কর্মী থেকে গার্মেন্ট মালিক ছবি সিকদার

গার্মেন্টে কাজ করার সময় স্বপ্ন দেখেন বড় কিছু করার। চাকরি ছেড়ে একটি শেলাই মেশিন কিনে ঘরের মধ্যে শুরু করেন কাপড় শেলাইয়ের কাজ। কিছুদিনের মধ্যে একটি শেলাই মেশিন থেকে দু'টি, দু'টি থেকে চারটি, চার থেকে আটটি। প্রবল ইচ্ছা ও পরিশ্রমের কারণে অল্প দিনেই ব্যবসার প্রসার ঘটে। বনে যান গার্মেন্টের মালিক।
বাংলা চলচ্চিত্রে শাবানার এই অভিনয় দেখেননি- এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। তবে এমন ঘটনা শুধু সিনেমায় নয়, বাস্তবেও ঘটে। সিনেমার এমন গল্পকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন চট্টগ্রামের ছবি সিকদার। দীর্ঘ ১৯ বছর গার্মেন্টের সামান্য কর্মী হিসেবে কাজ করে আজ তিনি নিজেই একটি গার্মেন্টের মালিক।
তিনি প্রমাণ করেছেন, শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও শুধুমাত্র প্রবল ইচ্ছা আর পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবনে সফল হওয়া সম্ভব।
দীর্ঘ ১৯ বছরের কর্মজীবনে ছবি সিকদার কাজ করেছেন ক্লিপটন গ্রুপ, ফোরএইচ গ্রুপ এবং ইপিজেডের জেমিনাসের মতো প্রতিষ্ঠানে। কিছু করার ইচ্ছা থেকে ২০১৬ সালে পাঁচ লাখ টাকা পুঁজি খাটিয়ে ঘরের মধ্যে ছয়জন কর্মী নিয়ে শুরু করেন সেলাইয়ের কাজ। সেখান থেকেই শুরু তার জীবনের নতুন অধ্যায়।

এরপর ২০১৮ সালে দুই হাজার বর্গফুটের একটি ফ্লোরে গড়ে তোলেন সেন্স ফ্যাশন লিমিটেড নামে একটি পোশাক কারখানা। যেখানে এখন কাজ করছেন ১১০ জন নারী শ্রমিক। এভাবেই তিনি গার্মেন্ট কর্মী থেকে হয়ে উঠলেন একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। ব্যাংক থেকে ভালো ঋণ সুবিধা এবং জায়গা পেলে একটি গ্রিন ফ্যাক্টরি গড়ে তোলার স্বপ্ন রয়েছে ছবি সিকদারের।
চট্টগ্রাম নগরীর নতুন চাক্তাই এলাকার রাবেয়া টাওয়ারের দ্বিতীয় তলায় গড়ে তোলেন সেন্স ফ্যাশন। নিট ওয়্যার (আন্ডার গার্মেন্ট) এবং ওভেন (শার্ট ও টি-শার্ট জাতীয় পোশাক) তৈরি করা এ প্রতিষ্ঠানে। এখানে উৎপাদিত পণ্য যাচ্ছে ইউরোপ ও আমেরিকায়।
সরেজমিনে সেন্স ফ্যাশনের ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ল বিদেশি একটি অর্ডারের কাপড়ের ব্যাগ। এ ছাড়া ফ্লোরে প্যাকিং করা অবস্থায় পড়ে রয়েছে টি-শার্ট ও সেন্ডু গেঞ্জি। একটি টেবিলে বসেই কাজের তদারকি করছেন ছবি সিকদার। আবার কিছুক্ষণ পর পর কর্মীদের কাজ হাতে কলমে শিখিয়ে দিচ্ছেন তিনি।
বেলা ১টা বাজতেই দেখা গেল শ্রমিকরা মেশিন বন্ধ করে বেরিয়ে পড়ছেন দুপুরের খাবারের জন্য। দুপুরটা থেকে আবারও কাজ শুরু করেন তারা।
ছবি সিকদারের ঘুরে দাঁড়ানোর পথটা মসৃণ ছিল না। ১৯৯৭ সালে ১৩ বছর বয়সে বাবা মনোরঞ্জন সিকদার মারা যাওয়ার পর অভাবের তাড়নায় কাজ নেন ক্লিফটন গ্রুপের একটি গার্মেন্টে। তখন বেতন পেতেন মাত্র ১৪০০ টাকা।
পড়াশোনা করার ইচ্ছা থেকে ২০০৪ সালে ভর্তি হন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল শাখায়। কিন্তু সংসারের টানাপোড়েন ও কাজের চাপে লেখাপড়া শেষ করতে পারেননি তিনি। ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন কারখানায় কাজ করে হয়েছেন এক্সিকিউটিভ। তখন সব মিলিয়ে বেতন পেতেন ৫০ হাজার টাকা।

নতুন কিছু করার ইচ্ছা থেকে কাজ ছেড়ে শুরু করলেন নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়াতে। মাত্র পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে ঘরের মধ্যে আটটি সেলাই মেশিন ও ছয়জন নারী কর্মী দিয়ে শুরু হয় নতুন স্বপ্ন। এ স্বপ্নের নাম দিলেন 'সেন্স ফ্যাশন লিমিটেড'।
প্রথম দিকে স্টক লটের ফ্রেব্রিক্স দিয়ে বিভিন্ন লোকাল মার্কেটে পোশাক সরবরাহ করতেন। কিন্তু সময়মতো টাকা ফিরে না আসার কারণে পড়তে হয়েছে বিপাকে। পরে বড় বড় কারখানা থেকে সাব কন্ট্রাক্টের অর্ডার নিতে শুরু করলেন।
প্রতিষ্ঠান বড় করার জন্য বিভিন্ন ব্যাংকে ধর্ণা দিলেও পাননি পর্যাপ্ত ঋণ। তারপরও ২০১৮ সালের মার্চ মাসে পাঁচ হাজার বর্গফুটের বিশাল ফ্লোরে ৬০টি মেশিন দিয়ে শুরু করেন সেন্স ফ্যাশনের কাজ। বর্তমানে তার রয়েছে ৮৭টি মেশিন। কাজ করছেন ১১০ জন নারী কর্মী।
এখন তার বিনিয়োগও প্রায় এক কোটি টাকা। প্রতিমাসে কর্মীদের বেতন, ফ্লোর ভাড়া এবং অন্যান্য খরচসহ দিতে হয় ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা।
ছবি সিকদার বলেন, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় একটি গ্রিন ফ্যাক্টরি করার ইচ্ছা আছে আমার। এছাড়া সরাসরি বিদেশি বায়ারদের সঙ্গে কাজ করারও ইচ্ছে রয়েছে। আমার স্বামী প্রতিষ্ঠানের কমার্সিয়াল সাইটটা দেখেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই যেহেতু কর্মজীবী, তাই ভারতের কলকাতায় শাশুড়ির কাছে রেখে একমাত্র ছেলেকে পড়াচ্ছি। ছেলেই আমার ভবিষ্যত। সে-ই একদিন এ ব্যবসার হাল ধরবে।

কর্মীদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি নিজেও কর্মী ছিলাম। তাই আমার কর্মীদের সন্তানের মতো দেখি। আমি জানি শ্রমিকদের কোথায় কী সমস্যা। তাদের খুশি রাখার চেষ্টা করি। প্রতিষ্ঠানের খরচ সামলে যা অবশিষ্ট থাকে তাতেই আমি খুশি। বেশি লাভ করতে চাই না। আমি তেমন লেখাপড়া করতে পারিনি। কিন্তু আমার মতো যারা নিরক্ষর শ্রমিক রয়েছে, তাদের জন্য ভবিষ্যতে এক ঘণ্টা করে লেখাপড়া করার চিন্তা ভাবনা রয়েছে আমার।
পোশাক কারখানার প্রতিবন্ধকতা প্রসঙ্গে ছবি বলেন, এ সেক্টরের জন্য পর্যাপ্ত ঋণ সুুবিধা দরকার। কিন্তু আমরা ঋণ চাইতে গেলে ব্যাংক খোঁজে বড় অংকের মর্টগেজ। তাছাড়া এসএমই লোনে যে টাকা দেয়, তা দিয়ে কিছুই হয় না। তাই সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদে ঋণ সুবিধা দেওয়া দরকার। পাশাপাশি বিভিন্ন অর্থনৈতিক জোনগুলোতে আমাদের মতো নারী উদ্যোক্তাদের প্লট বরাদ্দ দেওয়া উচিত।
সেন্স ফ্যাশনে শুরু থেকে কাজ করা রিনা আকতার বলেন, আমাদের যেকোনো প্রয়োজনে এগিয়ে আসেন ছবি দিদি। পরিবারের কোনো সমস্যা কিংবা ছুটি লাগলে তা দিতে কার্পণ্য করেন না তিনি।
রূপা বেগম নামে আরেক কর্মী বলেন, নির্দিষ্ট সময়ে বেতন পাই আমরা। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতাও পাই এ প্রতিষ্ঠান থেকে। আমরা এখানে পরিবারের সদস্যদের মতো কাজ করি।