জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা: রমজানের আগেই ভোট, দুই মাস আগে তফসিল
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা (রোডম্যাপ) ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কমিশন রমজানের আগেই নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে এবং ভোটের তারিখের প্রায় ৬০ দিন আগে তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) দুপুর আড়াইটার দিকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের কমিশন কার্যালয়ের মিডিয়া সেন্টারে এক ব্রিফিংয়ে রোডম্যাপের বিস্তারিত তথ্য সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন ইসি সচিব আখতার আহমেদ।
নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, 'প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে বলা হয়েছে যে আগামী রমজানের আগে ভোটের ব্যবস্থা করতে। এখন আগামী রমজান, আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে তাহলে ১৭ বা ১৮ ফেব্রুয়ারি বা ১৯ তারিখে এরকম দিকে হবে। কাজেই আপনি ওইভাবে আপনি হিসাব করে নিতে পারেন। আমাদেরও হিসাবটা হয় ১৭ কি ১৮।'
তবে চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় নির্দিষ্ট তারিখ এখনই বলা সম্ভব নয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ইসি সচিব আরও জানান, নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে শুরু করে নভেম্বর পর্যন্ত দেড় মাসব্যাপী অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে। এতে সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক দল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নারী সমাজের প্রতিনিধি এবং গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা অংশ নেবেন।
ভোটার তালিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ২ মার্চ একটি তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। ৩১ আগস্ট আরেকটি তালিকা প্রকাশ করা হবে। চূড়ান্তভাবে, ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত যারা ভোটার হওয়ার যোগ্য হবেন, তাদের নিয়ে নভেম্বরের শেষে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত শুনানি শেষে আগামী ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এটি চূড়ান্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা ব্যবহারের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত বলেও জানান সিইসি। তিনি বলেন, এটি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কিত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদি এটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়, তবে নির্বাচন কমিশন সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, রোডম্যাপ অনুযায়ী মোট ২৪টি বিষয় ২০৭ ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচনি আইন সংস্কার, সংসদীয় আসনের সীমানা চূড়ান্তকরণ এবং প্রবাসী ও কারাবন্দিদের ভোটদানের মতো গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম।
রোডম্যাপ অনুসারে, নির্বাচনি আইন-বিধি সংস্কার (আরপিও) সংক্রান্ত প্রস্তাব আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে এবং ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এটি চূড়ান্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের আচরণবিধি এবং নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালাও চূড়ান্ত করা হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন প্রক্রিয়া ১২টি ধাপে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া দেশীয় ও বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিক নীতিমালা ১৫ নভেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত করা হবে।
ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন হবে। মাঠ প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও ব্রিফিং ৩১ অক্টোবরের মধ্যে দেওয়া হবে। নির্বাচন আইন-বিধি একীভূতকরণ এবং নির্বাচনি ম্যানুয়েল, নির্দেশিকা, পোস্টার ও পরিচয়পত্র ১৫ নভেম্বরের মধ্যে প্রস্তুত হবে। নির্বাচনি মালামাল ১ ডিসেম্বরের মধ্যে বিতরণ করা হবে।
ভোটকেন্দ্র চূড়ান্তকরণ ও প্যানেল প্রস্তুতি অক্টোবরের শেষের মধ্যে সম্পন্ন হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে প্রথম সভা ২৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনসংক্রান্ত সফটওয়্যার ৩১ অক্টোবরের মধ্যে প্রস্তুত রাখা হবে এবং এআই কার্যক্রম নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলবে।
এছাড়া, তফসিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি প্রচার শুরু হবে। নির্বাচনের ৩০ দিন আগে প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হবে। তফসিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও বাংলাদেশ বেতারে নির্বাচনি প্রচারের সুযোগ পাবে। প্রতীক বরাদ্দের পর রিটার্নিং অফিসারের তত্ত্বাবধানে প্রতিটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নিয়ে একই প্ল্যাটফর্মে নির্বাচনি ইশতেহার উপস্থাপনের একটি অভিনব ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
এছাড়া, এবার প্রবাসী বাংলাদেশি এবং কারাবন্দিদের পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। প্রবাসীদের নিবন্ধন ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করা হবে। তাদের কাছে ব্যালট পেপার ৫ জানুয়ারির মধ্যে পৌঁছানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে এবং নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে তা দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা করা হবে। কারাবন্দিদের কাছে ভোটের দুই সপ্তাহ আগে পোস্টাল ব্যালট পৌঁছানো হবে।
প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন (ইসি) প্রথমবারের মতো একটি নির্বাচন কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল। সে বছর ১৫ জুলাই দেড় বছরের এই পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়, যেখানে ২০০৮ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণার কথা বলা হয়েছিল। পরবর্তীতে এই ধারণাটিই 'রোডম্যাপ' (সম্পন্ন করার জন্য কাজের তালিকা) নামে পরিচিতি লাভ করে।
চলতি বছরের ৫ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক টেলিভিশন ভাষণে ঘোষণা করেন যে, আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে রমজানের আগে ১৩তম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। পরদিন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে নির্বাচন কমিশনকে প্রস্তুতি শুরু করার জন্য একটি চিঠি পাঠানো হয়।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার আরও জানান যে, নির্বাচনের দিন ঘোষণার প্রায় দুই মাস আগে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হবে। এক বৈঠকে আলোচনার পর ইসি জানায় যে, তারা ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণা করবে।