মামদানি! যেন এক অলৌকিক স্টাফ রিপোর্টার!
আগামীকাল নিউ ইয়র্কে হতে যাচ্ছে মেয়র নির্বাচন। জানা যাচ্ছে অগ্রিম ভোটে মামদানি এখনও এগিয়ে। কেন তিনি এগিয়ে? কেন সাধারণ মানুষ তাঁকে পছন্দের আসনে বসিয়েছেন? কেন আমেরিকার কর্পোরেট মহাজন, দুর্নীতিবাজ আমলারা তাঁকে পছন্দ করছেন না; আর কেনই বা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা তাঁকে কমিউনিস্ট বলে চিহ্নিত করছেন? কারণ কী?
আমি মনে করি ৭টি কারণে মামদানি নিউ ইয়র্ক শহরের মেয়র হওয়ার যোগ্য।
১) রাজনীতির প্রতি এখন সবাই কমবেশি বীতশ্রদ্ধ। রাজনীতিবিদদের মানুষ এখন আর আগের মতো বিশ্বাস করেন না। আর নীতি–নৈতিকতার দিক থেকে এই রাজনীতিবীদদের ঠিক আগের সেই সুনামও নেই। আমি নিজে কখনো কোনো মেয়র নির্বাচনে ভোট দেইনি। এই প্রথম। কারণ মেয়র নির্বাচন নিয়ে আমার কখনো কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু এবার মাথাব্যথার কারণ ছিল মামদানি। তাকে মেয়র হিসেবে আমাদের পেতে হবে।
কেন এই ইচ্ছা? মামদানি গতানুগতিক রাজনীতিকদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষায় কথা বলছেন। তিনি নিউ ইয়র্কের হতদরিদ্র মানুষের ভাষাটা যেন ঠিক বুঝতে পারছেন। তাদের দুঃখ, হতাশা, স্বপ্ন, স্ট্রাগল, জীবনযুদ্ধ- এসব তিনি বুকে ধারণ করতে পেরেছেন।
মেয়র হওয়ার পর তিনি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেসব কতটুকু পালন করতে পারবেন সেটা পরের কথা। কিন্তু এই যে কর্পোরেট উঁচু ছাদ থেকে নিচে বসে থাকা সাধারণ মানুষের কাতারে এসে দাাঁড়ানো, এই কাজ রাজনীতিবিদরা ভুলেই গেছেন। ভোটের আগে তারা অনেক বড় বড় কথা বলেন তারপর সব ভুলে যান। কিন্তু মামদানি কর্পোরেট দুর্নীতি নিয়ে এমন কিছু কথা বলছেন যে কারণে তিনি অনেকের মাথাব্যাথার কারণ হয়েছেন।
সে কারণে অনেকের চোখেই তিনি এখন কমিউনিস্ট। কারণ তিনি মানুষের কথা বলছেন। তিনি মানুষের অধিকারের কথা বলছেন। মানুষের অধিকারের কথা বলা মানেই তিনি কমিউনিস্টট! আমেরিকার ক্যাপিটালিস্টরা এই দীক্ষা নিয়ে সেই ছেলেবেলা থেকেই বেড়ে ওঠে।
২) নিউ ইয়র্ক শহর বড়লোক পয়সাওলাদের শহর। এই শহরে দরিদ্রদের স্বপ্ন দেখা মানেই বিলাসিতা। মামদানি এই দরিদ্র সাধারণ মানুষদের চোখে স্বপ্ন দেখাতে পেরেছেন। দেখুন, এখানে বাসা ভাড়া আকাশচুম্বি। বাঙালি বাড়িওয়ালাদের দিকে তাকিয়ে দেখুন! (সবাইকে এক কাতারে আমি দেখছি না মোটেও, ব্যতিক্রম আছেন)। এখানে বেশিরভাগ বাড়ির মালিক একেকজন শায়লক, রক্তচোষা বণিক! এদের না আছে কোনো পেশাদারিত্ব, আর না আছে কোনো ভদ্র ব্যবহার। কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে এরা যখন তখন ভাড়া বাড়ায়। তারা মনে করেন এটি তাদের অধিকার!!
মামদানি এসবের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান শক্ত করেছেন। বাড়ি ভাড়া ফ্রিজ করার কথা ঘোষণা দিয়েছেন। এজন্য নিউ ইয়র্কের বাড়ির মালিকদের চক্ষুশূল হয়েছেন তিনি। হায় মানুষ!
৩) লক্ষ্য করবেন মামদানির ভাষা অন্যান্য গতানুগতিক রাজনীতিবিদদের চেয়ে আলাদা। তিনি জেন-জিদের মনের কথায় কথা বলেন। তিনি তরুণ প্রজন্মদের আত্মায় লুকিয়ে থাকা অব্যক্ত ক্ষোভ ও প্রতিবাদকে বুঝতে পারেন। সনাতন পচে যাওয়া ধ্যান ধারণাকে ভাঙতে চান। তিনি গরীবদের রক্তচোষার জন্যে তৈরি করা সুক্ষ্ম দেয়ালটাকে ভাঙতে চান। সঙ্গে নিতে চান তরুণ সাহসী কিছু যোদ্ধা।
জানি মাফিয়াদেরে এই শহরে তাঁর এই এজেন্ডা সফল করা অনেক কঠিন। কিন্তু তিনি এই যে সিস্টেমে নাড়া দিয়েছেন। এটিই আমেরিকার রাজনীতিতে নতুন আরেকটি মোড় নিতে বাধ্য হবে।
৪) তিনি সাহসী। এমন সাহসী মেয়রপ্রার্থী আমি এই আমেরিকার জীবনে দেখিনি। তিনি ঘোষণা দিচ্ছেন ইসরায়েল প্যালেস্টাইনে যুদ্ধের নামে যে নিধন চালাচ্ছে, সেটি আদতে গণহত্যা। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে তিনি যদি মেয়র হন, তাহলে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নিউ ইয়র্কে এলে তাকে গ্রেপ্তার করবেন।
আবার তিনি ঘোষণা দিচ্ছেন নিউ ইয়র্কের সব ধর্মের মানুষ সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করবেন। কোনো হিংসাত্মক কার্যক্রম তিনি বরদাস্ত করবেন না। তিনি বলছেন মানবতার কথা, ধর্ম পালনে স্বাধীনতার কথা। নিউ ইয়র্কের একাংশ ইহুদিরাও মামদানিকে সমর্থন দিচ্ছে। তাকে কখনো দেখা যাচ্ছে চার্চে, কখনো তিনি মন্দিরে, কখনো মসজিদে, সিনাগগে।
৫) মামাদানি আধুনিক যুগের মানুষ। তাঁর ভাষায় আধুনিকতার ছাপ আছে। বয়স মাত্র ৩৪। দেখতেও সুদর্শন। অনেক ভদ্রভাবে তিনি কথা বলেন। তাঁর বাবা-মা দু'জনই খুব সুশিক্ষিত। মা মিরা নায়ার। তাঁর সিনেমার সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। তাঁর অনেক আগে নির্মিত 'মিসিসিপি মসালা', যেখানে ডেনজেল ওয়াশিংটন অভিনয় করেছিলেন, নামের সিনেমাটির কথা আমার এখনও মনে আছে। কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি আমাদের সেই মানসিক ঘৃণাবোধ এখনও আছে।
মিরা নায়ারের আরেকটি বিখ্যাত সিনেমা 'মনসুন ওয়েডিং'। আমাদের নারীদের ওপর পুরুষদের নির্যাতন যে পারিবারিকভাবেই শুরু হয় সিনেমাটি সেই কথাই বলে। তাঁর দুটো সিনেমার আবেদনই টাইমলেস। সবসময়ের জন্যে প্রযোজ্য। মামদানির বাবা একজন শিক্ষক। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান।
৬) মামদানির আরেকটি সাফল্যের কারণ হলো সোশ্যাল মিডিয়া। তিনি সফলভাবে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, টিকটক ব্যবহার করেছেন। কারণ তিনি এই যুগের মন-মানসিকতাকে ধারণ করে বেড়ে ওঠা মানুষ।
৭) মামদানিকে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, 'আপনার পছন্দের খাবার কী?' তাঁর উত্তর 'স্ট্রিট ফুড। বিশেষ করে জায়রো।' না, কথাটা তিনি শুধু ভোটের জন্যই যে বলেছেন তা নয়। এটিই তাঁর প্রিয় খাবার। তিনি নিউ ইয়র্ক ট্যাক্সি ড্রাইভারদের অধিকারের জন্যে সবসময়ই রাস্তায় প্রতিবাদ করেছেন।
রাস্তার দুই পাশের দোকান-পাটের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ট্যাক্সি ড্রাইভার, ঝাড়ুদার, ফল বিক্রেতা, উকিল, ডাক্তার, সাংবাদিক, অধ্যাপক, মুচি, ফেরিওয়ালা সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসার জন্যেই তাঁর রাজনীতি। বিভিন্ন সময়ে তিনি নিজেও এই অন্তজ শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে কাজ করেছেন। এই যে তিনি মিশতে পারছেন এই গুণটি সবাই রপ্ত করতে পারেন না।
মানুষকে ভালোবাসা এত সহজ যেমন নয়, তেমনি মানুষের ভালোবাসা পাওয়াও এত সহজ নয়। মামদানি সেই ভালোবাসা অর্জন করতে পেরেছেন।
আগামীকাল মেয়র নির্বাচন। আপনি অবশ্যই আপনার ভোটটি দেবেন। আপনার বিবেক, বুদ্ধি ও জ্ঞানকে আমি কখনো চ্যালেঞ্জ করব না। আমি শুধু আমার কথাগুলো বললাম।
লেখক: নিউইর্য়কবাসী, কথাসাহিত্যিক
