শালবনে ফিরছে প্রাণ: মধুপুরে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সরকারের পদক্ষেপ
শীত পেরিয়ে বনে নেমেছে বসন্ত। ফাগুনের রঙে জঙ্গল এখন এক অপূর্ব সাজে সেজেছে। পাতাঝড়া গাছে এসেছে নতুন কুঁড়ি, যা জঙ্গলে ফিরিয়ে দিচ্ছে যৌবনের ছোঁয়া। কোকিলের পঞ্চম স্বরে মুখরিত প্রকৃতি, মাঝেমধ্যে কালবৈশাখীর বৃষ্টি প্রকৃতিকে আরও সজীব করে তোলে। বুনো পাখিদের কলকাকলি ও সুরের মূর্ছনায় হঠাৎ ডেকে ওঠে এই বনের বনসুন্দরী—যে পাখিটিকে বাংলার শালবনের বৈশিষ্ট্যসূচক বলে ধরা হয়।
তবে সময়ের সঙ্গে এই বনের হাসি ফিকে হয়ে গেছে, হারিয়েছে জৌলুস। এক সময়ের জীবন্ত শালবন আজ ক্রমে শূন্য হয়ে পড়েছে তার স্বকীয় বন্যপ্রাণী থেকে। মানুষ যে কীভাবে আগ্রাসী হয়ে বন ধ্বংস করতে পারে, তার একটি বড় নিদর্শন এই শালবন। আর এই মৃতপ্রায় বনে আবারও প্রাণ ফেরাতে উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশের প্রধান বৃক্ষ শাল (Shorea robusta) দ্বারা গঠিত বনাঞ্চল স্থানীয়ভাবে শালবন নামে পরিচিত। এটি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ট্রপিক্যাল ময়েস্ট ডিসিডুয়াস (আর্দ্র স্বচ্ছ পাতি) বনভূমি, যা প্রাকৃতিক ও সামাজিক-অর্থনৈতিক উভয় দিক থেকেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শালবন প্রধানত মধ্য ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিস্তৃত; গাজীপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী ও নওগাঁ জেলায় এর বিস্তীর্ণ এলাকা রয়েছে। এর মধ্যে মধুপুর ট্র্যাক্ট ও ভাওয়াল অঞ্চল গঠন করেছে সবচেয়ে বড় সংলগ্ন বনভূমি, যা প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার হেক্টরজুড়ে বিস্তৃত।
শালের পাশাপাশি এ বনে স্বাভাবিকভাবে জন্মায় গর্জন, তেলসুর, মহুয়া, হরগোজা, ছাতিম, শিমুল, জাম, আম, আমড়া, হিজল, কড়ই, বট, অশ্বত্থ ও ডুমুর। কিন্তু বিদেশি আগ্রাসী প্রজাতির—যেমন আকাশমনি ও ইউক্যালিপটাস রোপণের ফলে শালবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
একসময়, শত বছর আগে, শালবন ছিল মধ্য ও উত্তর-মধ্যাঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত এক বিশাল সবুজ বেল্ট—চার থেকে পাঁচ লক্ষ হেক্টর জুড়ে। আজ তা টুকরো টুকরো আকারে টিকে আছে। এই শালবন একসময়ে ছিল অসংখ্য বন্যপ্রাণীর আশ্রয়স্থল; যাদের অধিকাংশই এখন বিলুপ্তির তালিকায়, আর বাকি প্রাণীরা বিলুপ্তির প্রহর গুনছে।
কারা হারিয়ে গেল শালবন থেকে
বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন শালবন মধুপুর গড় একসময় ছিল বন্য হাতির অবাধ বিচরণের এলাকা। কিন্তু আজ সেখানে হাতি সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে জমিদাররা হাতি শিকার ও বশীভূত করার উদ্দেশ্যে 'কেঁদ্দা' পদ্ধতিতে ব্যাপক হারে হাতি ধরতে থাকে। এর ফলে ১৮৭৮ থেকে ১৮৮০ সালের মধ্যে শুধু মধুপুর–ঢাকা পাহাড়ি অঞ্চলে প্রায় ৯১৬টি হাতি বন্দি করা হয়। ১৮৬৮ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে মোট ১,৫০০-রও বেশি হাতি ধরা পড়ে।
অতিরিক্ত শিকার, বন উজাড়, কৃষিজমি সম্প্রসারণ ও আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে মধুপুর বনে হাতির সংখ্যা দ্রুত কমে যায়। ২০শ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে সেখানে আর স্থায়ীভাবে বন্য হাতি দেখা যায়নি। বর্তমানে দেশের বন্য হাতির সংখ্যা আনুমানিক ২৬০–৩০০টির মধ্যে সীমাবদ্ধ, এবং তারা প্রধানত দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম পার্বত্য জেলায় সীমিত। ফলে মধুপুর গড় এখন শুধু হাতির অতীত ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করছে।
এই পরিসংখ্যানই বলে দেয়—একসময় শালবন কতটা জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ ছিল। হাজার হাজার বছর ধরে এ বন ছিল জীববৈচিত্র্যের অন্যতম আশ্রয়স্থল। বনজ সম্পদ ও প্রাণীকুল এতটাই সমৃদ্ধ ছিল যে, একে একসময় দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক ভান্ডার বলা হতো। প্রাচীন ও মধ্যযুগে এই বন ছিল হাতি, বাঘ, চিতা, বন্য মহিষ, ময়ূর, চিত্রা হরিণ, বুনো শূকর, বিভিন্ন সরীসৃপ ও অসংখ্য পাখির বিচরণের কেন্দ্র।
স্থানীয় আদিবাসী গারো, কোচ, বানাইসহ অন্যান্য সম্প্রদায় শিকার ও সংগ্রহজীবনের মাধ্যমে সীমিতভাবে বনের প্রাণী ব্যবহার করলেও তাতে বন ও প্রাণীর মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকত। কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে সেই ভারসাম্য ভেঙে যায়। ১৮ শতকের শেষভাগ থেকে ১৯ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত জমিদার ও শিকারি শ্রেণি বিনোদনের জন্য নির্বিচারে শিকার চালায়। হাতি, বাঘ, ময়ূর ও হরিণের নিধন চলতে থাকে। সেই সময়ই ব্রিটিশ সরকার 'কেঁদ্দা' পদ্ধতিতে বন্য হাতি ধরার অনুমোদন দেয়—যেখানে পোষা হাতির সাহায্যে বন্য হাতিকে খাঁচায় আটকে বন্দি করা হতো।
২০শ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে মধুপুর গড়ে স্থায়ীভাবে আর কোনো বন্য হাতির পাল দেখা যায়নি। অতিরিক্ত শিকার ও বন উজাড়ের কারণে একই সঙ্গে বিলুপ্ত হয়েছে বাঘ, চিতা, বন্য মহিষ ও ময়ূরও। তবে ১৯শ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত এসব প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল—যার প্রমাণ মেলে ভ্রমণ বিবরণ ও স্থানীয় কাহিনিতে।
পাকিস্তান আমলে (১৯৪৭–১৯৭১) বনভূমি আরও সংকুচিত হয়। কৃষি সম্প্রসারণের জন্য আনারস, কলা, পেঁপেসহ নানা বাগান গড়ে ওঠে, ফলে শালবনের বিশাল অংশ হারিয়ে যায়। খাদ্য উৎস ও আবাসস্থল নষ্ট হয়ে পড়ে, যার ফলে বাঘ, হাতি, মহিষ ও বড় স্তন্যপায়ীরা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়। মাঝারি স্তন্যপায়ী যেমন বনবিড়াল, শিয়াল, মেছোবাঘ, সজারু ও বাঁদর কিছুটা টিকে ছিল।
স্বাধীনতার পর (১৯৭১–১৯৮০ দশক) বন উজাড় ও দখল আরও বাড়ে; শিকারও অব্যাহত থাকে, ফলে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা আরও কমে যায়। ১৯৮২ সালে সরকার মধুপুর গড় ও ভাওয়াল বনকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু বাস্তবে সুরক্ষার কার্যকর ব্যবস্থা তখনও নিশ্চিত হয়নি।
১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকে পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৬২ সালে এই বনাঞ্চলের সবুজ আচ্ছাদন ছিল অনেক বিস্তৃত, কিন্তু ২০০৩ সালের মধ্যে তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গিয়ে সীমিত অঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে বড় প্রাণীর টিকে থাকার পরিবেশ একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়।
মূলত প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস, কৃষি সম্প্রসারণ এবং বনভূমির স্বাভাবিক অবস্থার অবক্ষয়ের কারণেই শালবনের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে পড়েছে। আর এই ধ্বংসযজ্ঞের শেষ আঘাত এসেছে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি গাছের বিস্তৃত রোপণের মাধ্যমে—যা এক সময়ের প্রাণবন্ত শালবনকে আজ প্রায় নিস্তব্ধ করে তুলেছে।
শালবনের নিচু ও মধ্যবর্তী এলাকাগুলোকে 'বাইন' বলা হয়। এই বাইনে সাধারণত ঘাসবন ও অগভীর জলাভূমি থাকে—যা ছিল অসংখ্য বিপন্ন প্রাণীর খাবার সংগ্রহস্থল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এখন আর এসব প্রাকৃতিক বাইন শালবনে টিকে নেই; যা ছিল, সবই আজ ধানক্ষেতে পরিণত হয়েছে।
ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে ভারতের আসামের কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যানের কথা মনে করা যেতে পারে—যেখানে জলাভূমি, বাইন, বন ও নদী মিলিয়ে এক অনন্য প্রতিবেশ গড়ে উঠেছে। একসময় বাংলাদেশের মধুপুর গড়েও ছিল তারই এক জীবন্ত প্রতিরূপ। আজ সেই জটিল ও সজীব প্রতিবেশ কেবল খণ্ডিত কিছু বনে সীমাবদ্ধ।
একসময় এই বাইদ ও আশপাশের জলাভূমিতে দেখা যেত কালো তিতির, ধূসর তিতির, ডাহর, পাতি ডাহর, কেয়া, খাগ, গগনবের, হাড়গিলা, সারস, ময়ূর ও গোলাপি-মাথা হাঁসের মতো নানা পাখি। আজ এরা শুধু শালবন নয়, বাংলাদেশের আকাশ থেকেও হারিয়ে গেছে। এছাড়া দাগীপেট পেঁচা, রাজ শকুন, বাংলা শকুন ও সরুঠোঁট শকুন এখন কেবল পাহাড়ি বন বা সুন্দরবনে অল্পসংখ্যক টিকে আছে।
ধূসর নেকড়ে, দাগী হায়না, নীলগাই, কৃষ্ণসার ও ভালুকও এই শালবনের পাশাপাশি পুরো দেশ থেকেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যদিও হাতি, বাঘ, চিতা, ছোট ও বড় ভালুক এখনো দেশের কিছু পাহাড়ি ও বনাঞ্চলে পাওয়া যায়।
একসময়ে যে মধুপুর গড় হাতির গর্জন ও বাঘের পদচারণায় মুখর থাকত, যেখানে ময়ূরের ডাক আর বন্য মহিষের দৌড়ে প্রতিধ্বনিত হতো বন, আজ তা মূলত মুখপোড়া হনুমান, শিয়াল, মেছোবিড়াল, বনবিড়াল, বাঁদর এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখিতে সীমাবদ্ধ। এখন এই বন কেবলই অতীতের ঐশ্বর্যময় জীববৈচিত্র্যের সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে—যেখানে প্রকৃতির গৌরবময় ইতিহাস মানুষের দখল, আগ্রাসন ও অব্যবস্থাপনার কারণে ধ্বংসের পথে গিয়েছে।
ফলে মধুপুর গড়ের বন্যপ্রাণীর ইতিহাস মূলত এক দীর্ঘ 'সমৃদ্ধি থেকে বিলুপ্তির কাহিনি'—যা আমাদের জন্য এক সতর্কবার্তা এবং একই সঙ্গে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জরুরি আহ্বান।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান শালবন পুনরুদ্ধারে নিয়েছেন কয়েকটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। তার নেতৃত্বে মধুপুরসহ দেশের অবক্ষয়িত শালবনের সীমানা নির্ধারণ ও দখলমুক্ত করার কাজ শুরু হয়েছে; ইতোমধ্যে রাজাবাড়ী এলাকায় পিলার বসানোর কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, চলতি বছরে ৭৫০ একর জমিতে শালের চারা রোপণ করা হবে এবং আগামী তিন বছরে এ কার্যক্রম ৬,৬১০ একর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে। শালের পাশাপাশি স্থানীয় সহপ্রজাতি গাছ (companion species) রোপণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ভারসাম্য পুনরুদ্ধারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এবং বিদেশি প্রজাতির গাছ রোপণ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চালু করা হচ্ছে 'সহ-ব্যবস্থাপনা মডেল' (co-management model), যাতে বন সংরক্ষণে জনগণের অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি পায়। একই সঙ্গে বনভূমি দখল ও বন কর্মকর্তাদের হয়রানির মামলাগুলো বহাল রাখার পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় মামলা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রবর্তনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে 'Village Forest Rule', যাতে বননির্ভর সম্প্রদায়ের অধিকার এবং বন বিভাগের দায়িত্ব স্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়।
এ ছাড়া ছাত্রছাত্রী ও স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে চারা রোপণ ও সচেতনতামূলক কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে শালবনের পরিবেশগত ভারসাম্য পুনঃস্থাপন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং স্থানীয় মানুষের জীবিকা ও অধিকার রক্ষার এক সমন্বিত কাঠামো তৈরি হচ্ছে—যা হয়তো একদিন এই নিস্তব্ধ শালবনে ফিরিয়ে আনবে হারানো প্রাণের সুর।
_________________________________________________________________
লেখক: আশিকুর রহমান সমী
মাননীয় উপদেষ্টার সহকারী একান্ত সচিব
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়
