ফুটবল স্টেডিয়ামের চেয়েও বেশি দরকার হাসপাতাল, মরক্কোয় জেন জি বিক্ষোভে মৌলিক অধিকারের দাবি

২০৩০ বিশ্বকাপের সহ-আয়োজক হতে গিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফুটবল স্টেডিয়াম নির্মাণকাজ করছে মরক্কো। খবর বিবিসির।
কিন্তু গত শনিবার থেকে প্রতিদিন রাতে দেশজুড়ে রাস্তায় নামা বিক্ষোভকারীদের কাছে, ১ লাখ ১৫ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এই স্টেডিয়াম ও অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন—যার ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার—সরকারের ভুল অগ্রাধিকারের প্রতীক।
"আমি বিক্ষোভ করছি কারণ আমি চাই আমার দেশটা আরও ভালো হোক। আমি মরক্কো ছেড়ে যেতে চাই না, কিন্তু একই সঙ্গে এটাও চাই না যে নিজের দেশে থেকেই ক্ষোভ নিয়ে বাঁচতে হবে," বলেন ২৫ বছর বয়সী কমিউনিকেশন ম্যানেজার হাজার বেলহাসান।
ডিসকর্ড থেকে রাস্তায়
'জেন জি ২১২' নামে তরুণদের একটি সংগঠন—যার নামকরণ মরক্কোর আন্তর্জাতিক টেলিফোন কোড ২১২ থেকে—এই আন্দোলন সংগঠিত করছে গেমিং ও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ডিসকর্ড, টিকটক ও ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে।
সম্প্রতি নেপালের জেন জি আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মরক্কোর তরুণরা চাইছে, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও মৌলিক সেবার ক্ষেত্রে সরকার যেন একই রকম তৎপরতা ও আবেগ দেখায়, যেভাবে বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রস্তুতিতে করছে।
২৭ সেপ্টেম্বর ১০টি শহরে বিক্ষোভ দিয়ে শুরু হওয়া এ আন্দোলনে স্লোগান উঠেছে: "বিশ্বকাপ নয়, আগে স্বাস্থ্য" এবং "আমরা চাই হাসপাতাল, ফুটবল স্টেডিয়াম নয়।"

দমন-পীড়ন ও প্রাণহানি
এদিকে আন্দোলন দমাতে স্থানীয় পুলিশ ব্যাপক গ্রেপ্তার শুরু করেছে। কোথাও কোথাও সহিংসতা দেখা দিয়েছে, তাতে ইতোমধ্যেই তিনজন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী আজিজ আখনুশ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংলাপের ইঙ্গিত দিলেও তরুণদের নেতা-শূন্য এই আন্দোলন স্পষ্ট জানিয়েছে, দৃশ্যমান পরিবর্তন না আসা পর্যন্ত বিক্ষোভ চলবে।
তাদের দাবিগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, যার মধ্যে রয়েছে: সবার জন্য বিনামূল্যে ও মানসম্মত শিক্ষা, সর্বজনীন সহজপ্রাপ্য স্বাস্থ্য সেবা, সাশ্রয়ী আবাসন, উন্নত গণপরিবহন, নিত্যপণ্যের দাম কমানো ও ভর্তুকি বৃদ্ধি, মজুরি ও পেনশন বাড়ানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বেকারত্ব কমানো এবং আরবির পর আনুষ্ঠানিক দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ফরাসির পরিবর্তে ইংরেজিকে গ্রহণ।
অসন্তোষের মূল—আগাদিরের ট্র্যাজেডি
গেল সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি মরক্কোর দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর আগাদিরের একটি হাসপাতালে কয়েক দিনের ব্যবধানে আট নারী প্রসূতির মৃত্যু আন্দোলনকে আরও জোরদার করে। স্থানীয় সূত্র বলছে, যথাযথ চিকিৎসা, সরঞ্জাম ও পর্যাপ্ত কর্মী থাকলে এসব মৃত্যু রোধ করা যেত।
২০২৩ সালের হিসাবে মরক্কোয় প্রতি ১০ হাজারে চিকিৎসক সংখ্যা মাত্র ৭.৮ জন—যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কমপক্ষে ২৩ জনের সুপারিশ করে।
তরুণদের অভিজ্ঞতা
হাজার বেলহাসান বলেন, "আমাদের দাবি একেবারেই যৌক্তিক ও মৌলিক। স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় অধিকার, যা অগ্রাধিকার পাওয়াই উচিত।"
২৩ বছরের হাকিম (ছদ্মনাম) বলেন, "কিছুদিন আগে আমার বাবা স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। তাঁকে বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়ার মতো কিছু সঞ্চয় যদি আমার পরিবারের না থাকতো, তবে তিনি মারা যেতেন। রাষ্ট্র আমাকে কী দিচ্ছে? স্বাস্থ্য নেই, মানসম্মত শিক্ষা নেই। এই সরকার তার ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করছে।"
বিক্ষোভে অংশ নেওয়ায় হাকিমকে কিছুদিন আগেই গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। তিনি জানান, সেদিন তিনি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে যোগ দিতে যান কাসাব্লাঙ্কার রাজপথে, কিন্তু তাঁকে গ্রেপ্তার করে আটক রাখা হয় পুলিশের একটি হাজতে, যেখানে আরও ৪০ জনের সাথে তাঁকে রাখা হয়েছিল।
মানবাধিকার সংগঠনের সমালোচন
স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো পুলিশের সহিংস দমননীতি ও নির্বিচার গ্রেপ্তারের কড়া সমালোচনা করেছে।
তরুণরা এ আন্দোলনের সঙ্গে ১৯৮১ সালের সহিংস বিক্ষোভ ও ২০১১ সালের আরব বসন্তের সময়কার বিক্ষোভের তুলনা করছেন। তবে এবারকার আন্দোলন আলাদা—কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এবং কোনো আনুষ্ঠানিক নেতৃত্বও নেই।
সহিংসতার শঙ্কা ও সংলাপের ডাক
গত ১ অক্টোবর লকলিয়া শহরে এক পুলিশ স্টেশনে হামলার চেষ্টা করলে সংঘর্ষে তিন বিক্ষোভকারী নিহত হন। স্থানীয় প্রশাসন সিসিটিভি ভিডিও প্রকাশ করে দাবি করেছে, বিক্ষোভকারীরা অগ্নিসংযোগ ও অস্ত্র লুটের চেষ্টা করেছিল।
তবে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীরা এসব সহিংসতা ও লুটপাট নিন্দা করে ক্লিন-আপ টিম গঠন করেছেন। তারা শান্তি ও সংলাপের ডাক দিলেও সরকারের প্রতিক্রিয়ায় আস্থা পাচ্ছেন না।
বিশ্বকাপ নিয়ে উৎসাহ থাকা সত্ত্বেও বেলহাসান বলেন, "আমরা ফুটবল ভালোবাসি, এটা আমাদের রক্তে। কিন্তু আমাদের মৌলিক ভিত্তি অনুপস্থিত। হ্যাঁ, স্টেডিয়াম বানানো হোক, কিন্তু পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থাও শক্তিশালী করা হোক। প্রথমে আমাদের জনগণের যত্ন নিতে হবে।"