চলমান শহরের ভাসমান বিক্রেতা তারা

শহরের বাসে টুথব্রাশ, কলমের মতো জিনিস বিক্রি করা ফেরিওয়ালাদের চেয়ে আলাদা টিপু সুলতান। সত্যি বলতে কী, তাকে আর দশজন সাধারণ ভাসমান বিক্রেতার সঙ্গে মেলানো যাবে না। টিপু সুলতান একজন লেখক। গত পাঁচ বছরে তিনি দুটি বই এবং কয়েকটি জেলার মানচিত্র প্রকাশ করেছেন।
গর্বিত টিপু জানান, 'আমি বইগুলো লিখেছি, [রেলপথে বাংলাদেশ ও বোনাস: বেসিক স্পোকেন ইংলিশ গাইড], সেগুলো প্রকাশ করেছি এবং নিজেই বিক্রি করেছি। রেলপথে বাংলাদেশ বইটির ১ লাখ ২২ হাজার কপি বিক্রি করেছি, তা-ও ট্রেনে।'
এর জন্য তিনি কয়েকজন বিক্রয়কর্মী নিয়োগ করেছেন। 'কিন্তু এ [কাজের] জন্য আপনাকে শিক্ষিত, চটপটে তরুণ হতে হবে। আমাকে দেখুন, প্রায় টাক হয়ে যাওয়া মাথার সব চুল ধূসর। বয়স হয়েছে বলে আমি জোরে জোরে ক্যানভাসও করতে পারি না। কিন্তু বিক্রয়কর্মীদের নিয়ে আমি কখনোই সন্তুষ্ট ছিলাম না। তাই ২০১৭ সালে নিজেই বাসে উঠে পড়ার সিদ্ধান্ত নিই,' স্মরণ করেন টিপু।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যানুসারে, ঢাকা শহরে ৩৬৬টি বাস রুট রয়েছে। এসব রুটে বছরভর ১৫০টিরও বেশি কোম্পানির বাস চলে।
যেসব রুটে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বাস রয়েছে সেগুলো হলো—মতিঝিল-উত্তরা, মতিঝিল-মোহাম্মদপুর, মতিঝিল-মিরপুর-১০ ও মতিঝিল-গাবতলী। এই রুটগুলোতে সবচেয়ে বেশি যাত্রী চলাচল করে। এসব বাসের প্রায় সবগুলোই গুলিস্তান, শাহবাগ, বিজয় সরণি, কারওয়ান বাজার ও বাংলামোটর পার করে।
শহরের এই পয়েন্টগুলো টিপু সুলতানের মতো ফেরিওয়ালাদের জন্য সবচেয়ে লোভনীয় জায়গা। টিপু কিন্তু ব্যবসায়ীও। খিলগাঁওয়ের ফকির আলমগীর লেনে একটি ইলেকট্রনিকসের দোকান আছে তার। কিন্তু তারপরও তিনি বাসে বই বিক্রি করেন।
এর কারণ জানাতে গিয়ে তিনি বললেন, 'আমার বয়স হয়ে গেছে, যেকোনো সময় মারা যেতে পারি। আর মনে রাখার মতো কিছুই না করে আমি মারা যেতে চাই না। তাই আমি আমার বই দিয়ে মানুষের মনে জায়গা করে নেওয়ার জন্য এই পথ বেছে নিয়েছি।'
টিপু বেশ কয়েকজন প্রকাশকের কাছেও গিয়েছিলেন তার বইটি বইমেলায় প্রকাশের জন্য। কিন্তু কয়েকবার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর তিনি বাসেই ক্যানভাসিংয়ের মাধ্যমে বই বিক্রির পথ বেছে নেন।
তবে সবাই টিপু সুলতানের মতো সৌভাগ্যবান না। নিজের পছন্দের জিনিস নিয়ে কাজ করার ভাগ্য আর সুযোগও সবার হয় না।
মো. শাহ আলমও ফেরিওয়ালা। রাজধানীর বাসে বাসে সম্ভাব্য গ্রাহকদের খোঁজে ঘুরে বেড়ান তিনি।
শাহ আলমের বেড়ে ওঠা বগুড়ায়। পরিবারের একমাত্র সন্তান হিসেবে সবার আদর-ভালোবাসার মধ্যে বেড়ে ওঠেন। ২৫ বছর বয়সে সরকারি আজিজুল হক কলেজে ইসলামিক স্টাডিজে স্নাতকোত্তর করার সময় শাহ আলমের জীবনে ঘটে যায় এক মর্মান্তিক ঘটনা। আর তাতেই ঘুরে যায় তার জীবনের মোড়।
এক প্রলয়ঙ্করী নদীভাঙন কেড়ে নেয় শাহ আলমের বাড়ি, তার যৌবন, তার পরিচয়।
বেদনাকাতর কণ্ঠে অতীত-স্মৃতি স্মরণ করেন শাহ আলম, 'আমার সারাটা জীবন কেটেছে বগুড়ায়। … তারপরে একদিন সকালে আমাকে এই জীবন ধরিয়ে দেওয়া হলো। এ জীবনে আমি প্রথম শ্রেণির স্নাতক ডিগ্রিওয়ালা এক অসহায় হকার, যার কাজ সিটি বাসে টুথব্রাশ আর অন্যান্য জিনিস বিক্রি করা।'
যমুনা নদীর ভাঙনের কারণে শাহ আলম ঘর হারান। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের ইচ্ছেও বিসর্জন দিতে হয়। তার বৃদ্ধ বাবা-মা এখন বগুড়ায় ভাড়া বাসায় থাকেন। শাহ আলম ঢাকায় আসেন চার বছর আগে। সেই থেকে তিনি ঢাকায় বাসে বাসে ইংরেজি ব্যাকরণের বই, টুথব্রাশ ইত্যাদি বিক্রি করেন।
শাহ আলম সাধারণ মিরপুর-কারওয়ান বাজার-শাহবাগ রুটের বাসে পণ্য বিক্রি করেন। তিনি এসব পণ্য কেনেন পুরান ঢাকার চকবাজার ও সদরঘাট থেকে। প্রতিদিন গড়ে তার লাভ থাকে ৫০০ টাকা।
কিন্তু এই জীবনে মানিয়ে নেওয়া তার জন্য সহজ ছিল না। ঘর-বাড়ি হারানোর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এই ব্যবসায় নেমে পড়েছিলেন—ব্যাপারটা এমন নয়। শাহ আলম বলেন, 'আমি বরাবরই ছাত্র হিসেবে ভালো ছিলাম। আমার প্রথম শ্রেণির স্নাতক ডিগ্রি ছিল। আর কোনো স্নাতক হকার হওয়ার কথা ভাববে বলে আমার মনে হয় না।'
বাড়ি হারানোর পর শাহ আলম স্থানীয় এমপির কাছে যান, একটা চাকরি বা বিনিয়োগ পাওয়ার আশায়। তিনি জানালেন, 'প্রায় এক বছর ধরে তার কাছে যাই আমি। কিন্তু কিছুই পাইনি। একটা সাহায্যও পাইনি তার কাছ থেকে। এরপর একজন আমাকে রাজধানীতে চলে আসার পরামর্শ দিলেন। তার পরামর্শ শুনে চলে এলাম এখানে। অনেক ভুল-ভ্রান্তি আর নিজেকে বোঝানোর পর অবশেষে আজ আমি পেশাদার ক্যানভাসার ওরফে হকার।'

শাহ আলম নিজেকে পেশাদার হকার বলে পরিচয় দেন, কারণ এখন তিনি এই ব্যবসার প্রতিটি গলিঘুপচি চেনেন। তিনি বাস কন্ডাক্টরদের চেনেন। জানেন কোন বাসে হকারদের উঠতে দেয়, কোন সময় যাত্রীরা সবচেয়ে বেশি বিরক্ত হয়।
শাহ আলম এখন আমি যাত্রীদের চেহারা দেখে বলে দিতে পারেন তাদের মানাতে পারবেন কি না।
নারীরা সেরা শ্রোতা, কিন্তু…
শাহ আলম মনে করেন, বাসযাত্রীদের মধ্যে নারীদের তুলনামূলক সহজে মানানো যায়—কিন্তু আসল ক্রেতা পুরুষরাই। সিংহভাগ মহিলা যাত্রীরই পণ্য কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার থাকে না বলে জানালেন শাহ আলম। বেশিরভাগ সময়ই কেনার সিদ্ধান্ত নেন নারীদের পুরুষ সঙ্গীরা। আর তাছাড়া, পুরুষদের তুলনায় বাসে নারীর সংখ্যাও সবসময় কমই থাকে।
তবে শাহ আলমের সঙ্গে একমত নন আরেক ভাসমান বিক্রেতা মো. মহসিন। মহসিন গত ১৫ বছর ধরে জিনিস ফেরি করছেন। ডাল ঘুটনির মতো রান্নাঘরের প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে শুরু করে ব্যথা উপশমকারী মলম ও কাশির ক্যান্ডি পর্যন্ত বিক্রি করেছেন মহসিন সারা ঢাকা শহরে।
মহসিনের মতে, নারীরাই সবসময় সেরা ক্রেতা। সাভার থেকে চিটাগং রোডে যাতায়াতকারী লাব্বাইক বাসে তার সঙ্গে যেদিন দেখা, সেদিন তিনি জাম্বাক নামে একটি মলম বিক্রি করছিলেন। তার দাবি, এ মলম যেকোনো ধরনের পেশির ব্যথা উপশম করতে পারে।
দুজন বয়স্ক মহিলা তার কাছ থেকে মলমটি কেনেন। আর একজন একজন মহিলা অভিযোগ করেন যে, এই মলমে কোনো কাজ হয় না। কিন্তু মহসিন তার কথায় খুব একটা পাত্তা দেননি। বাস থেকে নামার আগে তিনি তিনটি মলম বিক্রি করেন।
মহসিন বলেন, 'আমাদের দেশের মহিলারা রোগ নিয়ে অন্যদের বিরক্ত করতে চান না। তাই তারা সস্তায় সমাধান খোঁজেন। এই যেমন শীতের সময় আমি প্রচুর কাশির ক্যান্ডি বিক্রি করেছি। তার বেশিরভাগ ক্রেতাই ছিল মহিলা।'
'গত ১৫ বছর ধরে আমি সাভার থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত প্রায় প্রতিটা বাসে জিনিসপত্র বিক্রি করেছি। সময়ের সাথে সাথে, বছরের পর বছর ধরে মহিলাদের সংখ্যা বেড়েছে,' জানালেন মহসিন।
আর এখন যখন মূল্যস্ফীতির চাপে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ যখন জেরবার, তখন আশাবাদী হয়ে উঠেছেন মহসিন ও শাহ আলমের মতো ফেরিওয়ালারা। এবার তাদের বিক্রি বেড়ে যাবে বলে আশা করছেন তারা। কারণ, পণ্য স্বাভাবিক বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক সস্তা।
গুছিয়ে কথা বলতে পারা গুরুত্বপূর্ণ
প্রত্যেক ফেরিওয়ালারই ক্রেতার কাছে পৌঁছানোর জন্য নিজস্ব কৌশল ও শৈলী আছে। যেমন শাহ আলম তার বক্তব্যে প্রচুর ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন। তিনি মনে করেন, ইংরেজি ব্যবহারের ফলে লোকে তাকে শিক্ষিত মনে করে। ফলে তার কাছ থেকে জিনিস কিনতে আগ্রহী হন অনেকে।
অন্যদিকে, মহসিনের মূল ভরসা তার গতি ও ছন্দ। 'আপনি যখন একটা নির্দিষ্ট ছন্দে কথা বলবেন, লোকে আপনাকে খেয়াল করবে। আর আপনি যদি আত্মবিশ্বাসের সাথে উঁচু গলায় কথা বলেন, তাহলে নিশ্চিত থাকুন, ক্রেতারা আপনাকে বিশ্বাস করবে।'
তবে টিপু সুলতানের ধ্যান-ধারণা একটু আলদা। 'সবাই শিক্ষিত না, তাই সবাই বই কিনবেও না। তাই আমি কিছু মনে করি না। আমি চাই প্রকৃত পাঠকেরা আমার বই কিনুক।'