ইঞ্জিন বিকল হয়ে এক বছর ধরে অচলাবস্থায় দেশের প্রথম ভাসমান গবেষণা জাহাজ
প্রায় ৭ বছর আগে রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে দেশের প্রথম বিশেষায়িত ভাসমান গবেষণা জাহাজটি উদ্বোধন করে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু)। বিলুপ্তপ্রায় মাছের অভয়ারণ্য গড়ে তোলা, হারিয়ে যাওয়া মাছের পুনরুদ্ধার, উচ্চশিক্ষা-গবেষণার ক্ষেত্র বিস্তারে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নির্মিত এ জাহাজটি বারবার ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় গত প্রায় এক বছর ধরে অচল অবস্থায় পড়ে আছে।
২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অর্থায়নে ৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয়ে জাহাজটি নির্মিত হয়। সুইডেনের একটি শিপবিল্ডিং কোম্পানি ১৭ মিটার দীর্ঘ, ৭ মিটার প্রস্থ এবং দুইতলা বিশিষ্ট এই জাহাজটি বহুমুখী জলজ গবেষণার উপযোগী করে ডিজাইন করে।
কিন্তু গত পাঁচ বছরে একের পর এক যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে জাহাজটি এখন চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে আছে। সর্বশেষ দুটি ইঞ্জিনই বিকল হওয়ায় গত এক বছর ধরে জাহাজটি রাঙামাটিতে নোঙর করা অবস্থায় রয়েছে।
তবে গবেষকরা সীমিত পরিসরে এটিকে ভাসমান ল্যাবরেটরি হিসেবে ব্যবহার করছেন। নমুনা সংগ্রহের জন্য তাদের স্পিডবোটে করে হ্রদের ভেতরে যেতে হয়। পরে সেই নমুনা বিশ্লেষণের জন্য আবার নোঙর করা জাহাজে আনতে হয়। এতে সময় ও ব্যয়—দুটোই বাড়ছে।
সিভাসুর উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ লুতফুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "নৌযানটি এখন ল্যাব স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কচুরিপানা জমে যাওয়ায় চলাচলে সমস্যা হয়। এজন্য কাঠামোগত কিছু পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে।"
তিনি বলেন, "আমরা একটি কমিটি করেছি, যেখানে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিশেষজ্ঞ শিক্ষকও রয়েছেন। কীভাবে জাহাজটিকে চলাচলের উপযোগী করা যায় সে বিষয়ে সুপারিশ দেবে কমিটি। এরপর ইউজিসির কাছে অতিরিক্ত বরাদ্দ চাওয়া হবে।"
ইঞ্জিন বিকল ও ড্রাফটের সমস্যা
সিভাসুর নথিপত্র অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে রাঙামাটির পুরনো হেলিপ্যাড এলাকায় জাহাজ তৈরির কাজ শুরু হয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে পরীক্ষামূলকভাবে জাহাজটি চালু করা হয়। একই বছরের ২৮ নভেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গবেষণা তরিটি উদ্বোধন করেন।
সিভাসুর তথ্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়া তাদের কৃত্রিম হ্রদ 'লেক কেনিয়র'–এ অনুরূপ গবেষণা তরি ব্যবহার করে হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।
কাপ্তাই হ্রদ—চট্টগ্রাম অঞ্চলের অন্যতম মাছ আহরণ কেন্দ্র। জাহাজটির মাধ্যমে হ্রদটির মাটি, পানি, এবং জীববৈচিত্র্য নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা করার কথা ছিল। কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটি এবং জাহাজের ড্রাফট বেশি হওয়ায় এটি পানিতে স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারছে না। ফলে পুরো হ্রদ ঘুরে গবেষণা করার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে।
সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, গবেষণা তরিটি উদ্বোধনের পরপরই করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘদিন এর কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এরপর দেখা দেয় যান্ত্রিক ত্রুটি। ২০২১ সালে কয়েক মাস জাহাজটি অচল থাকে। পরে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় আবার সচল করা হলেও চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে একটি ইঞ্জিন এবং মে মাসে দ্বিতীয় ইঞ্জিনটিও বিকল হয়ে যায়। এরপর থেকেই জাহাজটি রাঙামাটির জলযান ঘাটে নোঙর করা অবস্থায় রয়েছে।
ইঞ্জিন সচল থাকা অবস্থাতেও জাহাজটি নিয়মিত চলত না। কাপ্তাই হ্রদের তুলনায় এর ড্রাফট বেশি হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে এটি পানিতে চলতে পারে না। অর্থাৎ, ইঞ্জিন সচল থাকলেও বছরের ছয় মাসের বেশি সময় ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি।
সিভাসু রিসার্চ ভেসেলের ইঞ্জিন চালক সুমিত চাকমা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ইঞ্জিন কয়েকবার বিকল হয়েছে। সুইডেনের নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, আমরা যে জ্বালানি ব্যবহার করি তা অপরিশোধিত—এজন্য ইঞ্জিন বারবার নষ্ট হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "কাপ্তাই লেকের নিচে উঁচুনিচু টিলা থাকায় ৬ মিটার ড্রাফটের জাহাজটি প্রায়ই আটকে যায়। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে এটি চালানো যায় না।"
এদিকে, সিভাসুর ফিশারিজ অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. এসকে আহমদ আল নাহিদ বলেন, "নৌযানটি বন্ধ থাকায় স্পিডবোটে করে হ্রদে গিয়ে স্যাম্পল আনতে হয়। পরে নোঙর করা জাহাজে এনে বিশ্লেষণ করা হয়। এতে সময় ও ব্যয় দুটোই অপচয় হচ্ছে। জাহাজ সচল থাকলে হ্রদের দূরবর্তী অংশেও গবেষণা করা যেত।"
রিসার্চ ভেসেলের গবেষণা সুবিধা
নথিপত্র অনুযায়ী, জাহাজটিতে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিসহ ৩টি ল্যাবরেটরি রয়েছে—ডিজিজ ল্যাব, ইকোলজি ল্যাব এবং বাথিমেট্রি ও ফিশিং টেকনোলজি ল্যাব।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ইতোমধ্যে অন্তত ১৫টি গবেষণায় এসব ল্যাব ব্যবহার করেছেন। হ্রদে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তার জন্য ৭ জন কর্মচারী রয়েছেন।
প্রফেসর ড. এসকে আহমদ আল নাহিদ জানান, রিসার্চ ভেসেলে একসঙ্গে ৪০ জন শিক্ষার্থী গবেষণায় অংশ নিতে পারেন।
তিনি বলেন, "আমাদের শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ল্যাবগুলো ব্যবহার করছেন। জলাশয়ের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, পানি- মাটির গুণগত মান পরীক্ষা, উদ্ভিদ ও প্রাণীবৈচিত্র্য নির্ণয়, মাছের দেহে দূষণ, মাইক্রোপ্লাস্টিক ও হেভিমেটাল শনাক্তকরণ—এসবই আমাদের নিয়মিত গবেষণা কাজ। নৌযান সচল না থাকায় এখন কেবল স্থির ল্যাব হিসেবেই এটি ব্যবহার হচ্ছে।"
সিভাসু রিসার্চ ভেসেলের নতুন কো-অর্ডিনেটর প্রফেসর মো. ফয়সাল বলেন, "আমি মাত্র এক মাস হলো দায়িত্ব পেয়েছি। নৌযানটি সচল থাকলে গবেষণায় আরও বড় সুবিধা হতো। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।"
