সব আলোচনাই ব্যর্থ, আন্তর্জাতিক সালিশে আদানির মুখোমুখি হতে চলেছে বিপিডিবি
ভারতের আদানি পাওয়ার লিমিটেডের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) ও কয়লার মূল্য নির্ধারণ ফর্মুলা নিয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) টানাপোড়েনের জেরে—কয়েক দফা ব্যর্থ আলোচনা শেষে, বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক সালিশের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে।
উভয়পক্ষের বিরোধের মূল বিষয় ২০১৭ সালে স্বাক্ষরিত ২৫ বছরের বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ), যার আওতায় ভারতের ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় অবস্থিত আদানি পাওয়ারের ১,৬০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।
বিপিডিবির অভিযোগ— চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বিদ্যুৎমূল্য আমদানি করা কয়লার দামের সঙ্গে সংযুক্ত থাকায়—তা অস্বাভাবিকভাবে বেশি পড়ছে। আবার বিল পরিশোধে বিলম্বের জরিমানাও অত্যধিক, এবং আদানি পাওয়ারের ভারতে পাওয়া কর মওকুফের সুবিধা বাংলাদেশের বেলায় প্রযোজ্য করা হয়নি।
বিদ্যুৎ বিভাগের সূত্রগুলোর মতে, এই মামলা যাবে সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারে (এসআইএসি)। সেখানে যাওয়ার আগের ধাপ হিসেবে ইতোমধ্যে আদানি তাদের মধ্যস্থতাকারী মনোনীত করেছে এবং বিপিডিবিকেও নিজস্ব মধ্যস্থতাকারী নিয়োগের আহ্বান জানিয়েছে।
সালিশ প্রক্রিয়া শুরু করার আগে এসআইএসি–এর নিয়ম অনুযায়ী উভয় পক্ষ নিজেদের মধ্যস্থতাকারী নিয়োগের পর— আদানি ও বিপিডিবির মধ্যেকার বিরোধ নিরসনে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় একটি 'ডিসপিউট বোর্ড' গঠিত হবে। এই মধ্যস্থতা পর্যায়ের আলোচনাগুলো বাধ্যতামূলক নয়; কিন্তু যদি তাতে সমাধান না আসে, তখন পূর্ণাঙ্গ আইনি লড়াই শুরু হবে।
সূত্রগুলো জানায়, সিইও পর্যায়ের বৈঠকে আদানি পক্ষ বিপিডিবির উদ্বেগের কোনো সমাধান দেয়নি এবং সরাসরি জানিয়ে দেয় যে, তারা পিপিএ নিয়ে কোনোরকম পুনঃআলোচনা করবে না।
বিপিডিবি চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম টিবিএস-কে বলেন, "গত কয়েক মাসে আমরা আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বেশ কয়েকবার বৈঠকে বসেছি, কিন্তু আমাদের উদ্বেগের জায়গাগুলোর বিষয়ে আদানি কোনো বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়নি। আদানির পক্ষ থেকে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগের বিষয়টি ইঙ্গিত দেয় যে, তারা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে না গিয়ে বরং আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে।"
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান টিবিএস-কে বলেন, "জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় আইনি লড়াইয়ের জন্য আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। এই খাত-সংশ্লিষ্ট খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক আইনজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।"
অর্থ পরিশোধের পর আদানি বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) এবং কয়লার মূল্য নির্ধারণ পুনর্বিবেচনা করবে— এমন আশ্বাসের ভিত্তিতে গত জুনে আদানির বকেয়া ৪৩৭ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করে বিপিডিবি। এর কয়েক মাস পরে আসে আন্তর্জাতিক সালিশের এই হুমকি।
আদানির দাবি, তাদের মোট বকেয়া প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার, যা বিপিডিবির মতে বাস্তবে যা হওয়ার কথা তার তুলনায় অনেক বেশি।
এমতাবস্থায় দুই পক্ষের সর্বশেষ বৈঠকটি হয় ২৩ জুন, যা অনুষ্ঠিত হয় ভার্চুয়াল মাধ্যমে। বৈঠকে নেতৃত্ব দেন আদানি পাওয়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেরসিং বি খাইলিয়া এবং বিপিডিবির কোম্পানি বিষয়ক সচিব এ এন এম ওবায়দুল্লাহ। উভয় পক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
বিরোধের জায়গাগুলো আদানি আলোচনার মাধ্যমে নাকি আইনি প্রক্রিয়ায় সমাধান করবে—এ বিষয়ে জানতে টিবিএস বাংলাদেশে আদানির কান্ট্রি হেড ইউসুফ শাহরিয়ারকে তিনবার ফোন করে। তাকে একটি টেক্সট মেসেজও পাঠানো হয়েছে। তবে গতকাল পর্যন্ত তার কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ভর করবে রিভিউ রিপোর্টের ওপর
সরকার বিদ্যুৎ বিভাগের অধীনে একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করেছে, যা বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির (পিপিএ) আইনগত যৌক্তিকতা এবং পুনঃআলোচনার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের সূত্র অনুযায়ী, এই কমিটি বিপিডিবিকে আইনি প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে এবং ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক আইনজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়েছে।
তবে কর্মকর্তারা জানান, পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিপিডিবি এখনো রিভিউ কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করছে। বিপিডিবির চেয়ারম্যান বলেন, "আমরা উচ্চপর্যায়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করছি। এখন আমরা ফাইনাল রিভিউ রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি।" বিপিডিবি এখনো তার মধ্যস্ততাকারী নিয়োগ দেয়নি বলেও জানান তিনি।
এদিকে গতকাল উপদেষ্টা ফাওজুল কবিরের কাছে কমিটি তাদের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। পরে এক ব্রিফিংয়ে কমিটির প্রধান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, চূড়ান্ত প্রতিবেদন জানুয়ারিতে জমা দেওয়া হবে।
আদানি পাওয়ারের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে কমিটির সদস্য মুশতাক আহমেদ বলেন, এই চুক্তিতে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে ইতোমধ্যেই আদালতে একটি রিট পিটিশন দায়ের করা হয়েছে। আদালত একটি রিপোর্ট চেয়েছেন, এবং আমরা আশা করছি এক মাসের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ পাওয়া যাবে। এই প্রমাণ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক—উভয় পর্যায়ে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের পথ খুলে দেবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
এসআইএসি-এর সালিশ প্রক্রিয়া
আদানি ও বিপিডিবির মধ্যকার বিরোধ এখন সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টার (এসআইএসি)–এর সালিশি প্রক্রিয়া অনুযায়ী এগোবে।
আন্তর্জাতিক সালিশ প্রক্রিয়া অনুযায়ী, উভয় পক্ষকেই তৃতীয় কোনো দেশের নিরপেক্ষ একজন মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ দিতে হবে। যদি মধ্যস্থতায় সমাধান না আসে, তাহলে বিষয়টি পূর্ণাঙ্গ সালিশ প্রক্রিয়ায় গড়াবে, যা শুরু হবে নোটিস অব আরবিট্রেশন জারি করার মাধ্যমে।
এরপর একটি নিরপেক্ষ সালিশ ট্রাইব্যুনাল প্রমাণ পরীক্ষা করবে এবং শুনানি পরিচালনা করবে—এই প্রক্রিয়া কয়েক মাস বা এমনকি কয়েক বছরও চলতে পারে। ট্রাইব্যুনালের চূড়ান্ত রায়, নিউইয়র্ক কনভেনশন (১৯৫৯ সাল থেকে কার্যকর) অনুযায়ী বৈশ্বিকভাবে বাধ্যতামূলক ও কার্যকর হবে।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম বলেন, আন্তর্জাতিক সালিশে বাংলাদেশের পূর্ব অভিজ্ঞতা খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়; বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা হেরেছি, যার মূল কারণ ছিল আরবিট্রর নিয়োগে ভুল সিদ্ধান্ত।
তিনি বলেন, "আমরা অনেক সময় যোগ্যতার চেয়ে স্বজনপ্রীতির ভিত্তিতে লোক নিয়োগ দিই। তাদের অনেকেই দেশের স্বার্থ রক্ষায় যথেষ্ট দক্ষ নন।"
তিনি গুরুত্ব দিয়ে বলেন, আরবিট্রর নিয়োগের সময় সরকারকে অত্যন্ত সতর্ক ও বিচক্ষণ হতে হবে—বিশেষ করে প্রার্থীদের অতীত অভিজ্ঞতা ও মামলায় জয়ের রেকর্ড খতিয়ে দেখতে হবে।
আহসানুল করিম পরামর্শ দেন, দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে না গিয়ে বাংলাদেশের উচিত হবে প্রথমে আদালতের বাইরে সমঝোতার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা।
বিরোধের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ ২০১৭ সালে আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) স্বাক্ষর করে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে, যা উভয় দেশের আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ সহযোগিতা কাঠামোর অধীনে করা হয়। এই চুক্তির ক্ষেত্রে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র প্রক্রিয়াও এড়িয়ে যায় গত আওয়ামী সরকার।
গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে বাংলাদেশে প্রায় ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। সেই সময় থেকে বিদ্যুতের দাম, কয়লা সংগ্রহের উৎস, দেরীতে অর্থ পরিশোধের জরিমানা এবং কর সুবিধাসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে বিরোধ তৈরি হয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী, আদানির বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ করা হয় ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা কয়লার সূচক অনুযায়ী। এছাড়া, এত দূর থেকে কয়লা পরিবহনের খরচও এতে অন্তর্ভুক্ত থাকে।
বিপিডিবি কর্মকর্তা ও স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞদের মতে, দুটি সূচকের উপর ভিত্তি করে গড় দামের কারণে গোড্ডা প্ল্যান্টের বিদ্যুৎ দেশের একই ধরনের দুটি তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র যেমন পায়রা বা রামপালের উৎপাদনের তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে গেছে।
টিবিএসের দেখা সরকারের এক অভ্যন্তরীণ হিসাবে দেখা যায়, গোড্ডা প্ল্যান্টের বিদ্যুতের গড় দাম প্রতি ইউনিটে ১৪.৮৭ টাকা, যেখানে পায়রা প্ল্যান্টে এক ইউনিট বিদ্যুতের দাম ১১.৮৩ টাকা। বিদ্যুৎ বিভাগ এটিকে অর্থনৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য বলে জরুরিভিত্তিতে সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছে।
আদানির সঙ্গে করা পিপিএ'তে আরও বলা আছে— বিল পরিশোধে বিলম্ব হলেই প্রতি মাসে ২ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে, যা বছরে প্রায় ২৭ শতাংশে দাঁড়ায়। বিপিডিবি একে অত্যধিক ও আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে অসঙ্গত বলে উল্লেখ করেছে।
পরবর্তীতে ভারতের পক্ষ থেকে আদানি প্ল্যান্টকে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়, যার মাধ্যমে যথেষ্ট পরিমাণ কর ও শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়। বিপিডিবি কর্মকর্তা এবং বিশেষজ্ঞরা যুক্তি দেখিয়েছেন, বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের বেলায় এই সুবিধাগুলো বাংলাদেশেরও পাওয়া উচিত ছিল।
কিন্তু আদানি ভারত সরকারের একটি দলিল দেখিয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে— ২০২১ সালের মধ্যে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু না হওয়ায় কর ছাড় বাতিল করা হয়েছে।
এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি মূলত বাংলাদেশের জন্য রপ্তানির উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হলেও - গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগের পতনের পর, ভারত সরকার নীতি পরিবর্তন করে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে স্থানীয় বাজারে বিদ্যুৎ বিক্রির বিকল্প সুযোগও দিয়েছে।
