জ্বালানি সরবরাহ এখনও স্থিতিশীল, তবে ভর্তুকি ও মূল্য দুইই বাড়তে পারে

ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইতোমধ্যেই বিশ্ববাজারে রেকর্ড অবস্থানে পৌঁছেছে জ্বালানি পণ্যের মূল্য। নতুন করে দেখা দিয়েছে সরবরাহ বিচ্ছিন্নতা। সরকারের কিছু সময়োচিত পদক্ষেপের কল্যাণে স্বল্পমেয়াদে বাংলাদেশের জ্বালানি আমদানি প্রভাবিত না হলেও; যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে তা বড় রকমের আর্থিক ও সরবরাহ সংকটের হুমকি সৃষ্টি করবে।
মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে সিংহভাগ পেট্রোলিয়াম ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনায় যুদ্ধের আঁচ এপর্যন্ত বাংলাদেশের ওপর সামান্যই পড়েছে। কিন্তু ইউক্রেনে লড়াই ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি পণ্যের রেকর্ড পরিমাণে মূল্যবৃদ্ধি করেছে।
এ পরিস্থিতি আগামী মাসগুলিতে সরকারের ওপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করবে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বাংলাদেশের জন্যও সরবরাহ ঝুঁকি ও খরচের বোঝা অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে।
মহামারি থেকে উত্তরণের এ সময়ে এলএনজি ও তেলের সরবরাহ ব্যাহত হলে- বাংলাদেশের শিল্প আর রপ্তানিও ব্যাহত হবে।
বিশ্ববাজারে তেলের দাম এখনই ব্যারেলপ্রতি ১১১ ডলার অতিক্রম করেছে- যা ২০১৪ সালের পর সর্বোচ্চ। ইউরোপিয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়া যদি তেল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়, তবে এই দাম আরও চড়বে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছেন, "কতদিন যুদ্ধ চলবে তা অনুমান করা সম্ভব নয়। তবে যুদ্ধ চলতে থাকলে সরকারকে বিপুল পরিমাণ টাকা জ্বালানিতে ভর্তুকি দিতে হবে। আমরা আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণ করছি। আশা করি, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হবে না।"
জ্বালানির জন্য মধ্যপ্রাচ্য এবং এশীয় দেশগুলির উপর নির্ভরশীল হওয়ায়, বাংলাদেশ এই সংকট থেকে আপাতত নিরাপদে- তবুও ভবিষ্যতে হয়তো সংকটের কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে।
ডেলিভারি পেতে দেরি হওয়ায় বেসরকারি অপারেটরদের তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দেশের অন্যতম বৃহত্তম এলপিজি অপারেটর ওমেরা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের পরিচালক আজম জে চৌধুরী বলেছেন যে, তারা এরমধ্যেই শিপমেন্টে দেরি লক্ষ করছেন।
"বিশ্বের মোট গ্যাস উৎপাদনের ১২.২ শতাংশ করে রাশিয়া, আর রপ্তানিতে দ্বিতীয়। দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে সরবরাহ কমেছে এবং চাহিদা বেড়েছে। তাই, ডেলিভারি পেতে দেরি হচ্ছে"- বলেছেন আজম জে চৌধুরী, যিনি বাংলাদেশের এলপিজি অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনেরও সভাপতি।
তদুপরি, বাংলাদেশ যে সরবরাহ চক্রে নির্ভর করে ইউরোপীয় ক্রেতারা তাদের তেলের চাহিদা পূরণে সেই মধ্যপ্রাচ্যমুখী হতে পারে।
সরবরাহ সমস্যা ছাড়াও যুদ্ধের কারণে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি বাংলাদেশের সাধারণ ভোক্তারাও অনুভব করবে।
এর আগে গেল নভেম্বরে যখন আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম ৮০ ডলার ছিল; তখন সরকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়িয়েছে। এখন বিশ্ববাজারে দাম ১১০ ডলার প্রতিব্যারেল। ফলে স্থানীয় বাজারেও বৃদ্ধি প্রত্যাশিত।
অর্থ বিভাগের ওই অতিরিক্ত সচিব বলেন, "যুদ্ধ যদি কয়েক মাস ধরে চলতে থাকে এবং রাশিয়া প্রতিশোধ হিসেবে ইউরোপে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তাহলে সরকারকে ভর্তুকি চাপ সামলানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে এই বিষয়গুলো নিয়ে এখনও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা হয়নি।"
"জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী হলে, মূল্যস্ফীতিও বাড়বে। কারণ এটি বিশ্বব্যাপী কৃষিসহ শিল্প পণ্য উৎপাদন ও পরিবহনের প্রধান রসদ। তবে, এলএনজি সংকট এখনও আন্তর্জাতিক বাজারে আঘাত করেনি এবং দাম ৩০ ডলারের কাছাকাছি রয়েছে।"
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, যুদ্ধের প্রভাব তেল ছাড়াও বিভিন্ন পণ্য আমদানি ও রপ্তানিতে অনুভূত হবে।
তিনি আরও জানান, রাশিয়া ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ কমিয়ে দিলে ইউরোপের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং সেখানকার ভোক্তারা বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত কাপড়সহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য কেনা কমাতে বাধ্য হবে। তখন বাংলাদেশের রপ্তানিও কমবে।
অর্থ বিভাগের আরেক কর্মকর্তা উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে রপ্তানিকৃত পোশাকের একটি অংশ ইউরোপের কয়েকটি দেশ বার্টার চুক্তির আওতায় রাশিয়ায় রপ্তানি করত। চলমান যুদ্ধ এই সরবরাহ শৃঙ্খলাকে ব্যাহত করবে। এছাড়া, রাশিয়ায় বাংলাদেশের সরাসরি রপ্তানির পরিমাণ বর্তমানে প্রায় ৬০ কোটি ডলার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আরও জানান, বাংলাদেশের খাদ্য চাহিদার ৭০ শতাংশ চাল পূরণ করে, আর বাকী ৩০ শতাংশ মেটায় গম। বাংলাদেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে গম আমদানি করে। গম আমদানি ব্যাহত হলে দেশে চালের চাহিদা বাড়বে, ফলে চালের বাজারেও অস্থিরতা বেড়ে যাবে।
বিলম্বিত এলপিজি সরবরাহ, বাড়ছে খরচ:
চলমান সংকটের কারণে রান্নার গ্যাস হিসেবে পরিচিত তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ১ লাখ টন এলপিজির চাহিদা রয়েছে। সম্পূর্ণ আমদানিভিত্তিক এই এলপিজির জন্য দেশ মধ্যপ্রাচ্যের সরবরাহকারীদের উপর নির্ভরশীল।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববাজারে চাহিদা বৃদ্ধি এবং সরবরাহকারীরা চালানে বিলম্ব করার ফলে সংকট দেখা দিতে পারে।
ওমেরা-র আজম জে চৌধুরী বলেন, ডেলিভারি বিলম্বিত হওয়ার কারণে সরবরাহ ব্যাহত হলেও স্থানীয় সরবরাহে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না—কারণ বাংলাদেশি অপারেটররা সিংহভাগ এলপিজিই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে আমদানি করে।
তিনি আরও বলেন, "যুদ্ধের প্রভাব হিসেবে পণ্যের দাম দ্রুত বেড়ে গেছে, যা স্থানীয় বাজারে বিক্রিতে প্রভাব ফেলবে। কারণ মানুষের নির্দিষ্ট ক্রয়ক্ষমতা আছে।"
ওরিয়ন গ্যাস লিমিটেডের হেড অভ অপারেশন অনুপ কুমার সেন বলেন, সৌদি সিপি রেট অনুসারে, প্রোপেন ও বিউটেনের দাম ফেব্রুয়ারির চেয়ে প্রতি টনে ১৩৭.৫ ডলার বেড়েছে। ফেব্রুয়ারিতে প্রতি টনের সৌদি সিপি রেট ছিল ৭৭৫ ডলার, যা এখন বেড়ে ৯১২.৫ ডলার হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বাজারে ঘাটতির কারণে তারা সময়মতো সরবরাহ পাচ্ছেন না।
নিয়মিত সরবরাহের সঙ্গে আসছে আরও ৩টি এলএনজি কার্গো:
সাধারণত জাতীয় গ্রিডে রিগ্যাসিফাইড প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের জন্য বাংলাদেশ প্রতি মাসে পাঁচটি এলএনজি কার্গো পায়। তবে চলতি মাসে সরবরাহ বাড়াতে বাংলাদেশ অতিরিক্ত তিনটি এলএনজি কার্গো আমদানি করবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পেট্রোবাংলার একজন পরিচালক জানান, তারা চারটি এলএনজি কার্গো আনার ব্যবস্থা করলেও আমদানি ব্যয়ের চাপের কারণে শেষপর্যন্ত তিনটি আনা হচ্ছে।
তিনি বলেন, "আমরা কাতার এবং ওমানের মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে জ্বালানি আমদানি করি। এ কারণে আমাদের এলএনজি সাপ্লাই স্বাভাবিক থাকবে।"
বাংলাদেশ সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় প্রতি এমএমবিটিইউ (মেট্রিক মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট) এলএনজি ৬ ডলারে আমদানি করে। তবে কোভিডের অভিঘাত কাটিয়ে ওঠার এই সময়ে দাম বেড়ে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম এখন ২৮ ডলারে পৌঁছেছে।
ব্যয়বৃদ্ধির কারণে সরকার আমদানিতে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিচ্ছে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে এলএনজির ভর্তুকি বাবদ ৪ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। যার মধ্যে এপর্যন্ত ১ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
তবে পেট্রোবাংলা প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি চেয়ে অর্থমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছিল।
বাজেট বরাদ্দের অর্থ দিয়ে পেট্রোবাংলার চাহিদা মেটানো সম্ভব না হওয়ায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে অর্থ বিভাগ।
তেল সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন, কিন্তু লোকসান বাড়ছেই:
বর্তমানে বাংলাদেশে বার্ষিক ৬২ লাখ টন তরল জ্বালানির চাহিদা রয়েছে। এসব জ্বালানির মধ্যে রয়েছে ডিজেল, ফার্নেস অয়েল, জেট ফুয়েল, কেরোসিন, পেট্রোল ও অকটেন।
পেট্রোল ছাড়াও জ্বালানি তেলের জন্য বাংলাদেশ সম্পূর্ণ আমদানি-নির্ভর। আমদানি করা মোট জ্বালানির মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই পরিশোধিত জ্বালানি, যা অপরিশোধিত তেলের চেয়ে ব্যয়বহুল। এই জ্বালানি আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে।
চাহিদা-সরবরাহ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে জ্বালানি আমদানির দায়িত্বে থাকা সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এখনই সরবরাহ বিঘ্নিত হবে বলে মনে করছেন না তারা।
সেচ মৌসুমে দেশে ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়কালে ১৪.৯০ লাখ টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির চুক্তি রয়েছে বিপিসির।
ছয়টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান—পিটিটি থাইল্যান্ড, ইনক ইউএই, পেট্রোচায়না, বিএসপি ইন্দোনেশিয়া, পিটিসিএল মালয়েশিয়া এবং ইউনিপেক চায়না—সরকার-টু-সরকার (জি২জি) ভিত্তিতে জ্বালানি সরবরাহ করবে।
এবিএম আজাদ বলেন, তেলের দামের ওপর প্রভাব পড়বেই। এ প্রভাব এড়াতে পারবে না বাংলাদেশের মতো আমদানিকাররা।
বিপিসি চেয়ারম্যান বলেন, "বর্তমানে স্থানীয় বাজারে জ্বালানি বিক্রি করে আমাদের প্রতিদিন ১৫ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। তবে যুদ্ধের কারণে এই লোকসানের আকার বাড়বে।"
আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল পরিশোধিত জ্বালানির দাম ৯২ ডলারের উপরে চলে গেলেই বিপিসি লোকসানে পড়ে।
ব্লুমবার্গের ভোক্তা তথ্য অনুসারে, বুধবার ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১১১.২৬ ডলারে পৌঁছেছে।
বিপিসির সূত্র জানায়, ১ মার্চ তারা ব্যারেলপ্রতি ১১৫ ডলারে ডিজেল আমদানি করেছে।
লোকসান সমন্বয়ের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে এবিএম আজাদ বলেন, যেহেতু ২০২১ সালের নভেম্বরে সর্বশেষ মূল্যবৃদ্ধির পর তারা আর দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেননি, তাই তারা তাদের নিজস্ব সক্ষমতা দিয়ে ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করছেন।
দৈনিক সরবরাহ ছাড়াও দেশে জ্বালানি তেলের মোট ৩৫–৪০ দিনের মজুদ সক্ষমতা রয়েছে।