একজন পপ তারকা, অন্যজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী: কেন কেটি পেরি ও জাস্টিন ট্রুডোর জুটি সফল হতে পারে?
এমন এক জুটির কথা খুব কম মানুষই কল্পনা করেছিল: একদিকে কানাডার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, আর অন্যদিকে এক আমেরিকান পপ তারকা, যিনি সারা বিশ্ব ঘুরেছেন, এমনকি মহাকাশের দ্বারপ্রান্ত থেকেও ঘুরে এসেছেন।
কিন্তু জাস্টিন ট্রুডো এবং কেটি পেরি তাদের সম্পর্ককে খুব সম্প্রতি প্রকাশ্যে আনলেন। গত সপ্তাহান্তে প্যারিসের বিখ্যাত 'ক্রেজি হর্স' ক্যাবারে থেকে হাত ধরাধরি করে বের হতে দেখা গেছে এই জুটিকে, যেখানে তারা পেরির ৪১তম জন্মদিন উদযাপন করছিলেন।
প্রথম দৃষ্টিতে তাদের এক অদ্ভুত জুটি মনে হলেও, ট্রুডো এবং পেরি—উভয়েই যারা গত এক দশকের বেশি সময় ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে—তাদের মধ্যে মিলের পরিমাণ ধারণার চেয়েও বেশি। আর কানাডার রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন ঘটনা যে একেবারেই নতুন, তা-ও নয়।
এই সম্পর্কটি তাদের দুজনকেই নিজ নিজ ভাবমূর্তি নিয়ে যে নেতিবাচক আলোচনা চলছিল, তার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির যোগাযোগ বিদ্যার অধ্যাপক হোসে রদ্রিগেজ বলেন, 'এটি দুজনের জন্যই এক নতুন ব্র্যান্ডিং, যা বেশ আকর্ষণীয় এবং অপ্রত্যাশিত।'
তিনি আরও যোগ করেন, একজন রাষ্ট্রনায়কের সাথে সম্পর্ক পেরির জন্য রাজনীতি ও সমাজসেবামূলক কাজে প্রবেশের একটি নির্ভরযোগ্য সেতু তৈরি করে দিচ্ছে। এর মাধ্যমে তিনি সঙ্গীত জগতের বাইরেও এক নতুন দর্শক এবং বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সংস্থার কাছে পৌঁছাতে পারবেন।
অন্যদিকে, ৫৩ বছর বয়সী ট্রুডোর জন্য 'ক্যালিফোর্নিয়া গার্লস' খ্যাত এই গায়িকা তার নতুন ভাবমূর্তি তৈরিতে সাহায্য করছেন, কারণ তিনি রাজনীতির কঠিন জগতের বাইরে এক 'নরম বলয়ের' মানুষ।
তবে এর মূলে রয়েছে একটি সাধারণ মানবিক সংযোগও। দুজনেই সম্প্রতি একা হয়েছেন—ট্রুডো এবং তার স্ত্রী ২০২৩ সালে আলাদা হয়ে যান—এবং বিচ্ছেদের পর দুজনের জন্যই এটি প্রথম কোনো আলোচিত প্রেমের সম্পর্ক।
আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া
তাদের প্রেমের গুঞ্জন শুরু হয়েছিল জুলাইয়ের শেষের দিকে, যখন মন্ট্রিয়লের একটি অভিজাত রেস্তোরাঁয় তাদের একসাথে ডিনার করতে দেখা যায়। এর দুই দিন পরেই, ট্রুডোকে শহরের একটি কনসার্টে পেরির সাথে গলা মিলিয়ে 'ফায়ারওয়ার্ক' এবং 'টিনেজ ড্রিম' গাইতে দেখা যায়।
এরপর অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে, ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলে পেরির ইয়টে তাদের চুম্বনের ছবি ভাইরাল হয়ে যায়।
ট্রুডো বা পেরি কেউই প্রকাশ্যে তাদের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেননি। তবে গত মাসে লন্ডনের একটি কনসার্টে এক ভক্ত পেরিকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তিনি হাসতে হাসতে জবাব দেন, 'তোমার আসলে ৪৮ ঘণ্টা আগে আমাকে এই প্রস্তাবটা দেওয়া উচিত ছিল।'
ভাবমূর্তির সংকট ও নতুন অধ্যায়
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই সম্পর্কটি দুজনেরই ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিকে নতুন করে গড়তে সাহায্য করছে।
২০১৫ সালে কানাডার সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়ে জাস্টিন ট্রুডো বিশ্বজুড়ে এক প্রগতিশীল আইকনে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু জনপ্রিয়তায় ধস নামার পর এ বছরের শুরুতে তাকে পদত্যাগ করতে হয়। বিলাসবহুল ছুটি কাটানো এবং পুরনো বর্ণবাদী ছবি প্রকাশের মতো কেলেঙ্কারি তার 'সোনালী দিনের' ভাবমূর্তিতে কালিমা লেপন করে। একসময় কানাডার মানুষ তার নেতৃত্বে হতাশ হয়ে পরিবর্তন চাইছিল।
একইভাবে, কেটি পেরিও কয়েক বছর খ্যাতির চূড়ায় থাকার পর বেশ কিছু নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হয়েছেন।
২০১০-এর দশকে পপ সঙ্গীতের শিখরে ছিলেন তিনি। কিন্তু তার সর্বশেষ অ্যালবাম '১৪৩' সমালোচকদের মতে ছিল তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে দুর্বল কাজ। এরপর জেফ বেজোসের স্ত্রী এবং অন্যান্য সেলিব্রেটিদের সাথে ব্লু অরিজিনের মহাকাশ ভ্রমণে অংশ নিয়েও তিনি সমালোচিত হন। ব্যক্তিগত জীবনেও কৌতুক অভিনেতা রাসেল ব্র্যান্ডের সাথে বিচ্ছেদের পর অরল্যান্ডো ব্লুমের সাথে তার সম্পর্ক ভেঙে যায়।
লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসের পপ সঙ্গীত সমালোচক মাইকেল উড বলেন, 'যখন আপনি একটি খারাপ গল্পের মধ্যে থাকেন, তখন সবচেয়ে ভালো উপায় হলো নতুন একটি গল্প শুরু করা।' ট্রুডোর সাথে এই সম্পর্ক 'একটি ফ্লপ অ্যালবাম এবং লক্ষ্যভ্রষ্ট ট্যুরের আলোচনা থেকে আমাদের মনোযোগ অন্য দিকে সরিয়ে দিচ্ছে।'
স্বর্গীয় জুটি?
এই জুটির মধ্যে বেশ কিছু মিলও রয়েছে। দুজনেই ভাবাদর্শের দিক থেকে অনেকটা এক। পেরি নিজেও রাজনীতি ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে বেশ সক্রিয়। তিনি ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনের পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলেন এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনে কমলা হ্যারিসকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেছেন।
তিনি এলজিবিটিকিউ অধিকারের একজন সোচ্চার সমর্থক এবং বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠনের সাথে যুক্ত—যে বিষয়গুলোকে ট্রুডোও সবসময় সমর্থন করে এসেছেন।
এছাড়াও, দুজনেই তাদের সন্তানদের প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল বাবা-মা। পেরির ইনস্টাগ্রামে তার চার বছরের মেয়ে ডেইজির ছবি প্রায়ই দেখা যায়। অন্যদিকে, ট্রুডোও গ্রীষ্মের ছুটিতে তার তিন সন্তানকে নিয়ে আলাদাভাবে সময় কাটিয়েছেন।
ইতিহাস কি ফিরে আসে?
পেরির সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে, ট্রুডো রাজনীতি ছাড়ার পর এক ভিন্ন পথ বেছে নিচ্ছেন, যা তার পূর্বসূরিদের থেকে আলাদা। সাধারণত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীরা বড় বড় পরামর্শক সংস্থায় যোগ দেন।
কিন্তু এই পদক্ষেপটি সেই প্রধানমন্ত্রীর জন্যই স্বাভাবিক, যিনি সবসময়ই একটু অন্যরকম ছিলেন। আরেক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পিয়ের এলিয়ট ট্রুডোর ছেলে হিসেবে তিনি ছোটবেলা থেকেই প্রচারের আলোয় বড় হয়েছেন।
স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদের পর, ছোট ট্রুডোকে তার বাবার সাথে অনিবার্য তুলনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তার বাবাও প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন স্ত্রী মার্গারেটের সাথে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। সিনিয়র ট্রুডোরও আমেরিকান গায়িকা বারবারা স্ট্রাইস্যান্ড এবং অভিনেত্রী কিম ক্যাটরেলের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিদের সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল।
কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক জোনাথন ম্যালয় বলেন, 'কোনো সন্দেহ নেই যে, ইতিহাস যেন নিজেকে পুনরাবৃত্তি করছে।'
তবে অধ্যাপক মালভে উল্লেখ করেন, অনেকেই তার এই নতুন জীবনের সাথে নিজেদের মেলাতে পারছেন। রাজনীতি ছাড়ার পরপরই ট্রুডো রান্নাঘরের জিনিসপত্র কেনার একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন, যা দেখে অনেকেই মন্তব্য করেন যে তার 'ডিভোর্সের পর বাবার নতুন জীবন' শুরু হয়েছে।
'হয়তো অনেকেই আশা করছেন যে, তিনি বিচ্ছেদের ধাক্কা সামলে উঠে নিজের জীবন নিয়ে এগিয়ে যাবেন,' বলেন অধ্যাপক মালভে।
