবে পোশাক পরার কারণে যে এরা ধর্ষণের শিকার হননি, তা বলতে পারি।
সব সরকার মনে করে 'ধর্ষণ একটি সামাজিক সমস্যা'। আমরা বলতে চাই, ধর্ষণসহ নারীর প্রতি যৌন নির্যাতন করাটা একদল পুরুষের 'মানসিক সমস্যা'। গণভবনে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আন্ডার গার্মেন্টস নিয়ে যখন কিছু তরুণ নৃত্য করছিল, সেদিন একজনও এর নিন্দা করেননি, এমনকি কোনো নারী নেত্রীও নন। ভেবেছেন স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার আন্ডার গার্মেন্টস নিয়ে ছেলেপেলেরা খুব আনন্দ করছে। এরপর যখন কেউ কেউ শেখ হাসিনা ও মোদিকে নিয়ে অশ্লীল ও ইঙ্গিতপূর্ণ কার্টুন আঁকলো, তখনও আমরা মজা ভেবে উপভোগ করেছি। এর আগেও বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে খুবই বাজে মন্তব্য করা হয়েছে। বেগম জিয়া যেদিন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেন, সেদিনও তার মেকআপ নিয়ে হাসাহাসি করতে ছাড়িনি। কাজেই নারী অবমাননা আমাদের ভেতরে, সে প্রধানমন্ত্রীই হোক, আর ঘুঁটেকুড়ানিই হোক। এই মানসিক অসুস্থতা থেকে মুক্তি নেই।
শাহানা হুদা রঞ্জনা: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।