তিন বছরে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরা ২১ শতাংশ কমেছে, ইলিশ আহরণ কমেছে প্রায় ৭৮ শতাংশ

বঙ্গোপসাগরে বাণিজ্যিক–ভিত্তিতে মাছ ধরার পরিমাণ গত তিন বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। এতে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী ও শিল্পখাতের নেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, অন্যদিকে প্রত্যেক মাছধরা অভিযানে বাড়তি খরচ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন জাহাজমালিকরা।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের রেকর্ড ১ লাখ ৪৬ হাজার টন থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাণিজ্যিক ট্রলারে ধরা মাছের পরিমাণ ২১ শতাংশ কমে ১ লাখ ১৬ হাজার টনে নেমে এসেছে।
সবচেয়ে বড় পতন ঘটেছে ইলিশ আহরণে। বাণিজ্যিকভাবে ধরা ইলিশের পরিমাণ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ৮ হাজার ১৩৮ টন—যা প্রায় ৭৮ শতাংশ হ্রাস পেয়ে আলোচ্য অর্থবছরে ১ হাজার ৭৯০ টনে নেমে এসেছে।
ইলিশের মতোই সার্ডিনজাতীয় মাছের আহরণও কমেছে, যদিও তা তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম। গত তিন বছরে এই শ্রেণির মাছের পরিমাণ ৫০ হাজার ৭৮৩ টন থেকে ৪৪ শতাংশ কমে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৫৬৪ টনে।
অন্য প্রজাতির মধ্যে সামুদ্রিক চিংড়ি উৎপাদন বেড়েছে—১ হাজার ৯৫৪ টন থেকে বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ২২ টন। তবে ক্যাটফিশের পরিমাণ ৫ হাজার ৬৪৬ টন থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫২৪ টনে।
সর্বশেষ পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়—পামফ্রেট ৯৩৬ টন, লাক্ষা (ক্রোকার) ২ হাজার ৬৪৪ টন, কাটলফিশ ১২ হাজার ৬৬ টন, রিবনফিশ ৪ হাজার ৬৩৫ টন, জিউফিশ ৪ হাজার ১২০ টন এবং ইল মাছ ৫ হাজার ১৯ টন ধরা পড়েছে।
এই সংকট আরও বেড়েছে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য দ্রুত কমে আসায়। আগে বাণিজ্যিকভাবে আহরিত মাছের প্রজাতি সংখ্যা ছিল ১১২টিরও বেশি। তবে এ সংখ্যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫৫–৫৭টিতে। এটি সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য হারানোর এক বড় ইঙ্গিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাছ ধরার পরিমাণ ওঠানামার পর এখন ক্রমাগত কমছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আহরণ হয়েছিল ১ লাখ ৭ হাজার ২৩৬ টন মাছ—যা ধীরে ধীরে বেড়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ লাখ ১৫ হাজার ৩৫৪ টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ লাখ ১৯ হাজার ১২১ টন এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৭ টনে পৌঁছায়। তবে এরপর থেকেই মাছের পরিমাণ কমতে শুরু করে; ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সামুদ্রিক মৎস্য শিকার নেমে আসে ১ লাখ ১৪ হাজার ৮০৪ টনে এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সামান্য বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ১৬ হাজার ৬৫০ টন।
দূষণ, অতিমাত্রায় মাছ ধরা ও নদীতে পলি জমাকে দায়ী করলেন গবেষকরা
বিজ্ঞানীরা এই পতনের পেছনে একাধিক কারণকে দায়ী করছেন। এরমধ্যে রয়েছে প্লাস্টিক, ধাতব, রাসায়নিক ও তেল দূষণসহ নিয়ন্ত্রণহীন অতিমাত্রায় মাছ ধরা এবং অগভীর প্রজনন এলাকায় নির্বিচারে ট্রলার চালানো। পাশাপাশি তারা সেসব নদী রক্ষায় জোর দিয়েছেন, যেগুলো বঙ্গোপসাগরে জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশের ১১৯টি নদী বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক খাদ্যশৃঙ্খল বজায় রাখতে সহায়তা করে। কিন্তু এসব নদীর মোহনায় ব্যাপক পলি জমে সমুদ্রে পুষ্টি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পুষ্টি সরবরাহ কমে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়ছে গভীর সমুদ্রের মাছের মজুদেও।
বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকারভুক্ত সমুদ্রসীমা ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার হলেও, বর্তমানে বাণিজ্যিক ট্রলার পরিচালিত হচ্ছে মাত্র ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটারে। একই এলাকায় বারবার মাছ ধরার কারণে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মাছের মজুদ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে, সীমিত বিনিয়োগ ও দুর্বল অবকাঠামোর কারণে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না।
সামুদ্র বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন, দ্রুত বাড়তে থাকা দূষণ মাছের প্রজনন প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বঙ্গোপসাগরে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ঘনত্ব দক্ষিণ চীন সাগরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ একাডেমির গবেষক ও প্রশিক্ষক মজহারুল ইসলাম বলেন, "বঙ্গোপসাগর এশিয়ার অন্যতম দূষিত সমুদ্র অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। এখানে মাইক্রোপ্লাস্টিক ছাড়াও পেস্টিসাইড থেকে আসা ক্ষতিকর পিএফএএস ও পারসিস্টেন্ট অর্গানিক পলিউট্যান্টস শনাক্ত হয়েছে। এসব রাসায়নিক মাছের প্রজনন প্রক্রিয়া ব্যাহত করছে এবং খাদ্যশৃঙ্খল ক্ষতিগ্রস্ত করছে।"

অতিমাত্রায় মাছ ধরা ও অবৈধ ট্রলার চলাচল
সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে দেশে নিবন্ধিত বাণিজ্যিক ট্রলারের সংখ্যা ২৬৬টি, যার মধ্যে প্রায় ২৩২টি সক্রিয়ভাবে মাছ ধরছে। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে প্রায় ৬৬ হাজার ছোট আকারের যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক নৌকা।
আইন অনুযায়ী ৪০ মিটারের কম গভীর পানিতে ট্রলার চালানো নিষিদ্ধ হলেও বাস্তবে নিয়মটি প্রায়ই লঙ্ঘিত হচ্ছে। ট্রলারগুলো সোনার প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছের ঝাঁক শনাক্ত করছে এবং সূক্ষ্ম জালের অবৈধ জাল ফেলে অপ্রাপ্তবয়স্ক মাছও ধরে ফেলছে।
এছাড়া বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কখনও ম্যাক্সিমাম সাস্টেনেবল ইল্ড (এমএসওয়াই) জরিপ পরিচালিত হয়নি। ফলে নীতিনির্ধারকদের কাছে নিরাপদভাবে মাছ আহরণের সীমা নির্ধারণের জন্য নির্ভরযোগ্য তথ্যও নেই।
অঘোষিত মাছ ধরা এখন সামুদ্রিক মৎস্য খাতের আরেকটি বড় সমস্যা। অনেক ট্রলারমালিকই প্রকৃত আহরণের পরিমাণ কম দেখিয়ে মৎস্য অধিদপ্তরে তথ্য দেন, ফলে মোট ধরা মাছের সঠিক পরিসংখ্যান অজানা থেকে যায়।
বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এনাম চৌধুরী বলেন, "বাণিজ্যিক ট্রলারগুলো মোট সামুদ্রিক আহরণের মাত্র ১২ শতাংশের জন্য দায়ী। বাকি ৮৮ শতাংশ আসে ৭০ হাজারের বেশি ছোট নৌকা থেকে, যাদের অধিকাংশই অগভীর পানিতে অবৈধ জাল ব্যবহার করে মাছ ধরে। তারা নির্বিচারে সম্পদ আহরণ করছে এবং প্রায়ই ধরা মাছের সম্পূর্ণ তথ্যও দেয় না। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ একসময় ধসে পড়বে।"
তিনি সরকারকে কঠোর নজরদারি ও অবৈধ মাছ ধরা বন্ধের আহ্বান জানান। এনাম চৌধুরী বলেন, "এখনই ব্যবস্থা না নিলে অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা আমাদের সামুদ্রিক সম্পদ ধ্বংস করে ফেলব।"
আঞ্চলিকভাবে পিছিয়ে বাংলাদেশ
বাংলাদেশ ২০১৮ সালে ইন্ডিয়ান ওশান টুনা কমিশনে (আইওটিসি) যোগ দেওয়ার পর আশা করা হয়েছিল গভীর সমুদ্র থেকে মাছ ধরায়—বিশেষ করে টুনা আহরণে—বড় ধরনের অগ্রগতি হবে। কিন্তু বাস্তবে তেমন উন্নতি দেখা যায়নি।
২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা ২ লাখ ৭০ হাজার টনের বেশি টুনা ও টুনা-জাতীয় মাছ আহরণ করেছে, সেখানে বাংলাদেশ ধরতে পেরেছে ৩ হাজার টনেরও কম। অথচ বাংলাদেশের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন ভারতের বা মালদ্বীপের চেয়েও বড়। তবুও গভীর সমুদ্র আহরণে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে।
গবেষণায় বলছে, বাংলাদেশ বছরে টেকসইভাবে প্রায় ৫ লাখ টন মাছ আহরণ করতে পারে, কিন্তু বর্তমানে আহরণের পরিমাণ ১ লাখ ১৬ হাজার টনের সামান্য বেশি। খাতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা বলছেন, গভীর সমুদ্রে টুনা আহরণের সক্ষমতা গড়ে তুলতে অন্তত ১,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন।
বাড়তি খরচে বিপাকে ট্রলারমালিকরা
বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া একটি ট্রলারের ১৭–২০ দিনের অভিযানে আকারভেদে ডিজেল খরচই হয় প্রায় ১ কোটি থেকে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হয় এক মাসের খাবার, সরঞ্জাম ও অন্যান্য ব্যয়। সব মিলিয়ে প্রতিদিনের পরিচালন ব্যয় দাঁড়ায় ৭ থেকে ১১ লাখ টাকা পর্যন্ত। অভিযানের শেষে প্রতিটি ট্রলার ৪০ থেকে ১০০ টন মাছ নিয়ে ফিরে আসে—ট্রলারের আকার ও ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে এই পরিমাণ ওঠানামা করে।
অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এনাম চৌধুরী বলেন, "যেসব বড় প্রতিষ্ঠান ব্যাংক ঋণ ছাড়া জাহাজ কিনেছে, তারা কোনোভাবে টিকে আছে। কিন্তু যেসব প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়ে ট্রলার কিনেছে, কিস্তি পরিশোধের পর লাভ করা তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।"
তিনি আরও বলেন, "আরেকটি বড় সমস্যা হলো প্রতিকূল আবহাওয়া। অনেক সময় ঝড়-বৃষ্টি বা সাগর উত্তাল থাকায় মাছ ধরতে যাওয়া যায় না, আবার মাঝপথ থেকে ফিরতে হয়। একটি জাহাজ বছরে সর্বোচ্চ সাত–আটটি অভিযান সম্পন্ন করতে পারে।"

কী বলছেন কর্মকর্তারা
এদিকে, সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এখনই এই পরিস্থিতিকে কাঠামোগত পতন হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইছেন না।
অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বিভাগের পরিচালক মঈন উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "গত বছরের তুলনায় ২০২৪–২৫ অর্থবছরে আহরণ সামান্য বেড়েছে। এপ্রিল–মে মাসে খারাপ আবহাওয়ার কারণে ট্রলার পরিচালনা সীমিত ছিল, ফলে মাছ ধরার পরিমাণ কমে যায়। একই এলাকায় বারবার মাছ ধরার কারণে সাময়িকভাবে মজুদও কমে যেতে পারে। তবে এক–দুই বছরের তথ্যের ভিত্তিতে বলা যাবে না যে মাছ হারিয়ে যাচ্ছে।"
তিনি আরও জানান, "২০১৬ সালের আগে বাংলাদেশের কোনো সমুদ্র জরিপ জাহাজ ছিল না। এখন আমরা স্টক এসেসমেন্ট করতে শুরু করেছি, সঠিকভাবে সামুদ্রিক সম্পদের পরিমাণ নিরূপণ করতে আরও কয়েক বছর সময় লাগবে।"
একইসঙ্গে তিনি অতিমাত্রায় মাছ ধরা, অগভীর পানিতে ট্রলার চালানো ও অবৈধ জাল ব্যবহারের মতো সমস্যাগুলোর কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, "এসব অনিয়ম রোধে অধিদপ্তর নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে।"