ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে রক্ষা পেয়েছে অর্থনীতি

২০২৪ সালের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার যখন গঠিত হয়, তখন বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল খাদের কিনারে – বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল বিপজ্জনকভাবে কম, টাকার মান হারাচ্ছিল, মূল্যস্ফীতি গভীর রূপ নিয়েছিল, আর ব্যাংকখাত জর্জরিত হয়ে ধুকছিল খেলাপি ঋণ ও ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়মের ভারে।
তবে সরকারের এক বছর পার হতেই সামষ্টিক স্থিতিশীলতার কিছু আগাম লক্ষণ—যদিও এখনও পূর্ণ বিকশিত নয়—দেখা যাচ্ছে।
অর্থনীতির জন্য অস্বস্তিকর এক সংকেত— গত তিন বছর ধরে ৯ শতাংশের আশেপাশে থাকা মূল্যস্ফীতির প্রবণতা কিছুটা শিথিল হতে শুরু করে, এবং ধারাবাহিকভাবে গত তিন মাস ধরে তা কমছিল। তবে গেল মাস জুলাইয়ে হঠাৎ করে এই গতি উল্টো দিকে মোড় নেয়—যা আবার বাড়ার সংকেত দিয়ে মূল্য স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ কিছুটা জিইয়ে রেখেছে। এছাড়া, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বা ফরেক্স রিজার্ভ পুনর্গঠন হচ্ছে, মুদ্রার বিনিময় হারেও স্থিতিশীলতা ফিরেছে অনেক মাস ধরে তা অস্থিতিশীল থাকার পর।
আমদানিকারক, একসময় যাদের সপ্তাহের পর সপ্তাহ ডলার পাওয়ার অপেক্ষায় কাটাতে হতো, এখন সময়মতো আমদানি দায় নিষ্পত্তি করতে পারছেন। ব্যাংকখাত নিয়ে আতঙ্ক হ্রাস পেয়েছে, এবং শিল্পোৎপাদনও ধীরে ধীরে বাড়ছে।
অর্থাৎ, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সব লক্ষণই স্পষ্ট হচ্ছে, যদিও দীর্ঘদিনের কাঠামোগত ত্রুটিগুলো এখনো রয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশের দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকিং খাত পুনরুদ্ধারের কিছু ইঙ্গিত দিলেও, এখনও বেশকিছু ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। গত এক বছরে গৃহীত নিয়ন্ত্রক সংস্কারগুলো শাসনপ্রক্রিয়ায় কিছুটা স্বচ্ছতা ফিরিয়েছে ঠিকই, তবে এর পাশাপাশি আগে গোপন রাখা খেলাপি ঋণ প্রকাশ্যে আসায় তার পরিমাণও বাড়ছে।
ব্যাংকখাতের বাইরে, বিমা ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গভীর সংকট মোকাবিলায় এখনও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। কতিপয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হলেও, অধিকাংশই আগের সরকারের সময়, পরিচালকদের বড় আকারের অর্থ আত্মসাতের কারণে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
বেশকিছু জীবন বীমা কোম্পানি-ও দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু এতদিনেও গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষায় সরকার পক্ষ থেকে কোনো বাস্তবধর্মী সংস্কার বা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
গত এক বছর ধরেই দেশের পুঁজিবাজার রয়েছে বিতর্কের কেন্দ্রে, তবে সরকারের পক্ষ থেকে বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি।
গত এক বছরে জনপ্রশাসনেও বেড়েছে অস্থিরতা—চাকরিতে নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলির ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা ও অনিশ্চয়তা দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আগের সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা বহু শীর্ষ কর্মকর্তা এখনও আতঙ্কে থাকায়, প্রশাসনিক কার্যক্রমে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। এতে সরকারের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত ঘটছে। ফলে সময়মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
কর্মসংস্থানহীন পুনরুদ্ধার
গত এক বছরে দেশে বেকারত্ব কমেনি, বরং বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে দেশে বেকার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখ ৪০ হাজার জনে—যা মোট শ্রমশক্তির ৪.৬৩ শতাংশ। এক বছর আগেও এ হার ছিল ৩.৯৫ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি অনুপাতে বিনিয়োগের হার কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৯.৮ শতাংশে, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন।
বেসরকারিখাতের বিনিয়োগ এখনও মন্থর। এখাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের নিচে আটকে আছে, এবং মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানিও কম—যা উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থা ফিরে না আসার স্পষ্ট ইঙ্গিত।
ভোক্তাদের আস্থাও এখনও নাজুক। মূল্যস্ফীতি আগের তুলনায় কিছুটা কমলেও তা এখনও মজুরি বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি, ফলে প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে, সুদের হার এখনও বেশ উচ্চ, যার ফলে ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতা উভয়েই সতর্ক এবং দ্বিধান্বিত অবস্থানে রয়েছেন।

এডিপি বাস্তবায়নে রেকর্ড পতন
২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার নেমে এসেছে ৬৭.৮৫ শতাংশে, যা অন্তত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য অনুযায়ী, আগের অর্থবছরে এ হার ছিল ৮০ শতাংশেরও বেশি।
উল্লেখযোগ্য এই পতনের প্রেক্ষিতে বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের লাখো দরিদ্র মানুষের জন্য অস্থায়ী কর্মসংস্থানের অন্যতম উৎস— এই উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর ধীরগতির কারণে কর্মসংস্থানের সুযোগ হ্রাস পাওয়াকেই তুলে ধরছে।
গত মার্চে সংশোধিত এডিপি অনুমোদনের পর পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যেতে পারে।
সেসময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অনেক প্রকল্প পুনর্মূল্যায়ন করেছে, কিছু বাতিল করেছে এবং আগের সরকারের নেওয়া অনেক প্রকল্প পুনর্গঠন করেছে। শাসন পরিবর্তনের পর অনেক প্রকল্প পরিচালক ও ঠিকাদার চলে যাওয়ায়— প্রকল্প বাস্তবায়নে ধারাবাহিকতা বিঘ্নিত হয়েছে, যা এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের গতিও কমিয়ে দিয়েছে।
রাজস্ব ও আর্থিক সংস্কার: প্রতিশ্রুতি, প্রতিবন্ধকতা ও আংশিক অগ্রগতি
যদিও সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলোতে কিছুটা উন্নতির আভাস মিলেছে, তবে রাজস্ব ও আর্থিক খাতে সংস্কার কার্যক্রম এখনও অর্ধসমাপ্ত পর্যায়ে রয়ে গেছে।
গতকাল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, ১১টি কমিশনের কাছ থেকে পাওয়া ১২১টি সংস্কার প্রস্তাবনার মধ্যে সরকার ইতোমধ্যে ১৬টি বাস্তবায়ন করেছে, ৮৫টি প্রক্রিয়াধীন এবং ১০টি আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি ১০টি এখনও পর্যালোচনার অপেক্ষায়।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে কিছুটা যে উন্নতি দেখা গেছে, তা সরকারের উদ্যোগের চেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক বাজার ও বেসরকারি খাতের সহনশীলতার ফল।
টিবিএসকে তিনি বলেন, "যেখানে সংস্কারে সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল—বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে—সেখানে অগ্রগতি হয়েছে আংশিক, অন্যদিকে সম্ভাবনার অনেক জায়গা হাতছাড়া হয়েছে।"
শুরুর দিকে সরকারের সংস্কার উদ্যোগগুলো ব্যাহত হয়েছিল প্রশাসনিক রদবদল ও নীতির অস্থিরতায়। অপ্রদর্শিত খেলাপি ঋণ প্রকাশে হালনাগাদ রিপোর্টিং ব্যবস্থা এবং দুর্বল ব্যাংকগুলো পুনর্গঠনের চেষ্টা চললেও, ব্যাংক পুনরুদ্ধারের উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ চূড়ান্ত হয়নি।
"সরকার যদি অন্তত এক-দুইটি বড় সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক পুনর্গঠন করত, সেটিই হতো একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। সেই সুযোগ তারা হারিয়েছে," বলেন জাহিদ হোসেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন অবশ্য স্বীকার করেছেন যে, ব্যাংকখাতে দৃশ্যমান কিছু সংস্কার হয়েছে। দুর্বল ব্যাংকগুলো এডিট করতে ফরেনসিক অডিট এবং পাচার অর্থ উদ্ধারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। "তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তহবিল সহায়তা পাওয়ার পরও কয়েকটি অতি-দুর্বল ব্যাংক এখনও আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না," বলেন তিনি।
আগের সরকারের রেখে যাওয়া— ২০২৪–২৫ অর্থবছরের বাজেট, বড় ধরণের কোনো সংশোধন ছাড়াই বাস্তবায়ন করে অন্তর্বর্তী সরকার। এর পরবর্তী বাজেট অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের বাজেট আবার চাপে পড়ে ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ের বাণিজ্য উত্তেজনার কারণে, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের মুখেও পড়তে হয়।
চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন রেসিপ্রোকাল শুল্ক আরোপ করার পর, যেখানে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ট্যারিফ ও নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ারের কথা উল্লেখ করেছে দেশটি।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের ট্যারিফ ও নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার নিয়ে অতীতে অনেক বিশ্লেষণ ও সুপারিশ এসেছে। সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোও শুল্ক যৌক্তিকীকরণের সুপারিশ করেছে। কিন্তু বাজেটে তার কোন প্রতিফলন নেই। বরাবরের মতো এবারের বাজেটেও কিছু পণ্যের ট্যারিফ বাড়ানো ও কমানো হয়েছে, তাতে প্রোটেকশন রেট তেমন একটা কমেনি। এলডিসি গ্রাজুয়েশনের প্রস্তুতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্যও বাজেটে বেশ কিছু উদ্যোগ রাখার সুযোগ ছিল, যা সরকার মিস করেছে।
এরমধ্যে সরকারের একটি সাহসী পদক্ষেপ ছিল, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) রাজস্ব নীতি এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা– এ দুটি বিভাগে বিভক্ত করার অধ্যাদেশ জারি, কর্মকর্তাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও সেটি পাস হলেও— এর বাস্তবায়ন থমকে রয়েছে।
নতুন বাজেটে সরকার কালো টাকা সাদা করার বিধান কঠোর করে কিছুটা বহাল রাখলেও— পরবর্তীতে সমালোচনার মুখে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে।
প্রবৃদ্ধির মূল্য দিয়ে স্থিতিশীলতা!
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ বলেন, "সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য অনেকটাই উন্নত হয়েছে।" বিশেষ করে মুদ্রাবিনিময় হারের নমনীয় নীতির ফলে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোয় লেনদেনের ভারসাম্য (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) স্থিতিশীল হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার ক্ষেত্রে সরকার কঠোর রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ভূমিকা রেখেছে। সরকার ব্যাংকখাত থেকে ঋণও কম নিচ্ছে।
তবে সাদিক আহমেদ সতর্ক করে বলেছেন, "সংস্কার অগ্রগতির চিত্রটা এখনো অসম।" তার মতে, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন সম্ভব হলেও, সেটি প্রবৃদ্ধির মূল্য দিয়ে হয়েছে, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে গেছে ৪ শতাংশের নিচে।
"এই সামঞ্জস্য প্রক্রিয়ায় আমদানি ও বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ সংকুচিত হয়েছে, যার ফলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম মন্থর হয়েছে। এটি ভালো কোনও ট্রেড-অফ নয়," বলেন তিনি।
রাজস্ব, দুর্নীতি ও নীতিগত পক্ষাঘাত
আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায় বাংলাদেশের কর সংস্কার কার্যক্রম এখনও কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি। দেশের কর-জিডিপি অনুপাত এখনও আঞ্চলিকভাবে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়ে গেছে। অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এর জন্য দায়ী করেছেন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি এবং করব্যবস্থায় অটোমেশনের অভাবকে।
তিনি বলেন, "সরকারের নীতি-নির্ধারকদের মুখ থেকে শোনা যায় যে, এনবিআরের কর্মকর্তা ও করদাতারা এক ধরণের চুক্তি করে নিজেদের মধ্যে অর্থ লেনদেন করেন। সে কারণে সরকার ট্যাক্স পাচ্ছে না। কর্মকর্তাদের সঙ্গে করদাতাদের এই চুক্তির রাস্তা বন্ধ করতে হলে—করদাতার সঙ্গে কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎ বন্ধ করা জরুরি। সেজন্য অনলাইন ও অটোমেশন প্রয়োজন।"
"একইসঙ্গে আমাদের বিভিন্ন খাতের উপর বিভিন্ন রকমের কর, শুল্ক ও ভ্যাট রেট হয়েছে। বাজেটে আশা ছিল যে, এসব রেটের মধ্যে গ্যাপ কমে আসবে। কিন্তু প্রত্যাশার উল্টো দিকে গিয়ে এবার কাস্টমস ও সম্পূরক শুল্কের ক্ষেত্রে আরেকটি করে স্ল্যাব তৈরি করা হয়েছে।"
৮ আগস্ট সরকার গঠনের সময় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ছিল সরকারের এক নম্বর অগ্রাধিকার, যা এখন 'স্লিপ' কেটেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমলেও এখনও সরকারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমানো সরকারের প্রাইরোটি লিস্ট থেকে নিচে নেমে গেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার কিনেছে, যা মূল্যস্ফীতি কমাতে গৃহীত সংকোচনমুলক মুদ্রানীতির বিপরীত।
বাজারে ডলারের চাহিদা কমতে থাকায় গত জুলাই থেকে টাকা কিছুটা শক্তিশালী হচ্ছিল, টাকার মান বাড়লে মূল্যস্ফীতি কমে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার কেনার কারণে বিনিময় হার যেটুকু কমেছিল, তা আবার বেড়ে গেছে। অথচ বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ার অন্যতম কারণ হলো গত কয়েক বছরে টাকার বড় ধরনের দরপতন।
"আবার বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার কিনেছে টাকা দিয়ে। অর্থাৎ, সংকোচনমুলক মুদ্রানীতি ঘোষণার পরও মূল্যস্ফীতি বাড়বে জেনেও ডলার কিনে বাজারে বাড়তি টাকা সরবরাহ করার ঘটনা ঘটছে। তাই মূল্যস্ফীতি কমানোর চেয়ে এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ বাড়াতে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে," জানান ড. জাহিদ হোসেন।
কাঠামোগত সংস্কারের উদ্যোগ থেকে সরে এসেছে?
ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংকখাতের বাইরে অর্থনীতিতে যেসব সংস্কার জরুরি ছিল, সরকার একবছরে সেখানে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। উচ্চ পর্যায়ের একটি টাস্কফোর্স কমপক্ষে ১৭টি খাত নিয়ে বিভিন্ন সংস্কার সুপারিশ করেছিল, যার মধ্যে অনেকগুলো শুধু পলিসি পরিবর্তন করেই করা যেতো, সরকার সেগুলোও করেনি।
তিনি বলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি কমেনি। সঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। ফলে বিনিয়োগ করতে শংকিত ব্যবসায়ীরা। তাই কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে না। অথচ কর্মসংস্থান বা চাকরির জন্যই গতবছর জুলাইতে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। তাই সরকারের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিকে।
গত এক বছরে প্রকৃত মজুরি কমে গেছে, যা এখনও কমতির দিকেই রয়েছে। কর্মসংস্থানও বাড়েনি। ফলে গত এক বছরে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় কোন ইতিবাচক পরিবর্তন আসেনি। বরং নিম্ন আয় ও সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা আরও কষ্টকর হয়েছে বলে জানান ফাহমিদা খাতুন।
ড. ফাহমিদা যে টাস্কফোর্সের কথা বলেন, সেটি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অর্থনীতিবিদ কে এ এস মুর্শিদ।
কে এ এস মুরশিদের নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সুপারিশে পরিকল্পনা কমিশন সংস্কার, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় একীভূতকরণ, ইন্টারনেটের উপর থেকে শুল্ক ও সারচার্জ প্রত্যাহার, রাজস্ব বোর্ড তদারকির জন্য নতুন প্রতিষ্ঠান গঠন এবং সরকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিলুপ্ত করার সুপারিশ করা হয়।
প্রতিবেদনে পরিকল্পনা কমিশন সংস্কারের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারসহ ৭ দফা সুপারিশ করা হয়। সীমিত শিক্ষা বাজেট এবং আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে ভালো অবস্থান নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় একীভূতকরণের ওপর জোর দেয় টাস্কফোর্স।
এছাড়া, বৈষম্যহীন টেকসই অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণের লক্ষ্যে ইন্টারনেটের উপর ধার্য করা ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং ২ শতাংশ সারচার্জ অবিলম্বে প্রত্যাহার, সরকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিলুপ্ত করা করা, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য যোগ্য ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ করা এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার সুপারিশ করে টাস্কফোর্স।
সামনেই এলডিসি থেকে উত্তরণ, তবে কোনো কৌশলের দেখা মিলছে না
ফাহমিদা খাতুন বলেন, আগামী বছর বাংলাদেশের এলডিসি গ্রাজুয়েশন হবে। কিন্তু আমাদের শুল্কনীতি পর্যালোচনা করাসহ এজন্য গুরুত্বপূর্ণ যেসব প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন, গত বছরে সে ধরণের কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, "কোনো শুল্ক কৌশল নেই, বাণিজ্য চুক্তির প্রস্তুতি নেই। আর এমনিতেই এটি ইন্টেরিম সরকার, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা চান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। তাই নতুন বিনিয়োগের জন্য সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের প্রয়োজন।"