গ্যাস সংকট আরও তীব্র—উৎপাদন কমাতে বাধ্য হচ্ছে কারখানা, ঝুঁকছে ব্যয়বহুল বিকল্পে

দেশে গ্রীষ্মের শুরুতেই তাপমাত্রা যখন বাড়ছে— তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাস সরবরাহকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে দেশের প্রধান শিল্পাঞ্চলগুলোতে। নারায়ণগঞ্জ, ধামরাই, মানিকগঞ্জ, সাভার ও গাজীপুরে যেখানে বেশিরভাগ রপ্তানিমুখী কারখানা অবস্থিত— গ্যাসের চাপ কখনোবা শূন্যে নেমে আসছে। গ্যাস সংকটে তাদের উৎপাদন কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়ছে।
প্রায় ৪০০ গ্যাসনির্ভর কারখানা, প্রধানত বস্ত্র, সিরামিক ও স্টিল খাতে— এখন পূর্ণ ক্ষমতার অনেক নিচে চলছে। অনেক উদ্যোক্তাই জানান, ৭ থেকে ১৫ পিএসআইয়ের অনুমোদিত গ্যাস লোডের জন্য বিল দিয়েও ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন তাঁরা। অথচ গ্যাসের চাপ তখন অনুমোদিত লোডের চেয়েও অনেক কমই পাওয়া যাচ্ছে।
গাজীপুরের পোশাক কারখানা সাদমা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাসির উদ্দিন বলেন, "রাতের শিফটে কাজ করে, বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করেও আমরা ৪০ শতাংশ উৎপাদন সক্ষমতা রক্ষা করতে পারছি না।"
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি আরও জানান, "আগে যেখানে দৈনিক ৬০ টন সুতা তৈরি হতো, এখন তা নেমে এসেছে ১০ টনে।"
এই অবস্থায় কারখানা কার্যক্রম চালু রাখতে সাদমার মতো শিল্পকারখানাগুলো ডিজেল, এলপিজি ও সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস (সিএনজি) এর মতো বিকল্প জ্বালানিতে ঝুঁকছে। তবে এগুলো যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি ক্রমবর্ধমান জ্বালানির ঘাটতি মেটাতেও যথেষ্ট নয়।
গত দুই বছরে গ্যাসের দাম দুই দফায় বাড়ানোর পরেও দেখা যাচ্ছে গ্যাসের এই সংকট। প্রথমে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের আশ্বাস দিয়ে বাড়ানো হয় ১৭৯ শতাংশ, তারপর আবারো একই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০২৫ সালের চলতি এপ্রিল মাসে আরও ৩৩ শতাংশ বাড়ানো হয়।
তবে কারখানা মালিকরা বলছেন, সব আশ্বাস সত্ত্বেও গ্যাস সরবরাহ আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে, কোনো লক্ষণ নেই উন্নতির।
গাজীপুরের স্প্যারো অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএ'র সাবেক পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, "আমাদের আপত্তি সত্ত্বেও সরকার গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে, কিন্তু সরবরাহ তো পাচ্ছি না। কোনো কোনো দিন মাত্র দুই ঘণ্টার মতো গ্যাস থাকে। সোমবার থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।"
দেশের বিভিন্ন জেলার শিল্প উদ্যোক্তারাও একই অভিযোগ করছেন।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে অবস্থিত মিথেলা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মো. আজহার খান বলেন,"আমাদের অনুমোদিত গ্যাসের প্রেশার ১৫ পিএসআই, কিন্তু গত পাঁচ মাস ধরে তা প্রায় শূন্যের কোটায়। এই ধরনের বিপর্যয় কোনো শিল্প খাতের পক্ষেই সহনীয় নয়।"
শিল্প বিশেষজ্ঞদের মতে, শিল্পের যন্ত্রপাতি সচল রাখতে অন্তত ৭ পিএসআই চাপের গ্যাস প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে গ্যাসের চাপ ১ থেকে ২.৫ পিএসআইয়ের মধ্যে ওঠানামা করছে, যা একেবারেই অপর্যাপ্ত।
এই অবস্থায় বিকল্প জ্বালানির জন্য অনেক কারখানাই এখন সিএনজি কিনছে, এমনকী ধানের তুষ পুড়িয়েও বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।
আজহার খান বলেন, "আমরা যদি সরকার নির্ধারিত হারে গ্যাস পেতাম, তাহলে মাসিক জ্বালানি ব্যয় হতো প্রায় ৪ কোটি টাকা। কিন্তু এখন আমাদের খরচ হচ্ছে ৯ কোটি টাকা।"
সংকটের সময়টাও আরও দুঃসহ
এমন এক সময়ে এই গ্যাস–সংকট দেখা দিয়েছে, যখন বৈশ্বিক শিল্প খাত নানারূপী চ্যালেঞ্জের মুখে— যুক্তরাষ্ট্র-চীন শুল্কযুদ্ধ, ভোক্তা চাহিদা হ্রাস, মূল্যস্ফীতি ও সুদের হার বৃদ্ধির মতো চাপ একসঙ্গে সামলাতে হচ্ছে।
স্থানীয় উদ্যোক্তারাও বলছেন, এসব সংকট একত্রে অনেক ব্যবসাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে—ফলে ঋণ খেলাপি, কর্মী ছাঁটাই ও ভয়াবহ শিল্প মন্দার ঝুঁকি বাড়ছে।
নাসির উদ্দিন বলেন, "আমরা যতটুকু সামলাতে পারি, তারও সীমা আছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে অনেক কারখানাই হয় সাময়িকভাবে, নয়তো স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে।"
অসহনীয় লোকসানে জর্জরিত মালিকরা আশঙ্কা করছেন, আর্থিক চাপের মধ্যে ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করাও অসম্ভব হয়ে পড়বে।
জানা গেছে, গ্যাস–সংকট, বৈশ্বিক চাহিদার পতন ও উৎপাদন ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতির কারণে দেশের অন্তত ২০টি টেক্সটাইল মিল বিক্রির প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
নেই সমাধানের তাৎক্ষনিক কোনো সম্ভাবনা
দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পাঞ্চল— গাজীপুরের কারখানাগুলোর দৈনিক ৬০০ থেকে ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস (এমএমসিএফডি) প্রয়োজন হয়।
কিন্তু সরবরাহ সীমাবদ্ধ রয়েছে মাত্র ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুটে, জানিয়েছেন তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির উপ-মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী ফারুক। তিনি বলেন, "চাহিদা সরবরাহের চেয়ে অনেক বেশি হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই (গ্যাসের) প্রেশার কম থাকে।"
পেট্রোবাংলা'র তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের মোট গ্যাস চাহিদা ৩,৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট, অথচ সরবরাহ মাত্র ২,৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট।
পেট্রোবাংলার পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, "আগে বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ ছিল ১,০৫০ এমএমসিএফডি। শীতে চাহিদা কম থাকায় সরবরাহেরও প্রয়োজন কমে যায়। কিন্তু এখন গ্রীষ্মে চাহিদা বেড়েছে, অথচ সরবরাহ সেই আগের মতোই আছে—ফলে ঘাটতিটা প্রকট হয়েছে। এর ওপর চলমান ডলার সংকটের কারণে আমাদের গ্যাস আমদানির সামর্থ্যও সীমিত হয়ে পড়েছে।"
তিনি বলেন, "(গ্যাসের) স্থানীয় উৎপাদন না বাড়ানো পর্যন্ত এই সংকট সহজে কাটবে না।"
তবে তিনি কিছুটা আশার কথা জানিয়ে বলেন, এ মাসের শেষ নাগাদ দেশীয় উৎস থেকে ২৮ এমএমসিএফডি গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হতে পারে, এবং মে মাসে আরও কিছু পরিমাণ গ্যাস যোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সমাধানের খোঁজে টেক্সটাইল শিল্প
উৎপাদন খরচ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় সংকটে পড়েছে দেশের টেক্সটাইল শিল্প। উদ্যোক্তারা বলছেন, ২০২৩ সালের শুরুতে হঠাৎ করেই গ্যাসের দাম দ্বিগুণ হওয়া, এর পরপরই নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নের চাপ—এইসব মিলিয়ে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তাদের উৎপাদনের খরচ বেড়েছে বহুগুণ।
সে তুলনায় তাদের পণ্যের বিক্রয়মূল্য যথাযথ হারে না বাড়ায়—ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানান টেক্সটাইল মিল মালিকরা।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১,৮৫৪টি টেক্সটাইল কারখানা রয়েছে, যেখানে মোট বিনিয়োগ প্রায় ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে প্রায় ৯০০টি কারখানা গ্যাসনির্ভর।
টেক্সটাইল শিল্প স্থাপনে বিপুল বিনিয়গের প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে স্পিনিং মিলগুলোর ক্ষেত্রে— যেখানে মূলধনের পরিমাণ ১০০ কোটি টাকা থেকে শুরু করে ১,০০০ কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে। ফলে যেসব কারখনা মালিক বড় অংকের ব্যাংক ঋণ করেছনে, তারা এখন এই আর্থিক দায় নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
ইসরাক স্পিনিং মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল হক বলেন, "আমরা এখন প্রায় ৪০ শতাংশ সক্ষমতায় উৎপাদন চালাচ্ছি। অথচ দৈনিক ১৮০ টন সুতা উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে আমাদের কারখানায়।"
"এই মুহূর্তে আমি কোনোভাবে ব্যাংকের কিস্তি দিচ্ছি, কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে সেটি ধর রাখতেও পারব না" – তিনি সতর্ক করেন।
এনজেড টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালেউধ জমান খান জিতু বলেন, "ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন আর অন্যান্য খরচ কীভাবে ম্যানেজ করব, সেটা আমি কল্পনাও করতে পারছি না।"