ওমান দুর্ঘটনা: সন্তানকে কখনও কোলে নেয়া হয়নি রকির, বাবা নেই বুঝে গেছে আরজুর তিন বছরের মেয়ে

চার মাস বয়সী শিশু মোহাম্মদ নূর এখনও বাবার স্পর্শ পায়নি। বুধবার (৮ অক্টোবর) বিকেলে ভিডিও কলে প্রবাসে থাকা বাবা মোহাম্মদ রকির (২৫) সঙ্গে শেষ কথা হয়। কাজে বের হওয়ার আগে রকিও বারবার দেখতে চাইছিলেন সন্তানের মুখ। এর মাত্র এক ঘণ্টা পর ওমানের দুখুম সিদ্দা এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিনি।
দশ মাস আগে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে রেখে ওমানে পাড়ি জমানো রকির স্বপ্ন ছিল, দেশে ফিরে সন্তানকে কোলে তুলে নেবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না।
বুধবারের এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহত আট বাংলাদেশির সবার বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলায়। মাছ ধরতে সাগরে যাওয়ার পথে তাদের বহনকারী গাড়িটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এই ঘটনায় পুরো সন্দ্বীপে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
নিহতরা হলেন— উপজেলার সারিকাইত ইউনিয়নের আমিন মাঝি, মো. আরজু, মো. রকি, সাহাব উদ্দিন ও মো. বাবলু এবং মাইটভাঙা ইউনিয়নের মো. জুয়েল ও রহমতপুর ইউনিয়নের মো. রনি। তারা সবাই ওমানে মাছ ধরার কাজ করতেন।

নিহত রকি সারিকাইত ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মোহাম্মদ ইব্রাহিমের ছেলে। উন্নত জীবনের আশায় প্রায় সাত বছর আগে ওমানে পাড়ি জমান তিনি। তিন ছেলে ও এক মেয়ের সংসারটি মূলত বড় ছেলে রকির আয়েই চলত।
রকির বাবা ইব্রাহিম টিবিএসকে বলেন, 'ছেলে আগে এখানে মাছ ধরত, জাল বুনত। উন্নত জীবনের আশায় প্রায় সাত বছর আগে ওমানে গিয়েছিল। আমার তিন ছেলে ও এক মেয়ের সংসারটি বড় ছেলে রকির আয়েই চলত। গতকাল দুর্ঘটনার আগে ভিডিও কলে বারবার চার মাসের শিশু সন্তানকে দেখতে চেয়েছিল। আর সন্ধ্যায় শুনি দুর্ঘটনায় আমার ছেলে নাই হয়ে গেছে।'
২১ দিন আগেই ওমানে ফিরেছিলেন
সারিকাইত ইউনিয়নের মুন্সিবাড়ি এলাকায় পাশাপাশি বাড়ি মোহাম্মদ সাহাব উদ্দিন (৩৪) ও মোহাম্মদ বাবলুর। দুই মাসের ছুটি কাটিয়ে মাত্র ২১ দিন আগে, গত ১৭ সেপ্টেম্বর তারা দুজন একসঙ্গে ওমানে কর্মস্থলে ফিরেছিলেন। তাদের এই আকস্মিক মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না স্বজনরা।
সাহাব উদ্দিনের চার মাস বয়সী এক কন্যাসন্তান রয়েছে। তার নাম আছিয়া মনি। সাহাব উদ্দিনের বাবা মো. আবু ছিদ্দিক নাতনিকে কোলে নিয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন। তিনি বলেন, 'নাতনির দিকে এখন তাকাতে পারছি না। ছেলে দুই বছর প্রবাসে থেকে ছুটিতে এসেছিল। তখন এই মেয়েকে ছাড়া কিছুই বুঝত না।'
অন্যদিকে, বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারের হাল ধরেছিলেন মোহাম্মদ বাবলু। প্রবাস জীবনের আয় দিয়ে তিন বোনের বিয়েও দিয়েছেন।

বাবলুর বড় ভাই মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, 'সে আমাদের সবার জন্য করেছে, কিন্তু নিজের জন্য কিছুই করেনি। তার ঘরের ছাদ দিয়ে এখনও বৃষ্টি পড়লে পানি ঝরে। এবার গিয়েছিল ঘরটা ঠিক করতে আর তার চার ও দুই বছর বয়সী দুই সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে। মাত্র তিন দিন আগে সে ছেলের জন্মনিবন্ধন করিয়ে গেছে। গতকাল সে আমাকে ফোন করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আমি ঘুমাচ্ছিলাম। আমি তিন মাস সাগরে থাকার পর মাত্র দুই দিন আগে বাড়ি ফিরেছি। ভাইয়ের সঙ্গে শেষ বিদায়টাও নিতে পারলাম না।'
'বাবা নেই' বুঝে গেছে তিন বছরের শিশুও
দুর্ঘটনায় নিহত আরেক প্রবাসী মোহাম্মদ আরজুর (৩১) বাড়িতেও চলছে শোকের মাতম। কান্নাকাটির মধ্যে তার তিন বছর বয়সী মেয়ে আনিশা জান্নাতও যেন বুঝতে পারছিল, তার বাবা আর কখনও ফিরবে না।

আরজুর বাবা শহীদ উল্লাহ বলেন, 'দেশে থাকতে কুলিং কর্ণারের দোকান ছিল আরজুর। সন্তানের ভবিষ্যতের আশায় ওমানে প্রবাসে থাকা বড় ভাই মোহাম্মদ মিলাদের সঙ্গে প্রবাসে গিয়েছে। এখনও ঋণ রয়ে গেছে। তার স্বপ্ন পূরণ হলো না। প্রায় দেড় বছর আগে ছয় মাসের ছুটিতে এসেছিল আরজু। পরে আবার গিয়েছে।'
লাশ দেশে আনার প্রক্রিয়া শুরু
সন্দ্বীপের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মংচিংনু মারমা বৃহস্পতিবার নিহতদের বাড়ি পরিদর্শন করে স্বজনদের সান্ত্বনা দেন।
তিনি বলেন, 'পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। আমি আজ নিহতদের বাড়ি গিয়েছিলাম। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু খাবার, কাপড় ও আর্থিক অনুদান পৌঁছে দিয়েছি। নিহতদের লাশ দেশে আনতে প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এখান থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতে স্ব স্ব ইউনিয়নের সচিব ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব দিয়েছি। আর সরকারের পক্ষ থেকে অনুদানের জন্য এসব কাগজপত্র প্রয়োজন।'