যে কারণে মস্তিষ্ক কিছু স্মৃতি মনে রাখে, আর কিছু ভুলে যায়

দুই বছর আগে নিউ হ্যাম্পশায়ারে বেড়াতে গিয়েছিলেন চেনইয়াং লিও লিন। সেখানে গাছের মধ্যে কিছু কাঠবিড়ালির ছোটাছুটি দেখে তিনি থেমে যান। সেই 'প্রাণবন্ত মুহূর্ত' তার মনে গেঁথে যায়। দিনের শেষে তিনি অবাক হয়ে খেয়াল করলেন, সেই মুহূর্ত তিনি 'একেবারে স্পষ্টভাবে' মনে করতে পারছেন। শুধু তাই নয়, গন্তব্যে যাওয়ার পথে তিনি ও তার সহকর্মীরা খামারের যে পশুগুলোকে পাশ কাটিয়ে এসেছিলেন, তাদের কথাও মনে পড়ছে।
লিনের মতে, সাধারণত এ ধরনের সাধারণ দৃশ্য তিনি মনে রাখতেন না। লিন বোস্টন ইউনিভার্সিটির রিনহার্ট নিউরোসায়েন্স ল্যাবের একজন ডক্টরাল ছাত্র। এ অভিজ্ঞতা তাকে ভাবিয়ে তোলে: আমাদের মস্তিষ্ক কেন কিছু সাধারণ মুহূর্তকে আঁকড়ে ধরে রাখে, আর অন্যগুলোকে হারিয়ে যেতে দেয়?
এই প্রশ্নই ছিল সম্প্রতি 'সায়েন্স অ্যাডভান্সেস' জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণার মূল বিষয়। গবেষকেরা আশা করছেন, এ গবেষণার অনেক বাস্তবসম্মত প্রয়োগ থাকবে। যেমন, শিক্ষকেরা কীভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো কিছু মনে রাখার ক্ষমতা বাড়াতে পারেন, অথবা ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচর্যাকারীরা কীভাবে যোগাযোগ করবেন—এসব ক্ষেত্রে এটি নতুন দিশা দেখাতে পারে।
লিন এবং বোস্টন ইউনিভার্সিটির অন্য গবেষকদের লেখা এই গবেষণা বলছে, আমাদের মস্তিষ্ক বেছে বেছে কিছু স্মৃতিকে শক্তিশালী করে তোলে, যখন সেই স্মৃতিগুলো কোনো গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত থাকে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় 'মেমোরি এনহ্যান্সমেন্ট' বা স্মৃতির শক্তি বৃদ্ধি। এই গবেষণাপত্রটি প্রায় ৬৫০ জন অংশগ্রহণকারীকে নিয়ে করা ১০টি ভিন্ন ভিন্ন গবেষণার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মস্তিষ্ক একটি পাল্লা ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত নেয় যে কোন স্মৃতিগুলো সংরক্ষণ করা হবে।
গবেষণাপত্রটি পর্যালোচিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আমাদের 'ভঙ্গুর' স্মৃতিগুলো—অর্থাৎ যেগুলো সাধারণত দৈনন্দিন সাধারণ ঘটনা—যদি কোনো স্মরণীয় বা পুরস্কার পাওয়ার মতো মুহূর্তের সাথে জুড়ে দেওয়া যায়, তাহলে সেগুলো হারিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচতে পারে। আর এই কাজ যদি একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে করা যায়, তবে দরকারি স্মৃতিগুলোকে শক্তিশালী করা এবং অপ্রয়োজনীয় স্মৃতিগুলোকে দুর্বল করে দেওয়া সম্ভব।
বোস্টন ইউনিভার্সিটির মনস্তাত্ত্বিক ও মস্তিষ্ক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং এই গবেষণার সহ-লেখক রবার্ট এম. জি. রিনহার্ট একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, 'স্মৃতি শুধু একটা নিষ্ক্রিয় রেকর্ডিং যন্ত্র নয়। আমাদের মস্তিষ্ক ঠিক করে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ এবং আবেগঘন ঘটনাগুলো পেছনের সময়ের ভঙ্গুর স্মৃতিকে স্থিতিশীল করতে পারে। আমাদের গবেষণা বলছে, আবেগের গুরুত্বকে সুনির্দিষ্ট উপায়ে কাজে লাগানো যেতে পারে।'
তাদের গবেষণার জন্য, গবেষকেরা নিজেরা তিনটি পরীক্ষা চালান এবং অন্য সাতটি স্বাধীন পরীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণ করেন। দলের পরীক্ষাগুলোতে অংশগ্রহণকারীদের বিভিন্ন ছবি দেখানো হয়েছিল। কিছু ছবি ছিল 'সাধারণ' এবং অন্যগুলোর সাথে নগদ বোনাস বা 'পুরস্কার' যুক্ত ছিল। পরের দিন তাদের হঠাৎ করে একটি স্মৃতি পরীক্ষা নেওয়া হয়। এছাড়া, হালকা বৈদ্যুতিক শকের সাথে যুক্ত ছবির পরীক্ষাও ডেটাসেটের অংশ হিসেবে বিশ্লেষণ করা হয়।
গবেষকেরা দেখেছেন, কোনো আবেগঘন ঘটনার— এক্ষেত্রে পুরস্কার বা শক—ঠিক আগে ঘটে যাওয়া 'ভঙ্গুর' ঘটনাগুলো মানুষ বেশি মনে রাখতে পারছে। বিশেষ করে যখন সেই স্মৃতিগুলোর সাথে আবেগঘন ঘটনার কোনো মিল ছিল, যেমন একই রঙ বা দৃশ্য। তারা আরও দেখিয়েছেন যে, কোনো বড় ঘটনার পরে আসা সাধারণ স্মৃতিও মানুষ বেশি মনে রাখতে পারে, যদি সেই ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ণ বা অর্থপূর্ণ হয়।
গবেষণার প্রধান লেখক লিন একটি ইমেইলে লিখেছেন, 'আবেগঘন ঘটনা তার কাছাকাছি সমস্ত স্মৃতিকে সমানভাবে শক্তিশালী করে না—মস্তিষ্ক সময়ের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন নিয়ম ব্যবহার করে।'
রিনহার্টের মতে, একটি শক্তিশালী অভিজ্ঞতা বা ঘটনার স্মৃতি বর্ধক প্রভাব মূলত সেই 'ভঙ্গুর স্মৃতিগুলোর উপরই প্রযোজ্য হয়, যেগুলো অন্যথায় হারিয়ে যেত।' যদি অপ্রধান স্মৃতিগুলোর নিজেদেরও আবেগগত ওজন থাকত, তবে সেই প্রভাব কমে যেত।
স্মৃতি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক, কিন্তু বিশেষজ্ঞরা একমত যে আপনার বয়স যাই হোক না কেন, এটি ভুল করতে পারে এবং পরিবর্তনশীল। আমাদের জীবনকালে, আমাদের মস্তিষ্ক অগণিত তথ্য প্রক্রিয়া করে এবং সিদ্ধান্ত নেয় কোনটি মনে রাখতে হবে আর কোনটি ভুলে যেতে হবে। সাধারণত, মস্তিষ্ক সেই তথ্যকেই অগ্রাধিকার দেয় যা স্বতন্ত্র এবং আবেগ দিয়ে ভরা। তারপরেও, আমাদের স্মৃতি পরিবর্তন হতে পারে।
স্নায়ুবিজ্ঞানীরা মানুষের মস্তিষ্ক সম্পর্কে যত জেনেছেন, তারা এটাও বুঝতে পেরেছেন যে এর যত্ন নেওয়ার এবং স্মৃতিশক্তি হ্রাসের ঝুঁকি কমানোর বিভিন্ন উপায় রয়েছে। যেমন, নিয়মিত ব্যায়াম করা, পর্যাপ্ত ঘুমানো, অ্যালকোহল গ্রহণ ও মানসিক চাপ কমানো এবং সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলা। গবেষকেরা বিশ্বাস করেন, এই নতুন গবেষণা সেই প্রচেষ্টায় একটি নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। এটি দেখায় যে, জীবনের সব পর্যায়ে মানুষ কীভাবে নির্দিষ্ট কৌশলের মাধ্যমে তাদের স্মৃতিকে আরও ভালোভাবে ধরে রাখতে পারে।
স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো ইউনিভার্সিটির কগনিটিভ নিউরোসায়েন্টিস্ট মারিয়া উইম্বার গবেষণাটির ফলাফলকে 'চমকপ্রদ' বলে অভিহিত করেছেন। তিনি একটি ই-মেইল বার্তায় লিখেছেন, 'আমার কাছে সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো: আমাদের স্মৃতিগুলো স্থির স্ন্যাপশট নয়। এগুলো গতিশীল এবং এরপর কী ঘটছে তার ওপর ভিত্তি করে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হতে পারে।'
লিন আশা করেন, এই গবেষণার ফলাফল 'ক্লাসরুম থেকে ক্লিনিক পর্যন্ত' প্রভাব ফেলবে। এটি পাঠদানের পদ্ধতিও বদলে দিতে পারে। কারণ, এটি ইঙ্গিত দেয়, একজন ছাত্রের একটি ইতিহাস পাঠ মনে রাখার সম্ভাবনা বেশি থাকবে যদি তা কোনো পুরস্কার পাওয়ার মতো অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত করা হয়। যেমন, একটি ধাঁধা সমাধান করা, যা বিষয়টির সঙ্গে আরও সম্পৃক্ততা এনে দেয় বা এমন একটি গল্প বোনা, যা কৌতূহল জাগায়।'
ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে, টেবিলে চশমা রেখে যাওয়ার মতো একটি ভঙ্গুর স্মৃতি 'আরও দৃঢ়ভাবে গেঁথে যেতে পারে যদি তা প্রাসঙ্গিক এবং অর্থপূর্ণ কিছুর সাথে যুক্ত করা হয়। যেমন, একটি 'প্রিয় গান, একটি পারিবারিক ছবি, বা এমনকি একটি ছোট উপহার', বলেন লিন।
এই গবেষণার একটি সীমাবদ্ধতা হলো, এটি স্মৃতির শক্তি বৃদ্ধির পেছনের মস্তিষ্কের কার্যপ্রণালীর পরিমাপ করে না। লিন বলেছেন, পশুদের নিয়ে গবেষণা করা স্নায়ুবিজ্ঞানীদের মধ্যে একটি পরিচিত তত্ত্ব হলো, 'দুর্বল স্মৃতিগুলোকে 'ট্যাগ' বা চিহ্নিত করা যেতে পারে এবং পরে যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে তবে সেগুলোকে স্থিতিশীল করা যায়, যা 'বিহেভিওরাল ট্যাগিং' নামে পরিচিত।'
উইম্বার বলেন, এই গবেষণা 'গুরুত্বপূর্ণ'। কারণ, মানুষের মধ্যে আচরণগত ট্যাগিং তত্ত্বের প্রমাণ 'মিশ্র' ছিল।
গবেষণাটি এর পরীক্ষার ধরনের কারণেও সীমাবদ্ধ। এতে তুলনামূলকভাবে সহজ উদ্দীপক—যেমন প্রাণী এবং যন্ত্রপাতির ছবি—ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু বাস্তব জীবনে মানুষ সাধারণত যে জটিল পরিস্থিতি ও পারস্পরিকতার মুখোমুখি হয় এবং মনে রাখে বা মনে রাখতে সংগ্রাম করে—তা ব্যবহার করা হয়নি। লিনের মতে, পরবর্তী পদক্ষেপ হলো, দৈনন্দিন পরিস্থিতিতে মস্তিষ্ক এবং স্মৃতির ভান্ডার একইভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় কি না, তা পরীক্ষা করা।