প্রেমিকার চেয়েও পরিবেশকে বেশি ভালোবাসেন লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও!

বাংলাদেশের গণমাধ্যমে আজ বারবারই ঘুরেফিরে আসছে হলিউড তারকা লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওর নাম। নিজের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তিনি। তবে চলচ্চিত্র সংক্রান্ত কোনো বিষয় নিয়ে নয়। একদমই ভিন্ন এক কারণে।
জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষায় বাংলাদেশের একমাত্র সামুদ্রিক প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের ১ হাজার ৭৪৩ বর্গ কিলোমিটার (৬৭২ বর্গ মাইল) এলাকাকে 'মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া' (এমপিএ) বা নতুন সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। এটিই কারণ ডিক্যাপ্রিওর বাংলাদেশকে অভিবাদন জানানোর।
চলচ্চিত্রের ঝলমলে দুনিয়ার বাইরে ডিক্যাপ্রিওর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে যারা জানেন না, তাদের কাছে ব্যাপারটি বিস্ময়কর মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে তিনি একজন বিশিষ্ট জলবায়ু কর্মী ও পরিবেশবাদী। এমনকি ২০১৬ সালে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর 'দ্য রেভেন্যান্ট' চলচ্চিত্রের জন্য 'সেরা অভিনেতা'-র পুরস্কার পাওয়ার পর অস্কারের মঞ্চে দাঁড়িয়েও তিনি কথা বলেছিলেন জলবায়ু পরিবর্তন প্রসঙ্গে।
সেদিন তিনি বলেন, "জলবায়ু পরিবর্তন একটি বাস্তব ঘটনা। এটি সত্যিই এখন ঘটছে। মানবজাতি ও পৃথিবীর জন্য এটাই এখন সবচেয়ে বড় হুমকি এবং এটা থামাতে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, আর আলসেমি করা ঠিক হবে না। বিশ্বজুড়ে সেসব নেতাকে আমাদের সমর্থন দিতে হবে, যারা বড় বড় দূষণকারীর অথবা বড় বড় করপোরেশনের পক্ষে নন, বরং মানবতার পক্ষে কথা বলছেন।
"বিশ্বের আদিবাসী মানুষের জন্য, কোটি কোটি সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য আমাদের কথা বলতে হবে, যারা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আমাদের সন্তানদের সন্তানের জন্য, তাদের জন্য আমাদের কথা বলতে হবে। লোভের রাজনীতির কারণে যাদের প্রতিবাদ ডুবে গেছে, তাদের জন্য।"
অস্কারের মঞ্চে ডিক্যাপ্রিও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এসব কথার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ভূয়সী প্রশংসা কামান। তিনি যে আর দশজন চিত্রতারকার মতো প্রকৃতি ও পৃথিবী সম্পর্কে উন্নাসিক নন, তা-ও প্রমাণিত হয়ে যায়। ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের মতো অনেকে তাকে আখ্যা দেয় বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ 'ক্লাইমেট চেঞ্জ চ্যাম্পিয়ন' হিসেবেও।

কিন্তু এ কথা বলাই বাহুল্য যে হুট করে একদিন ঘুম থেকে উঠে পরিবেশের প্রতি সচেতন হয়ে ওঠেননি ডিক্যাপ্রিও। বরাবরই এ ব্যাপারে দারুণ সিরিয়াস ছিলেন তিনি। পরিবেশবাদী আন্দোলনে পাড়ি দিয়েছেন লম্বা পথ।
সেই ছোটবেলা থেকেই পরিবেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা জন্মায় লিওর। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারেই তিনি জানিয়েছেন যে একদম শিশু অবস্থায় প্রাকৃতিক পৃথিবীর প্রতি তার মোহের সূচনা ঘটে। তাই তিনি চেয়েছিলেন হয় একজন অভিনেতা হবেন, নয়ত একজন মেরিন বায়োলজিস্ট। নিজেকে একজন 'খুদে বায়োলজিস্ট' বলেও মনে করতেন তিনি। আর তার দেখা প্রথম ছবিগুলোর একটা বড় অংশজুড়ে ছিল রেইনফরেস্ট ও বিভিন্ন প্রজাতির ধ্বংস হওয়া বা বিলুপ্তি বিষয়ক ডকুমেন্টারি।
২০১৬ সালে তিনি নিজেই 'বিফোর দ্য ফ্লাড' নামের একটি ডকুমেন্টারি সহ-প্রযোজনা ও ন্যারেট করেন। সেখানে পরিবেশ সচেতনতা বিষয়ে তার একদম প্রথম দিককার একটি স্মৃতি উঠে আসে। তার ক্রিবের (শিশুদের বিছানা) ঠিক উপরেই নাকি ঝুলত পনের শতকের ডাচ শিল্পী হায়ারোনিমাস বশের বিখ্যাত তৈলচিত্র 'দ্য গার্ডেন অব আর্থলি ডিলাইটস'। সেই ছবিটি প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে ছোট্ট লিওর মনে গভীর ছাপ ফেলে।
ছবিটির প্রথম প্যানেলে দেখা যায় ঈশ্বর গার্ডেন অব ইডেনে ইভকে উপহার দিচ্ছেন অ্যাডামের কাছে। আর তাদেরকে ঘিরে রেখেছে বিভিন্ন পশু-প্রাণী। দ্বিতীয় প্যানেলে দেখা যায় বিপুল সংখ্যক মানুষ পাপাচার ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তির কর্মকাণ্ডে মেতে রয়েছে। তবে ডকুমেন্টারিতে ডিক্যাপ্রিও এভাবে ব্যাখ্যা করেন যে, এই প্যানেলটি জনসংখ্যার আধিক্যও তুলে ধরে।

ন্যারেটর লিওর মতে, তৃতীয় ছবিটিতে দেখা যায় একটি "বিকৃত, ক্ষয়প্রাপ্ত, পুড়ে যাওয়া প্রকৃতির ছবি। এমন এক স্বর্গের ছবি, যার অবনমন ঘটতে ঘটতে ধ্বংসের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে।"
অন্যভাবে বলতে গেলে, ছবিটিকে তিনি এভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন যে নরক এসে প্রাকৃতিক জগতের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। স্পষ্টতই, ডিক্যাপ্রিও বশের এই ছবির অর্থের সঙ্গে বর্তমান বিশ্বের জলবায়ু সংকটকেও একই সূত্রে গেঁথেছেন। আর তাই তো একদমই বিস্ময়কর নয় যে ছোটবেলা থেকে এমন দর্শন নিয়ে বেড়ে ওঠা লিও এক পর্যায়ে নিজেই নেমে পড়বে জলবায়ু রক্ষার সংগ্রামে।
১৯৯৮ সালের কথা। আগের বছরই মুক্তি পেয়েছে ডিক্যাপ্রিওর বিশ্বকাঁপানো চলচ্চিত্র 'টাইটানিক'। জ্যাক বলে এক নামে তাকে চেনে সবাই। স্টারডমের চূড়ান্ত যাকে বলা চলে, সেটিই তখন উপভোগ করছেন তিনি। কিন্তু এমন সময়েও তিনি ভুলে যাননি পরিবেশের প্রতি নিজের অমোঘ প্রেমের কথা।
লিও তখন কী করলেন, জানেন? সোজা হোয়াইট হাউজে গিয়ে দেখা করলেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ভাইস-প্রেসিডেন্ট আল গোরের সঙ্গে। ভাইস-প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিনি আলাপ জমালেন জলবায়ু পরিবর্তন প্রসঙ্গে। এবং তার নিজের ভাষ্যমতে, এটি ছিল একজন জলবায়ু কর্মী হিসেবে তার বিবর্তনের অন্যতম প্রধান মাইলফলক।
তবে ওখানেই থেমে না থেকে, ওই বছরই পঁচিশেরও কম বয়সী ডিক্যাপ্রিও প্রতিষ্ঠা করেন 'লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও ফাউন্ডেশন'। এই পৃথিবীর সকল বাসিন্দার দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিয়ে কাজ করছে সংস্থাটি। ২০১৯ সাল পর্যন্ত অলাভজনক এ সংস্থাটি পরিবেশ সংরক্ষণ, জলবায়ু সংরক্ষণের ব্যাপারে জনসচেতনতা তৈরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ১০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয় করেছে। বিশ্বের পাঁচটি মহাসাগর ও সাতটি মহাদেশেই পরিবেশবাদী কাজের জন্য অর্থ অনুদান দিয়েছে এ ফাউন্ডেশন।
নিজের ফাউন্ডেশন নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি ডিক্যাপ্রিও নিজের নাম জড়িয়েছেন অন্যান্য খ্যাতনামা পরিবেশবাদী সংস্থার সঙ্গেও। বর্তমানে তিনি ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফাউন্ডেশনের একজন বোর্ড মেম্বার। বহুদিন ধরেই তার টুইটারের বায়োতে রয়েছে তিনটি শব্দ : "অভিনেতা ও পরিবেশবাদী।"
আজ থেকে ২৪ বছর আগে পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে সিরিয়াসলি কাজ করা শুরু করেছিলেন ডিক্যাপ্রিও। মাঝের এই দুই যুগে তার জনপ্রিয়তায় এতটুকুও ভাটা পড়েনি, বরং ক্রমশ নিজেকে তিনি নিয়ে গেছেন এক নতুন উচ্চতায়। নিজেকে এমন একজন ব্যক্তিত্ব পরিণত করেছেন, যিনি কোনো বিষয়ে মুখ খুললে গোটা বিশ্ব নড়েচড়ে বসতে বাধ্য।
২০১৬ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের এক্সপ্লোরার-ইন-রেসিডেন্স এনরিক সালা বলেন,
"সমুদ্রের ব্যাপারে আগ্রহী বহু ফাউন্ডেশন ও বেসরকারি সংস্থাই রয়েছে। তারা দারুণ কাজও করছে। তবে লিওর একটি মেগাফোন রয়েছে যেটি এ পৃথিবীতে আর কারোই নেই। তাকে সবাই প্রচণ্ড ভালোবাসে, সম্মান করে, এবং বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপ্রধানরা পর্যন্ত সবার কাছেই তিনি সমান প্রভাবশালী। তাই যখন তিনি কিছু বলেন, লোকে মন দিয়ে শোনে।"
গণমাধ্যমে তাকে বৈশ্বিক পরিবেশ বিষয়ক আয়োজনগুলোর 'নিয়মিত মুখ'-ও বলা হয়েছে। ২০১৬ সালে যখন বিশ্বনেতারা প্যারিস জলবায়ু চুক্তি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছিলেন, সেখানেও ছিল ডিক্যাপ্রিও সরব উপস্থিতি। তাকে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব বান কি মুনের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলতেও দেখা যায়।

অবশ্য এরও দুই বছর আগে ডিক্যাপ্রিও জলবায়ু সংরক্ষণের ব্যাপারে জাতিসংঘে ভাষণ দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন,
"একজন অভিনেতা হিসেবে আমি জীবিকা নির্বাহের জন্য ভান করে থাকি। প্রায়ই আমি কাল্পনিক চরিত্র হিসেবে কাল্পনিক সব সমস্যার সমাধান করি। আমি বিশ্বাস করি জলবায়ু পরিবর্তনের দিকেও মানবজাতি সেভাবেই তাকাচ্ছে। ব্যাপারটা এমন যেন এটি একটি ফিকশন, যা অন্য কারো গ্রহে ঘটছে। ব্যাপারটা এমন যেন জলবায়ু পরিবর্তন বাস্তবতা নয় ভাবলেই এটি চলে যাবে।"
কিন্তু ডিক্যাপ্রিও তেমন নন। তিনি পরিবেশ ও জলবায়ু সংরক্ষণের আদর্শকে মনেপ্রাণে ধারণ করেন, সবসময় এ ব্যাপারে সচেষ্ট থাকেন। তাই তো তিনি জলবায়ুর কথা ভেবে সপ্তাহে মাত্র দুই একদিন গোসল করেন, সুগন্ধীও ব্যবহার করেন না।
এসব ব্যাপারে তিনি এতটাই কট্টরপন্থী যে, পরিবেশের প্রতি প্রেমের কাছে হার মানছে তার রোমান্টিক সম্পর্কগুলোও। যেমন ২০১৩ সালে খবর রটেছিল, ডিক্যাপ্রিওর ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ঘাটতি নিয়ে যারপরনাই হতাশ তার তৎকালীন প্রেমিকা এরিন হেথারটন।
ডিক্যাপ্রিওর একটি বিশ্বস্ত সূত্র তখন জানায়, "লিও পরিবেশের প্রতি তার ভালোবাসাকে তার বাদবাকি দুনিয়ার চেয়ে এগিয়ে রেখেছে, আর তাতে ডুবতে বসেছে তার লাভ লাইফ। তিনি সপ্তাহে হাতেগোনা দুই-একদিন গোসল করেন পানি সংরক্ষণের জন্য, এবং ডিওডোর্যান্টকে মনে করেন অপ্রাকৃতিক। এরিন তাকে গভীরভাবে ভালোবাসেন, কিন্তু এমনটা মনে করতে শুরু করেছেন যে লিও তারচেয়ে পরিবেশকে বেশি ভালোবাসেন।"
তাহলে বুঝতে পারছেন তো, কেন লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওকে বলা হয় জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যাম্পিয়ন!