ডাকসুতে শিবির সমর্থিত প্যানেলের ভূমিধস জয়; ভিপি সাদিক, জিএস ফরহাদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত 'ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট' ভূমিধস বিজয় অর্জন করেছে। কেন্দ্রীয় সংসদের ২৮টি পদের মধ্যে সহ-সভাপতি (ভিপি) এবং সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদসহ ২৩টি পদ জিতেছে তারা।
ভিপি পদে সাদিক কায়েম পেয়েছেন মোট ১৪,০৪২ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের মো. আবিদুল ইসলাম খান পেয়েছেন ৫৭০৮ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম হোসেন এবং উমামা ফাতেমা যথাক্রমে ৩,৮৮৪ এবং ৩,৩৮৯ ভোট পেয়েছেন।
জিএস পদে ছাত্রশিবির সমর্থিত এস এম ফরহাদ জয় লাভ করেছেন। ফরহাদ পেয়েছেন ১০,৭৯৪ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল সমর্থিত শেখ তানবীর বারী হামিম পেয়েছেন ৫২৮৩ ভোট।
এছাড়া, প্রতিরোধ পর্ষদের মেঘমল্লার বসু ৪,৯৪৯ ভোট পেয়েছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী আরাফাত ৪,০৪৪ ভোট এবং বাকের ২,১৬১ ভোট পেয়েছেন।
ডাকসুর এজিএস পদে নির্বাচিত হয়েছেন ছাত্রশিবির সমর্থিত মহিউদ্দিন খান। তিনি মোট ১১,৭৭২ ভোট পেয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দী ছাত্রদলের প্রার্থী তানভীর আল হাদী মায়েদ পেয়েছেন ৫,০৬৪ ভোট। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের প্রতিনিধিত্বকারী আশরেফা খাতুন ৯০০ ভোট পেয়েছেন।
শিবির সমর্থিত ফাতেমা তাসনিম জুমা ১০,৬৩১ ভোট পেয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক পদে মনোনীত হয়েছেন।
বর্তমানে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন সাদিক কায়েম। এছাড়া, ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এস এম ফরহাদ এবং সেক্রেটারি মহিউদ্দিন খান।
আজ বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করেন চীফ রিটার্নিং অফিসার অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন।
তিনি বলেন, 'আমরা দীর্ঘদিন গণতন্ত্র বঞ্চিত, ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। দেশ যখনই কোনো বিপদে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন উদ্ধার করে। আমরা কথা দিয়েছিলাম যে আমরা যে কথা দিবো সেটা রক্ষা করবো, আমরা সেটা রক্ষা করেছি।'
তিনি আরও বলেন, 'ডাকসু প্রত্যাশিত ছিলো। আমরা নির্বাচন আয়োজন না করতে করতে অনেক বিষয় ভুলে যাই। আমরা এবারের নির্বাচনের মাধ্যমে একটি মডেল গঠন করেছি যা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ কাজে লাগাতে পারবে।'

ডাকসু নির্বাচনে জয়ী হলেন যারা
সহসভাপতি (ভিপি)– আবু সাদিক কায়েম (শিবির সমর্থিত)
সাধারণ সম্পাদক (জিএস) –এস এম ফরহাদ (শিবির সমর্থিত)
সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস)—মুহা মহিউদ্দীন খান (শিবির সমর্থিত)
মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক—ফাতেমা তাসনিম জুমা (শিবির সমর্থিত)
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক—ইকবাল হায়দার (শিবির সমর্থিত)
কমন রুম, রিডিং রুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক— উম্মে ছালমা (শিবির সমর্থিত)
আন্তর্জাতিক সম্পাদক—জসীমউদ্দিন খান (শিবির সমর্থিত)
সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক—মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ (স্বতন্ত্র)
গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক—সানজিদা আহমেদ তন্বি (স্বতন্ত্র)
ক্রীড়া সম্পাদক—আরমান হোসেন (শিবির সমর্থিত)
ছাত্র পরিবহন সম্পাদক—আসিফ আব্দুল্লাহ (শিবির সমর্থিত)
সমাজসেবা সম্পাদক—যুবাইর বিন নেছারী (স্বতন্ত্র)
ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সম্পাদক—মাজহারুল ইসলাম (শিবির সমর্থিত)
স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক—আব্দুল্লাহ আল মিনহাজ (শিবির সমর্থিত)
মানবাধিকার ও আইন বিষয়ক সম্পাদক—মো. জাকারিয়া (শিবির সমর্থিত)

বিভিন্ন হলে কে কত ভোট পেলেন
ভোটের ফলাফলে জগন্নাথ হল বাদে বাকি অধিকাংশ হলে প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় সুস্পষ্ট ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন সাদিক কায়েম। ভিপি পদে ছাত্রদলের প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান ১ হাজার ২৭৬ ভোট পেয়েছেন। এছাড়া, উমামা ফাতেমা ২৭৮ ভোট, স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম হোসেন ১৭১ ভোট এবং আব্দুল কাদের পেয়েছেন ২১ ভোট। এই কেন্দ্রে সাদিক কায়েম ১০ ভোট পেয়েছেন।
জগন্নাথ হলে ডাকসুর জিএস পদে মেঘমল্লার বসু সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ১৭০ ভোট পেয়েছেন। একই পদে ছাত্রদলের প্রার্থী তানভীর বারী হামিম ৩৯৮ ভোট পেয়েছেন। এস এম ফরহাদ পেয়েছেন ৫ ভোট।
এজিএস পদে ছাত্রদলের তানভীর হাদী আল মায়েদ এগিয়ে পেয়েছেন ১,১০৭ ভোট পেয়ে। শিবির সমর্থিত মোহাম্মদ মহিউদ্দিন খান পেয়েছেন মাত্র ৭ ভোট।
অমর একুশে হলে ভিপিপ্রার্থী সাদিক কায়েম পেয়েছেন ৬৪৪ ভোট। একই পদে দাঁড়ানো ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের মো. আবিদুল ইসলাম খান ১৪১ ও স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের উমামা ফাতেমা পেয়েছেন ৯০ ভোট।
শিবির সমর্থিত জিএস প্রার্থী এস এম ফরহাদ ৪৬৬ ভোট এবং ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের শেখ তানবীর বারী হামিম পেয়েছেন ১৮০ ভোট।
সুফিয়া কামাল হল থেকেও ভিপি পদে সর্বাধিক ভোট পেয়েছেন শিবির সমর্থিত প্রার্থী সাদিক কায়েম। তিনি পেয়েছেন ১,২৭০ ভোট। একই পদে ছাত্রদলের আবিদুল ইসলাম খান পেয়েছেন ৪২৩ এবং স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের উমামা ফাতেমা পেয়েছেন ৫৪৭ ভোট।
সাধারণ সম্পাদক [জিএস] পদে শিবির সমর্থিত প্রার্থী এস এম ফরহাদ পেয়েছেন ৯৬৫ ভোট, প্রতিরোধ পর্ষদের মেঘমল্লার বসু ৫০৭ এবং ছাত্রদলের শেখ তানবীর বারী হামীম পেয়েছেন ৪০২ ভোট।
সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে মোহাম্মদ মহিউদ্দিন খান এগিয়ে রয়েছেন ১,১৩৫ ভোট পেয়ে। একই পদে তানভীর আল হাদী মায়েদ পেয়েছেন ৩৯৭ এবং তাহমিদ আল মোদ্দাসির চৌধুরী পেয়েছেন ৩৫৫ ভোট।

অন্যদিকে, ফজলুল হক মুসলিম হলে ভিপি পদে সাদিক কায়েম ৮৪১ ভোট পেয়ে এগিয়ে আছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আবিদুল ইসলাম খান পেয়েছেন ১৮১ ভোট।
অন্যান্য প্রার্থীদের মধ্যে উমামা ফাতেমা ১৫৩, আব্দুল কাদের ৪৭, জামালুদ্দীন খালিদ ২২ এবং বিন ইয়ামিন মোল্লা পেয়েছেন ৬ ভোট।
জিএস পদে শিবিরের এস এম ফরহাদ পেয়েছেন ৫৮৯ ভোট, ছাত্রদলের হামীম ২২৮ এবং বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের আবু বাকের মজুমদার ৩৮১ ভোট।
এজিএস পদে মহিউদ্দিন খান পেয়েছেন ৭০৫ ভোট, তানভীর হাদী আল মায়েদ ১৮৮, তাহমিদ আল মুদাসসির ১২১ এবং আশরেফা খাতুন ৩৫ ভোট।
শহীদুল্লাহ হলেও ভিপি, জিএস ও এজিএস পদে এগিয়ে আছেন শিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থীরা।
ভিপি পদে সাদিক কায়েম পেয়েছেন ৯৬৬ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের আবিদুল ইসলাম খান পেয়েছেন ১৯৯ ভোট। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের আব্দুল কাদের পেয়েছেন ৫৬, স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্যের উমামা ফাতেমা ১৪০, ছাত্র অধিকার পরিষদের বিন ইয়ামিন মোল্লা ৬, স্বতন্ত্র শামীম হোসেন ১০১, জামালুদ্দীন খালিদ ২৬ এবং শেখ ইমি পেয়েছেন ২ ভোট।
জিএস পদে শিবিরের এস এম ফরহাদ ৭৭৩ ভোট পেয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের আবু বাকের মজুমদার পেয়েছেন ২৪১ ভোট এবং ছাত্রদলের তানভীর বারী হামিম পেয়েছেন ২৪৯ ভোট।
এজিএস পদে শিবির সমর্থিত মোহাম্মদ মহিউদ্দিন খান সর্বাধিক ৮৪৪ ভোট পেয়েছেন। এই পদে ছাত্রদলের তানভীর আল হাদী মায়েদ পেয়েছেন ১৮৯ ভোট।

জহুরুল হক হলে ভিপি পদে সাদিক কায়েম পেয়েছেন ৮৯৬ ভোট। অন্যান্য প্রার্থীদের মধ্যে ছাত্রদলের আবিদুল ইসলাম খান পেয়েছেন ৩১৪, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের আব্দুল কাদের ৮৭, স্বতন্ত্র উমামা ফাতেমা ৯৬, শামীম হোসেন ১৯৪ এবং জামালুদ্দীন খালিদ পেয়েছেন ১৮ ভোট।
জিএস পদে শিবিরের এস এম ফরহাদ পেয়েছেন ৬৭০ ভোট। ছাত্রদলের হামিম পেয়েছেন ৪০৯, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের আবু বাকের ৮৯, আরাফাত ২২০, সাদী ২২৯ এবং মেঘমল্লার বসু পেয়েছেন ১৪০ ভোট।
এজিএস পদে শিবির সমর্থিত মহিউদ্দিন খান পেয়েছেন ৭০৪ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের তানভীর হাদী আল মায়েদ পেয়েছেন ২৮৭ ভোট। এছাড়া আশরেফা খাতুন পেয়েছেন ৩২ এবং তাহমিদ আল মুদ্দাসসির পেয়েছেন ১৮২ ভোট।
উল্লেখ্য, দীর্ঘ ছয় বছর পর গতকাল মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮টি কেন্দ্রে ৮১০টি বুথে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
এবারের নির্বাচনে ডাকসুর ২৮টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন মোট ৪৭১ জন প্রার্থী। এর মধ্যে নারী প্রার্থী ৬২ জন। সহ-সভাপতি [ভিপি] পদে ৪৫ জন, সাধারণ সম্পাদক [জিএস] পদে ১৯ জন এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক [এজিএস] পদে ২৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। নারী প্রার্থীদের মধ্যে ভিপি পদে ৫ জন, জিএস পদে একজন ও এজিএস পদে ৪ জন প্রার্থী ছিলেন।
এবার মোট ভোটার ছিলেন ৩৯ হাজার ৭৭৫ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ছাত্র ভোটার ২০ হাজার ৮৭৩ জন এবং ছাত্রী ভোটার ১৮ হাজার ৯০২ জন।
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে যা বললেন ভিপিপ্রার্থী উমামা ও আবিদ
এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী উমামা ফাতেমা। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা চলার মধ্যেই মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাত ৩টা ২৪ মিনিটে নিজের ফেসবুক থেকে দেওয়া পোস্টে তিনি এই বর্জনের কথা জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন: বয়কট! বয়কট! ডাকসু বর্জন করলাম: উমামা ফাতেমা
পোস্টে তিনি লিখেছেন, 'বয়কট! বয়কট! ডাকসু বর্জন করলাম। সম্পূর্ণ নির্লজ্জ কারচুপির নির্বাচন। ৫ আগস্টের পরে জাতিকে লজ্জা উপহার দিল ঢাবি প্রশাসন। শিবির পালিত প্রশাসন।'
ডাকসু নির্বাচনকে 'পরিকল্পিত প্রহসন' বলে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছেন ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী মো. আবিদুল ইসলাম।
আরও পড়ুন: 'পরিকল্পিত কারচুপির এই ফল দুপুরের পরপরই অনুমান করেছি': ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদ
মঙ্গলবার দিবাগত রাত ২টা ২০ মিনিটে ডাকসু ফলাফল ঘোষণার সময় নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আবিদুল ইসলাম লেখেন, 'পরিকল্পিত কারচুপির এই ফলাফল দুপুরের পরপরই অনুমান করেছিলাম। নিজেদের মতো করে সংখ্যা সাজিয়ে নিন। এই পরিকল্পিত প্রহসন আমি প্রত্যাখান করছি।'