গাজীপুরে ১৫ হাজার টাকায় ‘আয়নাবাজি’: প্রকৃত আসামি বাইরে, জেলে বদলি খাটছেন যুবক
গাজীপুর জেলা কারাগারে 'আয়নাবাজি' সিনেমার মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে। বন বিভাগের মামলায় ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে প্রকৃত আসামির বদলে 'প্রক্সি' দিতে গিয়ে এখন কারাবাস করছেন এক যুবক। প্রকৃত আসামি দিব্যি বাইরে ঘুরে বেড়ালেও তার নাম ও পরিচয় ব্যবহার করে কারাগারে দিন কাটাচ্ছেন প্রতিবেশী ওই যুবক।
চাঞ্চল্যকর এই জালিয়াতির ঘটনা জানাজানি হলে তোলপাড় শুরু হয়। বিষয়টি আড়াল না করে আদালতকে অবহিত করতে তড়িঘড়ি করে চিঠি দিয়েছে গাজীপুর জেলা কারাগার কর্তৃপক্ষ। কারা কর্তৃপক্ষের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে আরও উদ্বেগজনক তথ্য—গত এক মাসে কারাগারে এমন তিনটি প্রক্সি হাজিরার ঘটনা শনাক্ত করেছে প্রশাসন।
ঘটনার আড়ালে যারা
অনুসন্ধানে জানা যায়, বন মামলার প্রকৃত আসামির নাম মো. সাত্তার মিয়া (৪৫)। তিনি গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার মোথাজুরী তালচালা গ্রামের আলফাজ উদ্দিনের ছেলে। অন্যদিকে টাকার বিনিময়ে নিজের নাম গোপন করে সাত্তার সেজে যিনি জেল খাটছেন, তার নাম সাইফুল ইসলাম (৩০)। তিনিও একই গ্রামের বাসিন্দা রহিম বাদশার ছেলে।
সাইফুলের বাবা রহিম বাদশা ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, তার ছেলে পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। তিনি জানতেন ছেলে কর্মস্থলেই আছেন। পরে জানতে পারেন, মাত্র ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে সাত্তার সেজে আদালতে হাজিরা দিয়ে এখন কারাগারে আছেন সাইফুল। ছেলের এমন কর্মকাণ্ডে অনুতপ্ত পরিবার।
মামলার পটভূমি ও নাটকীয়তা
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত ৯ সেপ্টেম্বর কালিয়াকৈর উপজেলার ফুলবাড়িয়া রেঞ্জের কাচিঘাটা বিট এলাকায় সরকারি গাছ কাটার সময় বন কর্মকর্তারা কয়েকজনকে হাতেনাতে আটক করেন। এ সময় দেশীয় অস্ত্রের মুখে বন কর্মকর্তারা পিছু হটতে বাধ্য হন। পরে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করে বন বিভাগ।
কাচিঘাটা বিট অফিসার শরিফ খান বলেন, 'স্থানীয়দের অস্ত্রের মুখে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। তাই আলামত জব্দ করে ফিরে এসে মামলা দায়ের করি।'
এই ঘটনার প্রায় তিন মাস পর, গত ৭ ডিসেম্বর বন মামলার প্রধান আসামি হিসেবে সাত্তার মিয়া গাজীপুর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। বিচারক অভিযোগ আমলে নিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায়, পুলিশ যাকে কারাগারে পাঠিয়েছে তিনি সাত্তার নন, তার প্রতিবেশী সাইফুল।
প্রকৃত আসামি যেখানে
আদালতের নথিপত্র অনুযায়ী আসামি সাত্তার মিয়ার বর্তমানে গাজীপুর জেলা কারাগারে থাকার কথা। কিন্তু সরেজমিনে ও মুঠোফোনে যোগাযোগ করে জানা যায়, তিনি নিজ এলাকায় স্বাভাবিকভাবেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করছেন।
মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে সাত্তার মিয়া জানান, তিনি ব্যবসায়িক কাজে বর্তমানে মাওনা এলাকায় অবস্থান করছেন। অথচ কাগজ-কলমে তিনি এখন কারাবন্দী।
কারা কর্তৃপক্ষের ভাষ্য ও পদক্ষেপ
কীভাবে এমন জালিয়াতি সম্ভব হলো—এমন প্রশ্নের জবাবে গাজীপুর জেলা কারাগারের জেল সুপার মোহাম্মদ রফিকুল কাদের বলেন, 'গত ৭ ডিসেম্বর আসামি এন্ট্রি করার সময় তিনি নিজের নাম সাত্তার বলেন। আদালতের কাগজপত্রেও একই নাম থাকায় তখন কোনো সন্দেহ হয়নি। পরবর্তীতে বিষয়টি জানার পর নিশ্চিত হতে আসামির বায়োমেট্রিক পরীক্ষা করা হয়। তখনই বেরিয়ে আসে, কারাগারে যিনি আছেন তিনি মো. সাত্তার মিয়া নন, সাইফুল ইসলাম।'
জেল সুপার আরও জানান, বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর গত ৮ ডিসেম্বর কারা মহাপরিদর্শক ও গাজীপুর বিজ্ঞ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-২-এর বিচারককে চিঠি দিয়ে অবহিত করা হয়েছে।
প্রশ্নবিদ্ধ আইনি প্রক্রিয়া
এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনায় আইনজীবীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রকৃত আসামি সাত্তারের আইনজীবী শ্যামল সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
গাজীপুর জেলা প্রশাসনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'আদালতে হাজিরার সময় সাধারণত জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) জমা দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট আইনজীবী কীভাবে একজন ভুল ব্যক্তিকে পরিচয় গোপন করে আদালতে হাজির করলেন, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এমনকি কারাগারে নেওয়ার সময়েও এনআইডি যাচাইয়ের সুযোগ ছিল। এতসব ধাপ পেরিয়ে একজন নির্দোষ ব্যক্তির কারাগারে যাওয়া দুঃখজনক।'
আগামীকাল বুধবার এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষ থেকে বিষয়টি অনুসন্ধান করা হবে বলে জানা গেছে।
